কবি ময়নুর রহমান বাবুল
ময়নুর রহমান বাবুল- কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাশিল্পী সাহিত্যের সকল বিষয়ে তিনি দক্ষ কারিগর।
জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩০শে আগস্ট। সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলাধীন খাপন গ্রামে। কুরুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু। সরকারী এম সি কলেজ থেকে স্নাতক সমাপ্ত করেন। কলেজে অধ্যয়নকালিন ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় সম্পৃক্ততা, এম সি কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জি.এস এবং আশির দশকে বাম রাজনীতিতে দৃঢ় পদচারনা। কৃষক ক্ষেতমজুরদের দাবী আদায় এবং স্বৈরাচার বিরুধী আন্দোলনে দীর্ঘ দিন কারাবরণ তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়।
এছাড়াও সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। উদীচী, কুহেসাস, বাংলাদেশ লেখক শিবির, সমস্বর ইত্যাদি সংগঠন সমূহের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে থেকে কাজ করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।
দেশে এবং প্রবাসে সাংবাদিকতায়ও তার কর্মক্ষেত্র বিস্মৃত। দেশে দক্ষতার সাথে দীর্ঘদিন বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন সিলেট সংবাদ, সিলেট সমাচার, দেশবার্তা, যুগভেরী, বাংলার বাণী ইত্যাদি স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্র সমূহে। বালাগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখিতেও তার সুযোগ্য পদচারনা দীর্ঘ দিনের। মুলত: মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাকালিন সত্তুর দশক থেকেই তার লেখালেখি শুরু। তখন থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সংকলন সাময়িকীকে তার লেখাসমূহ প্রকশিত হয়। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে - প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি (গল্প), স্বদেশ আমার মা আমার (কবিতা), ভালোবাসায় আগুন জ্বলে (কবিতা), ছিনিয়ে নেব (কবিতা), ছড়া দুইছড়া (ছড়া), বিন্দু আমার বৃত্ত (কবিতা), চোখের দেখা প্রাণের কথা (প্রবন্ধ), নীল জলে নীল বিষ (গল্প), নিগূঢ় পরম্পরা (গল্প), হ্যাঁ জয়যুক্ত হলো (কবিতা), দুঃখ তবুও দাও (কবিতা), চড়া দামে ছড়া (ছড়া), জলজোছনার দাবদাহে (কবিতা) ।
যৌথ সম্পাদিত: একাত্তরে সিলেট: স্মৃতিকথা, একাত্তরের স্মৃতিগুচ্ছ, প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আজিজ সন্মাননা গ্রন', মুক্তিযুদ্ধের ধূলিপথের চারণ : তাজুল মোহাম্মদ সন্মাননা গ্রন্থ।
সম্পাদিত সংকলন: ঝংকার, মৃদৃগুঞ্জন, প্রাণপলি, এবং যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মাসিক জর্নাল সমাজ চেতনা‘প্রকাশনায় লন্ডন থেকে সর্ব ইউরোপীয় দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘ দিন। ১৯৯২ সাল থেকে যুক্তরাজ্য প্রবাসী।
কবিতা
আটপৌরে জীবন
জঙ্গলে লেগেছে আগুন, পুড়ছে আমাজন
ছাই ধোঁয়ার উন্নয়নে একাকার সুন্দরবন।
আমাদের ঘর পুড়ছে, বস্তি ও বাড়ি পুড়ছে
শহর, নগর, বন্দর, মন পুড়ে ছাই উড়ছে
বাজারে পুড়ছে পেঁয়াজ, লবন, চাল, ডাল
গুদামে পঁচে যাচ্ছে সব, শিশুখাদ্যে ভেজাল।
আমাদের ডানে সন্ত্রাস, দূর্নীতি লুট হরিলুট
বাঁয়ে ভাঙ্গন, ভেদাভেদ ভিন্নমতের গুমোট
সামনে গভীর অরণ্য, আলোহীন আকাশ
যন্ত্রণায় থেমে গেছে সব প্রাণের উচ্ছ্বাস।
আমাদের মেঘগুলো জমে জমে হয়েছে পাথর
সত্মুপে সত্মুপে শুধুই জমছে এসব মাথার উপর
সব পিছে রেখে কালের পীঠে হাতুড়ি পিটাই
আশার আলোয় বুক বেঁধে সকল ড়্গুধা মিটাই
এইতো আমাদের জীবনচলা আটপৌরে সংসার
অতিষ্ট জীবন, তবু চেষ্টা হামাগুড়ি দিয়ে বাঁচার।
আমি জেগে আছিঃ ভালো আছি
ভুল জায়গায় পা ফেলি, পা রাখি
তাইতো পঁচা শামুকে পা কাটে বার বার।
গভীর আঁধারে নিজের আপন ছায়াটা
বড় অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়, বেঈমানী করে
অন্ধকারেই যেন চারিদিকে হাতড়াই
খুঁজে পাই না ছায়া, কিংবা নিজেকেও
জানি না কোথায় সব হারিয়ে ফেলি
হারিয়ে যায় জীবনের কুড়ানো অধ্যায়গুলো।
কী আলো, কী আঁধার, সবই যেন একাকার
পুরো জীবনটাই হাবুডুবু খায় ঘোলা জলে
সকল পাহাড়ের চূড়ায়ই সূর্য ওঠে
অসত্ম যায় সাগর জলে...
