বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শিকড়ের কবিদের কবিতায়
স্মরণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি
শেখ মুজিব
আবু মকসুদ
জলের ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে সে হয় দক্ষ সাঁতারু, জল
ছাপিয়ে পৌঁছাতে পারে মাছের বাড়ি
ডুব দিতে পারে জলের গভীরে।
গাছের ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে সবুজের অভাবে কখনও
মিইয়ে যায় না, ফুসফুস দিয়ে যায়
অক্সিজেনের অবিরাম সরবরাহ।
বাতাসের ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে দিগন্ত তাঁর কাছে তুচ্ছ
তেজী ঘোড়ার মত দাপিয়ে সে জানায়
দিগন্ত বিজয় কোন ব্যাপার না।
আকাশের ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে নীলিমার রঙে অভিভূত হয়
অসীমের সীমানায় সে হয় অসীম
আকাশ তাঁর কাছেই পরাভূত হয়।
..
আলোর ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে জগত আলোকিত হয়
উৎসের সন্ধানে হেঁটে জানতে পারে
মূলে যার আলো সে আলো ছড়াবেই।
চাঁদের ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে সেই হয় জ্যোৎস্নার ফুল
উছলে পরা জ্যোৎস্নার আনন্দে
পাড়ি দিতে পারে অমাবস্যার পথ।
সময়ের ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে সময় তার হয়ে যায়
করায়ত্ত সময়ের পারে দাড়িয়ে জানায়
স্পৃহা থাকলে মহাকাল মাড়ানো যায়।
মানুষের ভাষা সবাই পড়তে পারে না
যে পারে সে হয়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ
তাঁর তর্জনীতে উদ্বেলিত হয় মানুষের হৃদয়
মানুষজন্মে সে-ই হয় শেখ মুজিব..
কবি আবু মকসুদ
জন্ম ১৯৭০ সালে। মৌলভীবাজার জেলার কলিমাবাদে। পেশা ব্যবসা। ১৯৮৭ সাল থেকে বিলেত প্রবাসী। লেখালেখির শুরু আশির দশকের শেষভাগে। ছড়া দিয়ে শুরু। আবু মকসুদ সেই ছোটবেলা থেকে এমন জীবনমুখী, সংগ্রামী আর সমাজ পরিবর্তনের লক্ষে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। আবু মকসুদ ছড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়েও সাবলীল। বিশেষ করে তিনি কবিতায় পরিপূর্ণতা নিয়ে কাব্যবিকাশের মাধ্যমে একজন শক্তিশালী কবি হিসাবে বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিয়েছেন। ছড়া কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। বাংলাদেশের শীর্ষ পত্রিকাগুলো সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কাছাড়ের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, সাহিত্য কাগজে ছাপা হয়ে আসছে অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প। সম্পাদনা করছেন বিলেত এবং বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সাহিত্যের ছোট কাগজ 'শব্দপাঠ' (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪ সাল)। নব্বুইয়ের দশকে আবু মকসুদ বিলেতের সাহত্যাঙ্গনে বিশাল প্রান্তর তৈরি ফেললেন। কবি আবু মকসুদের সম্পাদনায় প্রকাশিত শব্দপাঠ বিলেতে শুধু না তথা বিশ্ব বাংলাভাষী সাহিত্যপ্রেমীদের জন্যও অন্যতম একটি শক্তিশালী অধ্যায়ের সূচনা।
প্রকাশিত গ্রন্থ- নটার ট্রেন কটায় ছাড়ে (২০০৪ সাল), মিথ্যাবাদী রাখাল ছেলে (প্রথম প্রকাশ ২০০৫ সাল, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৮ সাল), একটি গুলি (২০০৬ সাল), দূরতর গ্রহ জীবন (২০১০ সাল), ক্রমাগত ঘুমের উনুন (২০১৩ সাল), খনিজ ভুলের কাছে জমা রাখি জলের মোহর (২০১৩ সাল), মৃত্তিকার মেঘলা ভ্রমণ (২০১৪ সাল), পাশে রেখে শুদ্ধ শিশির (২০১৫ সাল), আহত ঐতিহ্যের নদী (২০২০ সাল)। সম্পাদনা গ্রন্থ- বিলেতের ছড়া (২০০২ সাল), তৃতীয় বাংলার নির্বাচিত কবি ও কবিতা (২০০৯ সাল)।
কবিতা
স্কুল বাস
স্কুল বাসের সামনের সিট
আমার খুব পছন্দের
বেণী দুলানো কিশোরী
মাঝেমধ্যে পিছনে তাকায়, তার ঘাড়
ঘোরানো অর্ধ মুখ
চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়।
দিনের বেলাও চন্দ্র চিন্তা মাথায় উঁকি
কারণ তার নাম জোসনা,
একদিন পূর্ণিমায় দেখা দেবে
এমন ভাবনায় প্রতিদিন বাস যাপন করি।
বাসের শেষ স্টপে গতিপথের বদল।
ছেলে মেয়েদের আলাদা স্কুল
বন্ধু সঙ্গে মুখরিত হয়ে উঠে,
জোসনা তবু হৃদয়ে থেকে যায়।
ফিরতি বাসে দূরত্ব কিছুটা বাড়ে
পূর্ণিমার আশা হৃদয় ছাড়তে চায় না
এভাবেই কাটে চন্দ্র, অর্ধচন্দ্রের দিন।
অপেক্ষার দিন চন্দ্রভূক অমাবস্যায়
রূপান্তরিত হওয়ায় পূর্বমুহূর্তে
পূর্ণচন্দ্রের দেখা মিলে, পরিপূর্ণ
মুখাবয়ব উদ্ভাসিত হলে জোসনা
রূপালি স্নানে সম্মত হয়।
জোসনা সনে উনচল্লিশ বছর,
বাসের সামনের সিটের বেণী কন্যা
পাশাপাশি সিটের সহযাত্রী
দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায়।
মেঘের মেয়ে
আমাদের পাড়ায় মেঘ রাজাদের বাসা
তাদের কন্যা বৃষ্টি খেলার সাথী,
বেলা অবেলায় ভিজিয়ে দিতে তার
জুড়ি ছিল না। হঠাৎ উচ্ছল রোদে
সে এসে হাজির, ঝলমল দিন কর্দমাক্ত
হয়ে যেত। আমাদের বিড়ম্বনায় তার কী হাসি!
তাকে সঙ্গ দিতে হতো, নইলে বাধ্য করতো।
স্কুলের পোশাক পরে যেই মাত্র বেড়িয়েছি
অমনি বৃষ্টি দোরগোড়ায়, বায়না ধরেছে
তাকেও স্কুলে নিতে হবে। অনেক বুঝানো হতো,
সে নাছোড়বান্দা, অগত্যা তাকে নিয়েই
স্কুল পথে হাঁটা। আমরা ক্লাসরুমে সে
বারান্দার বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে, আমাদের
সাথেই নাকি বাড়ি ফিরবে।
স্কুল শেষে একসাথে ফিরতাম, তার কী আনন্দ!
