বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শিকড়ের কবিদের কবিতায়
স্মরণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি
অজেয় রাখাল
কাজল রশীদ
বেদানার আকাশ ছেড়ে কোথায় লোকালে হে বঙ্গ-রাখাল
কর্দমাক্ত বাংলায় তোমার প`য়ের চিহ্ন বড্ড প্রয়োজন আজ।
একদল হায়েনা,ঘাসের বদলে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে জমিন
প্রতিমুহূর্তে ধ্বংস হচ্ছে ঘাসের বিছানা।
ঘরে ফেরা পাখিরা আজ দিগভ্রান্ত
সময়ের দৌড়ে তোমার ছায়ার বড্ড প্রয়োজন আজ।
প্রতিদিন আকাশে উঠে না রূপালী চাঁদ
মেঘেরা গর্জে না সময়ের তাগিদে।
কোথায় লোকালে হে বঙ্গ রাখাল মোহ্যমান চরাচর ছেড়ে-
রাঙ্গা বধূর আঁচল খামছে ধরেছে সেই পুরনো শ্বাপদ।
নিরেট অন্ধকার গ্রাস করে বৈধব্য উনুন
সুপ্ত বাসনার প্রজাপতিরা উড়ে না আপন মনে
হুতুম পেঁচার বিদকুটে আওয়াজ ভারি করে উঠোন।
তোমারই প্রতীক্ষায় হে বঙ্গ-রাখাল
কৃষাণীর সিঁদুর মুছে যায় ধূমল বৃষ্টিতে
পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে ধূম্র শক্তিতে।
পিতা,দিব্য কোন ছায়ার ভিতর তোমার অস্তিত্ব চাই
তোমার পা’য়ের চিহ্নে মহনীয় হউক এই চরাচর
হে প্রাণাধিক,শত জন্মের কসম,আবার আসবে ফিরে...
তোমারই প্রতীক্ষায়-
শোকার্ত পাখি অনিমিখ চেয়ে থাকি দিগন্ত পানে।
কবি কাজল রশীদ
কাজল রশীদের জন্ম ২ জুলাই ১৯৬৭ সালে মৌলভীবাজার জেলার উত্তরমুলাইম গ্রামের লম্বাবাড়িতে।তার পিতা মোঃ মখলিছ মিয়া ও মাতা রাবিয়া বেগম।দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছোট।কাজল রশীদের লেখাপড়া শুরু উত্তর মুলাইম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ভর্তি হন শহরের কাশিনাথ আলাউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে। উচ্চমাধ্যমিক অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৮৮ সালে বিলেত আগমন করেন। প্রথমে চাকুরি, পরে ব্যবস্যায় জড়িয়ে পড়েন।
পহেলা ফেবুয়ারি ১৯৮৭ সালে কাজল রশীদ লাভলী রশীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাবলি রশীদ, মুয়ায়মিন রশীদ ও শারমিন রশীদ নামে তার তিন ছেলেমেয়ে আছে। বর্তমানে তিনি সেন্ট্রাল লন্ডনের কেমডেন লক এলাকায় বসবাস করছেন।
লেখালেখির শুরু আশির দশকের মধ্যভাগে, মূলত কবিতা লিখেন, ছড়ায়ও পারদর্শী। সাহিত্যের কাগজ শব্দরূপ সহ সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু সাহিত্যের কাগজ। তার সম্পাদনায় বিলেত থেকে বেরিয়েছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কবিতাগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের আকাশ’। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন-বিলেত, ভারত, বাংলাদেশের কবিদের কবিতা নিয়ে সংকলন ‘কাব্যস্নান’। দ্বিভাষিক কবিতা সঙ্কলন ‘ভাষান্তরে বাংলাভাষার কতিপয় পঙক্তি’। বিলেত ও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের কাগজ ‘শব্দপাঠ’ ও প্রবাস প্রকাশনীর প্রকাশক। সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের কাগজ ‘মনুস্বর’। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টির বীজপক্ষ’ ‘উত্তর মুলাইম’
সংসার, কর্মজীবন, কাব্যজীবন, বন্ধুত্ব, আড্ডা, প্রকাশনা, রাজনীতি সব মিলিয়ে তিনি যেন বাজীমাত করেছেন। সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন সবক্ষেত্রে। কবি কাজল রশিদ, রসিকতায়ও পটু, এমনকি সরল কিংবা গরল যেমনই হোক সোচ্চার তার কণ্ঠ, কখনও কখনও কণ্ঠের ব্যাপ্তি কবিতার শব্দে ও ছন্দে প্রকাশ পায়।
কবিতা
করোনাকাল
ওভারটাইমের পালা বুঝি হলো শেষ
কলিং বেল এখন আর কেউ টিপে না
মিহি মায়ার গলিপথ,কেটেছে ভাবাবেশ।
লকডাউন,তোমার ঘুরাতে পারেনা চোখ
পিচনে কথা বলা হউক যতই-ওপেন আলিওয়ে
কন্টিকিত পথ,ভারাক্রন্ত কুৎসারাই সর্বসুখ !