তেলামাথায়ই সবাই কেবল ঢালে তেল
বাকী মাথাগুলো তেলহীন উস্কো-খুস্ক
পা পিছলে পড়ে যাই বার বার পিচ্চিল কাদায়
কাদাজলে লুটোপুটি, তেলহীন জলহীন
শুন্যতায় হাহাকার চারিদিক, চতু:পাশ
লোকালয়ে নিসত্মব্ধ নিরবতা, মৃত্যুপূরীর ছবি
এর মাঝেও সগৌরবে চিৎকার দিয়ে জানান দেই
আমি জেগে আছি, ভালো আছি...
আমাদের পথচলা
তোমাকে নিয়েই আমার দূরন্ত পথচলা-
একটু সকাল একটু আলো কিংবা হয়তো
প্রখর দুপুরের উত্তপ্ত রোদে পুড়তে পুড়তে
বিকেলের মিষ্টি মধুর রোদে স্নান করা।
এভাবেই চলে গেছে অনেকদিন বহু কাল,
তোমাকে নিয়েই লিখেছি আমার কবিতা
তোমার নাম বার বার স্পষ্ট লিখা আছে
আমার সব লেখায়, হৃদয়ের আঙিনায়।
সেইসব দিন ছিলো রোদ ঝলমল উচ্ছ্বাস ভরা,
বুকের ভেতর উড়তো তখন রঙিন প্রজাপতি
আমের মুকুলে মুকুলে মৌমাছি ঘুরে বেড়াতো
পাখি উড়তো, ডালে বসতো, গান গাইতো,
গাছে গাছে ফুটতো ফুল, নদীও বইতো নিরবধি..
এখন আর ওসব হয় না, আটকে গেছে সব-ই
নিরব, নিথর সবকিছু স্থবির, নিসত্মব্দ অচল।
শহরে গাড়ি নাই, নগরে যন্ত্রের শব্দ নাই
বন্দরে জাহাজ ভিড়ে না, নোঙরও করে না
রাসত্মায় যানবাহন কিংবা মানুষের ভীড় নাই,
বাতাসে ধূলা ওড়ে না, ধোঁয়াও দেখা যায় না
রাস্তায় দাবী আদায়ের মিছিলও হয় না
চারিদিক ভীষণ রকম নীরব, সুনসান ...
নগর শহর বন্দর মৃত্যুপুরী, শ্মশান
বৈশ্বিক মহামারী, প্রলয়ঙ্করী ভাইরাস
থামিয়ে দিয়েছে প্রতিটি দেশ, সারা জগৎ
যা কিনা এর আগে এমটা কেউ পারেনি!
এমন দূ:সময়ে কবিতা হয় না, প্রেম হয় না
অতএব ঘূরে ফিরে তোমার নাম, তোমার কথা
কবিতার লাইনে লাইনে আর সত্মবকে সত্মবকে
উপমায় আর নানান রঙের মাধুরী মিশিয়ে
ছন্দে ছন্দে সুরের লহরীতে আর আসে না..
এখন আর একসাথে চলা নাই, ঘুরা নাই
আমাদের এখন থাকতে হয় কঠোর নিয়ম মেনে
তাইতো এখন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পথচলা !
যদিও মানুষ একদিন ঘুরে দঁড়াবেই-
ভোর হবে, আঁধারও কেটে যাবে, পাখি ডাকবে
প্রজাপতিও উড়বে, গাছে গাছে ফুলও ফুটবে,
আলোর ডাকেই দূয়ার খোলে বেরম্নবো আমরা
আবার শুরু হবে আমাদের পথচলা, মিতালী।
কিশোর বেলার ঘাট
বড় বেশী যেন মনে পড়ে আজ ;
মনে পড়ে- ছোট বেলা, কিশোর বেলার কথা,
গ্রামের বাড়ি, উঁচু তালগাছ, ঝোলানো বাবুই বাসা
আমের মুকুল, কলার কাঁদি, শতবর্ষী বটের ঝুরী
গাভীর ওলানে বাছুরের গুঁতো, কবুতরের বাকুম বাকুম।
পাঠশালায় সুর করে পড়ঃ একে একে এক
দুয়ে দুয়ে চার, শতকিয়া ধারাপাত কিংবা
অ-তে অজগর,আ-তে আম, ক-তে কলা, খ-তে খই,
খেলার মাঠ, দুরন্ত দৌঁড়, গোল্লাছুট, কাবাডি...
গ্রামের কৃষক, মেটোপথ, সবুজ সোনালী ধান।
খুব বেশী মনে পড়ে, দু’চোখ বুজে আজও দেখি-
তোমার ছ’হাতি তাঁতের শাড়ি, চুলের ফিতা,
রিণিঝিনি কাঁচের চুড়ি, পায়ের নুপুর
গলায় ঝুলানো রূপার কবজ, নাকের নোলক
দীর্ঘ কালো চুল, কাজলকালো চোখ, শ্যামলা গতর ...