তার গায়ে পড়া ভাব, অবুঝ স্বভাব
আমাদের আনন্দ দিতো। বৃষ্টি আমাদের সাথী,
তাকে পাশে নিয়ে এত পথ পাড়ি দিয়েছি।
পথ যত দীর্ঘ হতে লাগলো, মেঘ রাজার সাথে
অভিভাবকদের দূরত্ব দীর্ঘায়িত হলো। সংগত কারণে
বৃষ্টির মুগ্ধতা কমতে থাকলো সে এখনো আসে
পুরোন দিন স্মরণে পুনরায় মেতে উঠতে চায়।
আগের মত মনে আর প্রীতি জাগে না, উপেক্ষা
করতে পারলেই বাঁচি। বৃষ্টি নিরাশ হয়
তবু পুরনো সাথীদের পিছু ছাড়ে না।
আমাদের কাজ বেড়ে গেছে, এক এক জন
বিরাট কাজের কাজী। বৃষ্টিবিলাস মানায় না।
তবুও মন খারাপের দিনে পুরনো সাথীর জন্য
কাতর হই। ভাবি পুনরায় তাকে নিয়ে স্কুলে যাব।
স্কুল দূরে থেকে যায়, বৃষ্টিতে মন আর ভিজে না।
ভোরের স্নান
উনত্রিশের তৈয়ব, শেষমেশ তৈয়বা পেয়েছে
দীর্ঘ খরার পরে জলাধার উন্মুক্ত হয়েছে।
জলের আশায় দিন গুজরান করতে
করতে প্রবল পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত,
খড়ের গাদায় বসে থেকে আগুনের
অপেক্ষা। জীবন চুকেবুকে গেলে জলের
প্রয়োজনীয়তা থাকবে না এই ভেবে
আগুন আয়োজন সম্পন্ন। শেষবারের
মত বুকের জমিন খুলে অতীত উল্টালে
একটা চিহ্ন মিলে যায়, খাতার ভাঁজে
ঝরাপাতা তেমনি রয়েছে। বিস্মৃত স্মৃতি
খোঁজে খোঁজে ঝরাপাতার উৎসে মিলে
যায় তৈয়বা জলাধার। ফুরিয়েছে অপেক্ষার
প্রহর, ধূসর চোখে আবার লেগেছে আলোর
ঝিলিক। যুগল নহরের সম্ভাবনা উজ্জ্বল
হয়েছে, তৈয়ব হতে পারে তৈয়বায় বিলীন।
সামনের কুয়াশা মাঠে হেঁটে যাচ্ছে এক যুগল
দেখেই বুঝা যাচ্ছে সেরে এসেছে ভোরের স্নান!
আনসার মাঠে বিকেলের রোদ
আনসার মাঠ আমাদের সমবয়সী ছিল
দুরন্ত শৈশবে ঘন সবুজ ঘাসে আদুল পা
ফেলে যখন দৌড়াতাম, মাঠের শক্ত
মাটি পায়ের মাপে মোলায়েম হয়ে যেত।
জাম্বুরার বলে তবু দুয়েক ফোটা রক্ত
ঝরে যেত, রক্ত আমাদের চিহ্ন ছিল,
রক্তের মূল্যে কিনতাম মাটি, ঘাস, বিকেল,
বিকেল সাথী হয়ে আমাদের সাথে দৌড়াত।
শৈশব কৈশোরের দিকে ধাবিত হলে দুরন্ত
আমরা বিকেলকে আরো বেশি কব্জা করতে
থাকলাম, আনসার মাঠ প্রণোদনায় ঘনঘন
ডাকতে লাগলো, তার আহবান বল্গাহীন
পাখির মতো উড়তে শেখাল। নিয়মের
ব্যত্যয় ঘটিয়ে আনসার মাঠে দুপুর গড়াতে
থাকলো, কখনো ঘাসের আমন্ত্রণে শিশিরের
সঙ্গী হয়ে গায়ে জড়াতাম সকালের রোদ।
আনসার মাঠ আমাদের ছিল, তাই ভাবতাম।
কখনো ভাবি নি অচেনা এক দৈত্য তার
দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, চোখের সামনে
ছোবল মেরে নিয়ে যাবে, নিঃস্ব করে ফেলবে।
অভাবনীয় দুঃস্বপ্নে আনসার মাঠ বিপর্যস্ত
আমাদের শৈশব-কৈশোরের কোমল মাটির,
সবুজ ঘাসের মাঠ আজ ইট সুরকির জঙ্গল