আইসিলোসন,শীতার্ত বাতাসে বাজছে শব্দিত সুর
উষ্ণতা জানে কী ভাবে জাগাতে হবে মৃত অনুভব
কাছের তারা নিবো নিবো,মনে হয় বহু দূর।
কোয়ারেন্টিন,আকাশের মৌনতা ভেঙ্গে উঠেছে দ্বিধাম্বিত চাঁদ
আর কতো নিরামিষ সময় কাটবে একাকী বিভাষ
বিস্মিত প্রহরে দেখি রোজ, সহিষ্ণু জীবনের ফাঁদ ।
জমা রেখেছি সুষম সময়ে
ইদানীং মনের উষ্ণায়ন
গতিহীন,করোনাক্লান্ত
চারিদিকে স্বাদহীন গন্ধে অগম্য বিষাদ বারে
থুবড়ে পড়া শক্তি জোগাতে ঈশ্বরের কাব্যকলা শিখি
অধীর জীবন বাঁচাতে প্যাগোডায় সমর্পিত হই।
ভোরের সূর্যরা প্রশান্তির আলো খুঁজে নিবিড় প্রার্থনায়।
হয়তো একদিন পাহাড় নেমে আসবে নদীর কাছাকাছি
হয়তো একদিন টেমসে গড়িয়ে পরা জল;
মিশে যাবে সমুদ্রের নোনা জলে...
মনে হয়, বিধবা রাতের কাছে প্রার্থনা
জমা রেখেছি সুষম সময়ে।
চাঁদের মিছিল
মফস্বল শহর জীবিকার মিছিল
নিঃসঙ্গ বাগিচা অঙ্গারহীন চুলায়
অবিরাম দূরের নগরে স্বয়ম্বর স্বপ্নচারিতা
মিছিলের ক্লান্তি অশ্রুজল হয়ে
উঠে মস্তিষ্কপ্রবণ
সন্ধানী পুকুরে বাড়ে শ্যাওলার ভিড়
চৈত্রের ডাহুক ডাকে ফ্রেমবন্দি জংলায়
অন্নের ভিন্ন পরশে পাখী কান্না
মূমুর্য় আবছায়ার ভিতর সুনিবিড় গন্তব্য
ডুকরে উঠে
পাথর সময়, সময়ের আয়নায় ভেসে উঠে চাঁদমুখ।
মায়াফুল
চতুর গণিকা জানে কীভাবে লেজ নেড়ে
ব্রত্য নবীন মগ্নতা ভাঙে
মুনিয়া শিস দিয়ে ভাঙে ফেলে কালের আরাধ্য-টান ।
কতটা সরল অঙ্ক যোগ হলে
তপস্বীর ধ্যান ভাঙে ?
আঁধার অরন্যে কাছে টানে ধূর্ত গণিকা
রাতের ছালনায় সাধু ভোলেন কৌলিন বৃত্তান্ত
প্ল্যাস্টিক ফুলের বাহারি চমক
বিষাদে ভরা মায়াফুল-
এক চুমুতেই জীবনের গতি পালটে যায়।
চাতুর্যের দেয়াল বেহাল হলে ভেঙ্গে যায়
প্রার্থনার প্যাগোডা!