ষাটোর্ধ্ব আজ ফিরে যাই বারবার
সেই কিশোর বেলার দুষ্ট সময়ে
কৈশোর পেরিয়ে যৌবন, তারপর আজ...
তোমাকেই মনে পড়ে, আজও দেখি দু’চোখ ভরে
তোমার হাড়ি-পাতিল খেলা, কিশোরী সময়
আমার দিকে তাকানো, আঁড়চোখে চাওয়া
চুলের বেণী ঘুরিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিক করে হাসা
ঘাটে ঘাটে নাও ভিড়লো, নোঙর হলো
সওদা তেজারতি সবই হলো..
জীবনের তিনকাল ঘেঁটে, দূর পথ হেঁটে
হিসাব মিলাতে গিয়ে মনে হয়-
নাও কেন ভিড়লো না কিশোর বেলার ঘাটে!
অনাবাদি মন
সেই আগে তুমি ছিলে যেমন
এখনো আছ ঠিকই তেমন
বদলাওনি যে একটুও,
আগের মতো মান-অভিমান
প্রাচুর্য আর জাত্যাভিমান
রয়ে গেছে নাক উঁচুও।
মাটিতে পড়ে না চরন দুখানি
সেই অভিমানী আছ জানি
গায়ে ছোঁয় না বৃষ্টি তাপ রোদও।
সময় তো অনেক হলো
তবুও কেন যে বলো
চিত্তে জাগে না কোন বোধও।
এভাবেই তোমার অনাবাদি মন
থাকে অনুর্বর, হৃদয় সারাক্ষণ
পাও না স্ফূর্তি আমোদও।
দূর আকাশের তারা
এইটুকু শুধু জানি-
এই পথখানি,
মাড়িয়েছি আজ চলিস্নশ বছর পর
বোনটি আমার, এখানে বেঁধেছিলো তার ঘর।
বোন নাই, ঘরও নাই, খা খা শুধু একখানা বাড়ি
পথ আছে, আছে দু’ধারে তার ’গুবাক তরম্নর সারি’।
একদিন আমি এই
বোনটি ছাড়া স্নেহ দিতাম না কাউকেই
তার সাথেই খেলা, হতো সারাবেলা, করতাম লুটোপুটি
চলতো আড়ি, বন্ধ মাতামাতি, হাজারো খুঁনসুটি।
বোনটি আমার, জানি না কোন্ধসঢ়; সে অভিমানে
চলে গেলো তারাদের সাথে, আকাশের মাঝখানে !
সেই থেকে এই বুকটি ভেঙেছে আমার
ইচ্ছে হতো না আর, তার সেই বাড়িতে যাবার
পথ চলি, মনে মনে বলি
লড়্গী আমার বোনটি আমার, কেন তুই আকাশের তারা হলি?
সাফাই
ময়নূর রহমান বাবুল
তুমি জানতে চেয়েছ -
আমি হলাম না কেন তোমার?
কেন তোমাকে একা করে দিলাম?
কেন তোমার সব আশা হলো চুরমার?
কিন্তু দোষ কি আমার ?
তুমি ছিলে শক্তিধর, সাহসী
বিপ্লবীও। শিকল ভেঙ্গেছ বারবার
অথচ, ইচ্ছা হয়নি তোমার
ছুঁ মেরে ঈগলের মতো
আমাকে তুলে নেবার...
তুমি তো জানো না, এখন আমার
অনেক বেশী ইচ্ছা আর
সাহস হয়েছে বেঁচে থাকার...
ফুরসৎ নাই, পিছনে আর ফিরে তাকাবার।
মানুষ করবে জয়
নি:শ্বাসে এখন ভাইরাস ঝরে
নিরাপদ দূরে থাকো
সবইতো দিয়েছি উজাড় করে
ভালোবাসাটুকু ধরে রাখো।
আসবেই দিন ভোরের আলো
নির্মল দখিনা হাওয়া
বাঁকে বাঁকে যে চরগুলো হয়
সেতো নদী ভাঙ্গনেই পাওয়া।
এই দু:সহ দিন করোনা কাল
আর দেরী নয় যাবে কেটে
তখন দু’জনে হাতে হাত রেখে
এক সাথে যাব হেঁটে।
কোনও দূরত্ব রবে না তখন
পৃথিবীর এই আঙিনায়
লক্ষ প্রাণ দিতে হলো আজ
মহামারী করোনায়।
আবদ্ধ ঘরে এই দূর্বিসহ দিন
চারিদিকে করোনার ভয়
ঘুরে দাঁড়াবেই পৃথিবী আবার
মানুষই করবে জয়।
মানুষ ভাঙবে মানুষ গড়বে
মানুষই বাসবে ভালো
মানুষ ঘোচাবে ঘোর অমানিশা
মানুষই জ্বালাবে আলো।