অসহায়ত্বে তার চোখে করুণ জল। অসহায়
আমরাও তার বদলে যাওয়া রুখতে পারিনি।
আনসার মাঠে আমরা ছিলাম বিকেলের রোদ
আজ সেখানে স্থায়ী অমাবস্যা। আদুল পায়ের
রক্ত মুছে দিয়েছে অচেনা দানবের কর্কশ ইট।
ধর্মে বিশ্বাস করি
নিজেকে সেয়ানা ভাবতাম, অস্বীকার মানেই
আধুনিকতা। প্রগতির কাছে ধর্মের মূল্য নেই।
যত বেশি ধর্ম-বিদ্বেষ তত বেশি মুক্তমনা। ভাবতাম
প্রভুর চরণে যে প্রতিদিন সেজদা করে সে গোঁড়া,
সে মৌলবাদী। প্রগতি ধারণ করতে হলে ধর্ম মুক্ত
থাকতে হবে। চাই কি ধর্ম নিয়ে উচ্চকিত হতে হবে।
ধর্মই মনুষ্য বিনাশের বিষধর মারণাস্ত্র, চিৎকার
করে জানাতে হবে। মুক্ত মত এবং পথের জন্য
ধর্ম অবাঞ্ছিত। ভাবতাম শুদ্ধ সমাজে ধর্মের
কোনো স্থান নেই, ধর্ম মুক্ত পৃথিবী শুদ্ধ পৃথিবী।
এতদিন তাই চর্চা করে এসেছি, নিজেকে মুক্তমনার
কাতারে রাখতে ধর্মকে গালি দিয়েছি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য
করেছি। প্রগতি আমার কাঙ্খিত ছিল প্রগতির মাপে
নিজেকে গড়তে ধর্ম এড়িয়ে গেছি, মাড়িয়ে গেছি।
বিশেষ একটা ধর্মের প্রতি ছিল যাবতীয় ক্ষোভ, এই
ধর্ম যত নষ্টের মূল। এই ধর্ম মানুষকে বিকশিত হতে
দেয় না, এই ধর্ম মানুষকে অন্ধকারে ধাবিত করে।
প্রগতির প্রথম পাঠে মহান শিক্ষকেরা এই চিন্তা
মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, মুক্তচিন্তায় এই ধর্ম প্রতিবন্ধক।
অন্য ধর্ম কিছুটা হলেও সহিষ্ণু, এই ধর্ম গোঁড়া। যে
এই ধর্ম থেকে যত দূরে সে তত বেশি মানবিক, সে
তত বেশি মুক্তমনা, সে তত বেশি প্রগতিশীল।
বলাবাহুল্য ধর্মে ফিরে তথাকথিত মুক্তমত অসার
মনে হয়। তথাকথিত প্রগতি অসার মনে হয়।
এখন জানি একজন ধার্মিকের চেয়ে মানবিক কেউ
হতে পারে না। একজন ধার্মিকের চেয়ে প্রগতিশীল
আর কেউ নয়। ধার্মিকের চেয়ে মু্ক্তচিন্তা আর কেউ
ধারণ করে না, এখন জানি ধর্ম ছাড়া মুক্তি নেই।
সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে শিকড়ের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন
কবি আবু মকসুদ
...................
পঞ্চাশের যুবক ও একজন
কবি বন্ধু
ফারুক আহমেদ রনি
সৃষ্টি এবং ধ্বংস এই দুটো বিষয় নিয়েই আমাদের পৃথিবীতে আসা। একটা পূণাঙ্গ বয়সের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে আমরা সাধারনত আমরা অতীতকে নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করি। আমাদের অর্ন্তনিহিত প্রশ্নটি হচ্ছে আমি আমার জীবনে কি করেছি? আমি কি ছিলাম? কি আমার করা উচিত ছিল? মানব জীবনের চূড়ান্ত অর্থ কী? আমার জন্মের কারণ কি?