স্বদেশ শুয়ে আছে অন্তহীন
হাড় গুড়া মিশানো বন্ধুর পথ
কবরে শুয়ে আছে স্বদেশ
মৃত্তিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সবুজের
ভাঁজে-ভাঁজে দ্বৈমাতৃক ফসল ঝরে জরায়ুতে
ইদুরীয় চাষাবাদে বিনষ্ট উর্বরিত জমিন।
ক্রমাগত লালসায় পিষ্ট হতে
অনুর্বর মৃত্তিকায় শিকড়ের বাণিজ্য চলে
ডানা মেলা পাখীরা জড়ায় কুহকের জালে
শিল্পিত বন বিন্যস্ত উদ্যানে
অনাবাদী জমিতে শস্যরা ঝরে।
অতীত সারল্য ভেঙে জলের গভীরে জোছনা উড্ডীন
কবরে শুয়ে আছে স্বদেশ; একা অন্তহীন।
প্রাযুক্তিক ইঁদুর
পর্দার আড়ালের কাঠি নেড়ে
আঁধারে ঢাকছো আগামীর ক্যানভাস
কাঁচ ঘেরা স্বপ্নমঞ্চে ঢিল চুঁড়ে হাসছো চাপাস্বরের হাসি
অসংখ্য সম্ভাবনার মৃত্যুদৃশ্যে কেবলই তোমার লুলোপ অভিলাষ।
গিরিবাজ রৌদ্রের তুমুল দ্বন্ধে ব্যথাগুলি নড়ে উঠে
হিংস্র প্ররোচনায় আদল বদলাচ্ছো প্রাযুক্তিক ইঁদুর ।
গাছেরা অভ্যাসের দাস,পান করে রক্তবমির নির্যাস
গাছেরা বনবাসি অচলায়তন সম্ভাবনার অশ্রুবাষেপ
পথরেখা মুছে যাচ্ছে বিবশ রাতের ডানায়
ডানার উদ্দাম বিবর্ণ জলে ঘুরছে সপ্তডিঙ্গা
ছিঁড়ে ফেলা স্বপ্নস্রোতে ভাসছে ঢেউভাঙা প্রবাহ।
সন্ধি
তিলকচিহ্নে পিঁপড়েরা হুল ফুটিয়ে চলে গেলো সটান
সন্ধিপত্রে ওদের নাম সহসাই জানা গেলো।
আঙুলের ফাঁকে থাকা বিভ্রান- ঘামেরা
অকাতরে ভেসে গেলো উপনদীর উপমায়।
দাসখত বানিজ্যে ধ্বংস হলো পাহাড়ের পর পাহাড়
সুনীল সমুদ্র দূষিত হলো পারসপরিক দূষণেৃ।
নীতির বুকে স্বপ্ন গুঁজে ছুটে যাচ্ছে নৈতিক ঘোড়া
পেগের পবিত্রতা নিয়ে ঝঞ্ঝাট ? সন্ধিতেই বুঝাপড়া।
দ্রোহ
একটি ঘোলা পুকুরে রাশি রাশি শ্যাওলা জমা থাকে
অন্তঃসার চিরে ঝাঁঝালো গন্ধ জলের রেখাগুলি মুছে দেয়।
বিদকুটে পেঁচার নখের আঁচড়ে উত্তাপ যতটা ম্লান হোক।
উল্টোপথে রোদে পোড়া সূচাগ্র
নকশা বাহকের সাহসী মুখমন্ডল
অন্ধকারে বেড়ে উঠা প্রভূত চাঁদগুলো অভিমানী জনপদে
একবার যদি ঊর্ধ্বাকাশে বিছায় মেঘের কুণ্ডলী...!
দ্রোহের নদী স্বেচছাচারী কলমের নিবে আগুনের সূচিকাভরণ।
যে মুদ্রণকৃত পালঙ্কে বিছানো মখমলের চাদর ,
শিরা উপশিরায় বেদনাবোধের মিছিলে
বুননের কৃৎ কৌশলে দাঁড়াবো অধিক মাথা উঁচু করে ।