কবি মালেক মুস্তাকিম
জন্ম ১৯৮৫ সাল। সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় জন্ম। গাঁয়ের ধূলোবালি আর কাঁদাজল মেখেই কেটেছে শৈশব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
পেশায় সরকারী চাকুরে।
এই সময়ের একজন তরুণ কবি। কবিতায় নিজস্ব ভাষা এবং স্বতন্ত্র স্বর দিয়ে নিজেকে উন্মোচিত করে চলেছেন। ভাবনা ও ভাষার সুতীব্র সংঘাতে জীবন উপলব্দীর জটিলতা মালেক মুস্তাকিম’র কবিতার বিষয়বস্তু। একটু কান পাতলেই তার কবিতায় শোনা যায় অতিক্রান্ত সময়ের সুর, যাপিত জীবনের অন্তরালে চেনা অচেনার দ্বন্দ্বে ঘুরপাক খাওয়া অন্য জীবন। তিনি অনলাইন সহ সাহিত্য সাময়িকী ও ছোট কাগজে নিয়মিতলিখছেন।
কবিতা
নক্ষত্রের শোকসভা
প্রতিরাতে নক্ষত্রের মৃত্যু- প্রতিরাতে শোকসভা-
গাছে গাছে কুচকাওয়াজ- বৃষ্টি-
সন্দেহের ফেনা জমাট বেঁধে ইটপাথর- জলঘুড়ি
জল থেকে উড়ে যায় অশ্রু-
কিছুটা সমুদ্রে
কিছুটা চোখে
আমাকে ঘিরে রাখে পিতলের নদী, কাঁচের আয়না-
ডুবে আছি গাভীন জলে, প্রতিবেশি ঘুমে-
এই নির্জন রাতে।
প্রার্থনা: ক্ষয়
কতোটা শিশির মাড়িয়ে একটি সূর্যের বেড়ে ওঠা
কতোটা অন্ধকার শুষে নিয়ে একটি চাঁদের জন্ম
কতোটা গাঢ় হলে একটি রাত সার্থক হয়ে ওঠে
ঝরে যাওয়া সমস্ত শিশিরের যত্নে
ল্যাপটানো অন্ধকারে ঘুমন্ত সারি সারি গ্রাম
এই হৃদয়খানি
এখানে বাঁশের পাতায় খেলা করে বনেদি প্রেম
কুহেলিকা বনে মধুচন্দ্রিমা যাপন শেষে
আয়োজন করে শূন্য সংসার
উদাম দুয়ারে দখিনের হাওয়া নেই
তবু
শিশিরের প্রার্থনা
আঁধারের প্রার্থনা
গাঢ় রাতের প্রার্থনা
জমা হয় মন্দিরে।
সূর্য ও চাঁদের বাড়াবাড়িতে তাই আক্ষেপ নেই কোনও।
অস্ত্রোপচার
এই শহরে কোথাও কোন ডাক্তার নেই
কিছু জিনিস ছেঁটে ফেলা খুব দরকার
অতীতের লেজ
স্মৃতির ডাল
সময়ের ছাল
বিগত প্রেমের
নষ্ট প্রহর
হাতের নখ অবাঞ্ছিত ঘাস
চোখের জল
লজ্জার তিল
এবং কিছুটা জীবন।
আমি আজ সব ছেঁটে ফেলতে চাই।
অন্দরমহলে খুর কেঁচি নিয়ে বসে আছেন ঈশ্বর
যাই, একটু ঘুরে আসি।
দীর্ঘশ্বাসের মতো কবিতা
তোমার থাকা এবং না থাকার মাঝখানে-
দাঁড়িয়ে আছে হাইওয়ে ট্রেন, স্মৃতিঘর- যাবে?
বৃক্ষেরা তুলে রেখেছে জলের সিগন্যাল, রজঃস্বলা পাতা!