বিবর্তনতত্ত্ব এবং নাস্তিকতাবাদের দর্শনের সুক্ষ্ন প্রভাবগুলির মধ্যে একটি হল আমরা একটি চুড়ান্ত উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্ট এবং আমাদের জন্য একটি পরিকল্পনা রয়েছে। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্বকে বিজ্ঞান গ্রহণ করে নিলেও ধর্মীয় মতাদর্শে বিবর্তনতত্ত্ব সাংগ্রসিক। তবে বিজ্ঞান, নাস্তিকতাবাদ বা ধর্মীয় অবস্থান থেকে জন্ম এবং মৃত্যুকে নিয়ে যে যার মত প্রজ্ঞাময় সঙা উপস্থাপন করুক না কেন। বাস্তবতা হচ্ছে জীব ও প্রাণী উভয়ের জন্য বয়সটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সত্য এবং বয়সের ধাপটা জীবন এবং শরীর সম্পর্কে পার্থক্য বিদ্যমান।
আমরা যখন আমাদের জীবনের হিসাব মেলাতে শুরু করি তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। বিশেষ করে আমাদের যখন ভাবা উচিত তখন ভাবিনা। যেমন আমি, এখনও জীবন সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন অবস্থানে বসবাস করছি। আমি নিজে থেকে কখনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের কথা ভাবিনি, কিন্তু মা বাবা ছোট বেলায় আমাকে নিয়ে একটা লক্ষ্য এবং স্বপ্নের কথা ভাবতেন। যখন আমি পূর্ণাঙ্গ বয়সে পৌছে গেছি তখন মা বাবার স্বপ্নকে দু:স্বপ্নে পরিনত করেছি। আমি পঞ্চাশ পার করেছি তাও আবার কবছর হয়ে গেছে, কখনও ভাবতেও পারিনি আমার পঞ্চাশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা দরকার আছে। কারন, আমি ভয় পেতাম, এখনও পাই। আমি জীবনের হিসাব মেলাতে শুরু করি।
যাইহোক, এত দর্শন নিয়ে আমি কথা বলবোনা। আসা যাক আমার লেখাটির মুল পটভুমিতে; আমাদের প্রিয়মুখ কবি ও ছড়াকার আবু মকসুদ পঞ্চাশে পর্দাপণ করেছেন। আমি তার উপলব্ধি বা অনুভুতিকে জানার চেষ্টা না করে নিজের মতাদর্শকে উপস্থাপন করছি। এটা আমার মনে হয় তার ক্ষেত্রেও এমন হওয়া অসম্ভব নয়। তাপরও আবু মকসুদের অনুভুতি জানতে পারবো তার নিজের অভিব্যাক্তি থেকে।
একজন কবি আবু মকসুদকে লিখতে গিয়ে মনে হলো; একটি বিষয় ধ্রুব সত্যি আর সেটা হলো, একজন গুণী পেশাজীবী, রাজনীতিক, খেলোয়াড়, নায়ক অথবা বিত্তশালী সবাইকেই অবসরে যেতে হয়। একজন কবি কখনওই অবসরে যাবার সুযোগ নেই, কেবলমাত্র মৃত্যুই তার কাব্য শিল্পের পরিপন্থী হতে পারে। একজন কবি তার জগতে সরোব আজীবন। সময় কবিকে আরো বেশি করে কাব্যশক্তিতে উদ্দীপ্ত করে তুলে। একজন কবি চিরঞ্জীব আর কবিতা তার অমৃত, যাহা তাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে আত্মতৃপ্তি জোগান দেয়। জাগতিক বিশ্বের বিমোহন একটি বিষয় হচ্ছে কাব্য আর তার প্রাণেশ্বর হলেন কবি। তাই একজন কবিকে কোনভাবেই বিদ্বেষী অর্থবহ এমন কোন শব্দ তার পরিপূরক হিসাবে আগ্রাসী হতে পারেনা। একজন কবি মানে প্রত্যয়ের পথে ভালবাসা আর মানবতার প্রতীক হয়ে আলোকোজ্জ্বল। আমরা একজন কবিকে নিয়ে যখন লিখতে চেষ্টা করি তখন সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আমাদের আকর্ষিত করে সেটা হলো তার মৌলিক চিন্তা এবং কর্মেরক্ষেত্র।
আবু মকসুদ। ছড়াকার ও কবি। ছোটবেলায় ছড়া দিয়ে তার সাহিত্যের জগত উন্মোচিত হয় । সম্ভবত তার লেখা প্রথম প্রকাশনা ছড়া গ্রন্থ নটার ট্রেন কটায় ছাড়ে, এবং দীর্ঘ প্রায় পনেরো ষোল বছর আগের সেই গ্রন্থের একটি ছড়ার কটি লাইন আমার সব সময় মনে পড়ে যেমন:
খুন আর ধর্ষণ
রাহাজানি ছিনতাই
স্বপ্নের দেশে কাটে