আড়চোখে তাকিয়ে আছে রাত্রি, গন্তব্যের বীজপত্র-
জুতোর ভ্রমণকাহিনী পড়তে পড়তে
পায়ের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে নিদ্রাহীন আঙুল।
এখানে রোদের ছায়া, আলো ও আঁধারের পর্যটন-
এখানে শ্বাসনালী বেয়ে উঠে আসে নৈশব্দের ঢেঁকুর-
দীর্ঘশ্বাসের মতো সুদীর্ঘ কবিতা।
ফিরিয়ে নাও, গোলাপকাঁটা
সব উপেক্ষা ফিরিয়ে নাও-
ফিরিয়ে নাও পায়ে হাঁটা সব পথ, অনিদ্রারাত
ফিরিয়ে নাও মুখের দিকে চেয়ে থাকা
যাবতীয় বিস্ময়-
অপেক্ষার সব নদী ও গাছ
সেই কবে উড়ে গেছে নিছক হাওয়া
এঁকে দিয়ে পতনের পাটাতন,
কিছু ভুল অপেক্ষা করতে করতে
পাথর হয়ে গেছে,
মেঘের চিৎকারে
বৃষ্টি নামে অন্ধ জানালায়,
আমার হৃদপিন্ডে একটি মুখ দলা পেকে বসে থাকে।
ফিরিয়ে নাও, এই গোলাপকাঁটা, বিষণ্ণ সুন্দর।
মানুষের দেয়াল
মুখোমুখি দৌড়াচ্ছি
অথচ কেউ কারো কাছে পৌছুতে পারছি না
তবে কি রাত্রি হরণ করছে
আমাদের রক্তের বীজ ও ঘাস
অন্ধকারকে উপহাস করছে উষ্ণতার নীল
অস্তিত্বের প্রস্তাব মাটিতে শুয়ে নক্ষত্রের আলোয়
ঢেলে দিচ্ছে বিষ?
হৃদয়ের রক্ত জ্বলছে নিদ্রাহীন পিপাসায়
প্রাণের সংলাপ দেহের তাপে ক্ষয়ে যাচ্ছে
নিষ্কাম শিশিরের প্রার্থনায়
সারারাত পূজা দিচ্ছে ধ্যানমগ্ন গোলাপ?
আমাদের ভেতরের অগণিত মানুষ
সুইসূতোয় বুনে যাচ্ছে রোদ্দুরের ঢেউ
মিতব্যয়ী স্বপ্নের শরীর শুঁকে শুঁকে
সারারাত তসবি গুণছে দীর্ঘশ্বাসের মুখ?
জোনাকির পাখনায় ভর করে তবে কি
একাকি বেড়ে উঠছে মানুষের দেয়াল
দেয়ালের ওপারে?
ঘামের লাঙল
মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ি
মাটির গন্ধ আমাকে বিহ্বল করে
কী সুতীব্র গন্ধ!
স্ফুরিত হই আমি, ক্ষয়ে যায় নক্ষত্র
অনন্তের
ঘর্মাক্ত দেহে জোয়াল ধরি
নিরন্তর ছুটে চলি
পাষাণ মগজে ফসলের ঋণ
বাড়ন্ত সময়ের বিবাগী আবেগ
ক্লেদহীন ঘাড়ে তুলে নেয় হালের লাঙল-ঈশ্বর
অনন্তর প্রতীক্ষা
বৃষ্টির-স্বস্তির-ফসলের।
মেঘেদের মেঠোপথে কোদাল কাস্তে
সুবর্ণ জালে ভরে দেয়
মাঠ, আকাশ, প্রজন্ম প্রান্তর
আর আমরা গলে গলে যাই
কুয়াশার কর্কট প্রাচীর ডিঙিয়ে পান্ডুর প্রকোষ্ঠে।
আন্তরিক আড়াল
কখনো কখনো মানুষ নিজেই পিছু যায়
কখনো বাধ্য হয়ে
হতে হয় দেয়ালমুখী
রাত্রিও মাঝে মাঝে অন্ধকারে
হাতড়ে ফেরে অসুখের বীজ
নোনাজলে ভেসে যায় দীঘল সারস
মোমের পাটাতনে অগ্নিফলক
নুয়ে পড়ে অবেলায়..
সময়ের কাছে নতজানু মুহুর্তগুলোও
বিবেকের দায়ে খুজে নেয়
অন্ধ চোখ;
ঐ চোখেই আলো ভেবে
আঁধার পেরিয়ে যাই গহীন তলে
আন্তরিক আড়ালে;
মানুষ বলেই হয়তো এভাবে
যেতে হয়
মেনে নিতে হয়
পেছনের সরুপথ ।
শিকারি রাত
রাত্রির মতো শরীর ভাঁজ করে শুয়ে আছি
সারাবেলা হাশপাশ- বিড়বিড়ানি- যাত্রাপালা,
দাঁড়িয়ে থাকার মতো-
অসংখ্য পায়েরতলা কিচিরমিচির করছে সিঁড়িতে,
পথগুলো ঘুমহীন, বহুদিন।
মদের গ্লাসে ডুবে যাচ্ছে নর্তকীর নাভী ও তলপেট
আঙুলে আঙুলে নদীমুখ-
জলের অক্ষরে বজ্রপাত
ব্ল্যাকআউট ,
পৃথিবীতে এখন বিপদ সংকেত- উলুধ্বনি।
সুতা গোছাও, শিকারী রাত!