বিপদের দিন তাই।
নেতা আসে নেতা যায়
দিন সেই এক
সুবচন বাণী ঝাড়ে
ধরে সাধু ভেক।
(নেতা চাই)
আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোকে একটি অপরিবর্তিত সাক্ষী হয়ে আছে ছড়াটি। বিশ বছর আগের বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আর সামাজিক অবস্থানের কোন উন্নতি নেই। তারচেয়ে বরং সোস্যাল মিডিয়ার বদৌলতে আমরা যে পরিসংখ্যান পাচ্ছি তাতে অবস্থার অবনতিই বলা চলে।
আবু মকসুদ সেই ছোটবেলা থেকে এমন জীবনমুখী, সংগ্রামী আর সমাজ পরিবর্তনের লক্ষে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। ছড়া আমাদের তাৎক্ষনিকভাবে সরাসরি একটা অবস্থানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সহজ মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। ছড়ার শব্দবলী দ্রুত পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে এবং পাঠক স্মরণ রাখতেও পারে সহজে। যেমন উক্ত ছড়াটি আমি দীর্ঘদিন আগে পড়েছি এবং আজো মনে রাখতে পারছি।
তবে আবু মকসুদ ছড়ায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়েও সাবলীল। বিশেষ করে তিনি কবিতায় পরিপূর্ণতা নিয়ে কাব্যবিকাশের মাধ্যমে একজন শক্তিশালী কবি হিসাবে বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিয়েছেন। আমার জানা মতে কবির অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তারমধ্যে কাব্যগ্রন্থই প্রাধান্য পেয়েছে। আবু মকসুদের লেখা একটি কবিতা যেটি আমার সর্বশেষ পাঠ। আমি জানি এরমধ্যে কবির অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে বা প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়নি, সেটা আমারই দুর্বলতা। তবে আমার পাঠের সর্বশেষ কবিতার কটি লাইন সত্যি মুগ্ধ করে বারবার লাইনগুলো আমাকে তাড়া করে;
এই দীর্ঘ রাস্তা বহুদূর গেছে, রাস্তার সাথে আমরাও
এখন শুধু কড়ি ক্রান্ত জীবন আমাদের, সাইকেল নাই
তাই দখিনের ভেজানো দরজা খোলার জন্য কেউ
দাঁড়িয়ে থাকেনা, আমাদেরও ফেরার তাড়া থাকে না ।
(কড়ি ক্রান্ত মেঘের অতীত)
কি এক অদ্ভুত রকমভাবে দ্যোতনা এবং ব্যাদনাকে মিলিত করেছে, যেন বিসমিল্লা খানের সানাইয়ের সুর স্মৃতির মরু পার করে নিয়ে যায় অতীতে, যেখানে তালাবন্ধ শৈশবের সকল গুপ্তধন। সেই গুপ্তধন খুঁজে পাবার জন্য আরেক জন্ম আমাদের হবার কথা নয়, তাই অতীতের স্মৃতি আমাদের কষ্টের একমাত্র সম্বল।
কবির আরেকটি কবিতার লাইন;
মিহি সুতোয় বোনা নকশী কাঁথারা আমাদের
প্রতিবেশী ছিল, প্রতিবেশী ছিল বাঁশের পাখা
সিথানে মায়েদের হাতের পাখা আমাদের দিত
কাল জলের ডুব, ঘুমের গভীরে তলিয়ে
যেতে যেতে আমরা ভাবতাম তালের পিঠার
সৌরভে আমাদের শৈশব সুরভিত হলেও
একদিন ছাড়তে হবে বাবাদের আঙুল, বড়
হতে হবে পালঙ্কের তুলতুলে বিছানার জন্য…
আমরা পারিনা ওখানে ফিরে যেতে কিন্তু তাড়িত হই, বিষণ্ণতার সাথে আপোষ করে নেই, আমরা কবিতায় সেই বিষাদময় অধ্যায়কে গ্রন্থিত করি, কিন্তু আমরা কতটুকু সার্থক হতে পারি জানিনা, তবে আবু মকসুদ এই কবিতায় সময়ের সাথে একটি অবিচ্ছেদ্য মোহনা তৈরি করেছেন। আমি কবির শৈশব স্মৃতি বিজড়িত কবিতাগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি কারন আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, আমাদের মা বাবারা আজ অন্তিমে অথবা কেউ কেউ পাড়ি দিয়েছেন ওপারে। আজ আমার ভাবনাজুড়ে যে বিষয়টি ঘোরপাক খাচ্ছে সে রকম উপলব্ধি পাচ্ছি কবির এই কবিতাগুলোতে। এ রকম কবিতা আমরা ঠিক এই সময়টায়ই রচনা করি, যখন আমরা কৈশর, যুবক থেকে পৌঢ়ত্বের পানে ধাবিত হই। এখানে দুটো বিষয় কাজ করছে, প্রথমত ৫০ থেকে শুরু করে পরবর্তী জন্মবার্ষিকীগুলোকে গুরুত্ব দেয়া মানে পীঠে দেয়াল এঁটে দেয়া। তারপর হচ্ছে, বিশেষ একট ক্ষমতা আইন প্রবর্তনকারী হিসাবে মনে হয় নিজেকে। ইচ্ছে থাকা সত্বেও দেখা যাবে অনেক বিষয় থেকে বাদ পড়ে যাওয়া এবং বিশেষ একটি গোত্রের সদস্য হয়ে যাওয়া। আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়টা আমরা পার করে এসেছি পঞ্চাশের আগে। তবে পঞ্চাশের পরবর্তী সময়টা আরেকটু কঠিন ও চ্যালেঞ্জিংও বটে। তবে যাইহোক, আমি সম্ভবত কবিকে আমার মত করে উদাসীন করতে চাইনা। আবু মকসুদ আমার থেকে অনেক এগিয়ে আছেন সর্বক্ষেত্রে।
একজন কবি সম্পর্কে আমরা হয়ত আশা করি তার কবিতা নিয়ে আলোচনা হবে, কবিতার মাঠে তার উৎপাদিত শস্য নিয়ে কথা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আমার ভাল লাগার কিছু অংশ শুধু শেয়ার করেছি মাত্র, আমি কবির কাব্য নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছিনা। আবু মকসুদকে নিয়ে লেখার অনেক বিষয় এবং গল্প আছে হয়ত স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত লেখা সম্ভব না। তবে আমার খুব ইচ্ছে আছে হয়ত বিস্তর পরিসরে তার কাব্য নিয়ে কাজ করার।
আবু মকসুদ বিলেতে আসার পরপরই আমাদের মধ্যে আন্তরিকতা, বন্ধুত্ব আর আত্মার বন্ধন তৈরি হয়। আশির দশকে বিলেতে বসে সাহিত্যচর্চার করে আসছেন এমন বন্ধুদের মধ্যে আবু মকসুদ অন্যতম একজন প্রাণপ্রিয় বন্ধু।
কবি পঞ্চাশে পদার্পণ করেছেন, কবির জন্মবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে স্মারক বের হবে। ঘটা করে আয়োজন হবেনা, কারণ করোনা আমাদের রোধ করেছে, করোনা আমাদের উৎসবের সকল আয়োজনকেই প্রতিহত করেছে, করোনার কাছে আজ গোটা মানবজাতি হেরে গেছে, বিজ্ঞান মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, অসহায় পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং তার গঠনতন্ত্র। হাজার বছরের বাঙালিপ্রাণ নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বছরব্যাপী উৎসব, আয়োজনকে পন্ডুর করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের লেখালেখিকে রোধ করতে পারেনি, আমরা সেখানে উৎরে গেছি। তাই আবু মকসুদকে নিয়ে আয়োজন না হোক তাকে নিয়ে লেখার দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাবার কোন অবকাশ নেই।
বিশেষ করে কবি আবু মকসুদ বেশ কয়েক বছর থেকে বিলেতের সমসাময়িক অনেক কবিদের নিয়ে লিখে আসছেন। যেন দায়ভার তিনি নিজেই কাঁধে নিয়েছেন একান্ত আপন করে। তিনি যেন বহুবিধ ছিদ্রকরা সাহিত্য উঠোনটার বুননের কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। আবু মকসুদ মনের দিক দিয়ে বিত্তবান কবি, নৈপুণ্যের বিষয়ে তিনি সুচারু কর্মকার। আমাদের সবারই কম বেশি দায় থেকেই যায় কিন্তু আমরা এড়িয়ে যাই, আমাদের ক্ষমতার বাহিরে সংশয় কাজ করে, আর তার কারণ একটাই আমরা নেহাতই হত দরিদ্র ঈর্ষার ঝুলিটা টাঙিয়ে রাখি কণ্ঠনালী অবধি। সেই জায়গায় দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে চলা মানুষটির নাম আবু মকসুদ। আমি অবশ্য তার শুধু বৈশিষ্ট্যের কথাই বলবো কারণ তার গুণ আমাকে অধিক উৎসাহিত করে। বাকিটুকু আপেক্ষিক!
মানুষ খুব সহজে অনেক কিছু ভুলে যায়, কিন্তু আমরা কখনোই ভুলতে পারিনা অন্যের সুখ-আনন্দের জন্য তার সৃষ্ট কৃতকর্মের কথা, অথবা সেই অনুভূত বিশেষ সময়টির কথা।
প্রয়াত কবি মায়া এঞ্জেলোর একটি কথা মনে পড়ছে যে;
“I've learned that people will forget what you said, people will forget what you did, but people will never forget how you made them feel.”
Maya Angelou
আবু মকসুদ সেই জায়গাটিতে আসীন করে নিয়েছেন নিজেকে। নিজেকে আড়াল করে রাখার প্রবণতা আমার অনেক বেশি, তবে আবু মকসুদ সেখানে অনেক সক্রিয়। মাঝে মাঝে আমাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি তার মৌলিক বিষয়-আশয়ে অনেক অর্গগামী এবং দুরন্ত। আমি সেদিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে। অবশ্য তার সাথে আমার একটি বিষয় খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিলেমিশে আছে আর সেটা হলো চ্যালেঞ্জ। আমি যতখানিনা নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালবাসি তারচেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জকে ভালবাসি। সে জায়গায় আবু মকসুদ একশভাগ দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী।
আমার বিলেত জীবনের প্রথমভাগটায় আবু মকসুদকে এতটা কাছাকাছি পাইনি কিন্তু, সাহিত্যের মাঠে আমাদের বিচরণ পাশাপাশি ছিলো। নব্বুইয়ের দশকে আবু মকসুদ যেন বিশাল প্রান্তর তৈরি ফেললেন। কবি আতাউর রহমান মিলাদ ও আবু মকসুদের সম্পাদনায় প্রকাশিত শব্দপাঠ বিলেতে শুধু না তথা বিশ্ব বাংলাভাষী সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য অন্যতম একটি শক্তিশালী অধ্যায়ের সূচনা। শব্দপাঠকে ঘিরে তখনকার সময়ে সাহিত্যের আড্ডাটা ছিলো একটা ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। নানা ব্যাস্ততাকে উপেক্ষা করে শব্দপাঠ পরিবার আয়োজন করতে থাকে কবিদের নিয়ে আড্ডা। আর সেই সকল আয়োজনে আবু মকসুদ ছিলেন প্রধান ভূমিকায় তৎপর।
আমরা প্রশংসা কুড়াতে পছন্দ করি কিন্ত আজকের দিনে প্রশংসা করার মত মানুষের অভাব খুব বেশি। আমরা প্রশংসার চেয়ে সমালোচনাকে বেশি প্রাধান্য দেই। আমরা সামগ্রিক বিষয়ের চেয়ে ব্যাক্তিতান্ত্রিক হয়ে যেতে বেশি পছন্দ করি।
কবিরা কম বেশি সবাই অভিমানী হয়ে থাকেন, তবে আমি বোধ হয় একটু বেশি। আমাকে তাগিদ এবং তাড়না দিতে যে কজন বন্ধু সব সময় আমার পেছনে লেগে থাকেন তারমধ্যে আবু মকসুদ একজন অন্যতম বন্ধু।
আশির দশকের মাঝামাঝি এবং নব্বুইয়ের প্রথম দিকে বিলেতের সাহিত্যাঙ্গন ছিলো যথেষ্ট সরোব। তখনকার সময়ে আমাদের মধ্যে ঈর্ষা কাজ করেনি, আমরা তরুণ ও প্রবীণ মিলে ছিলাম একাকার, শিকড়, সংহতি, শব্দপাঠ, বাংলা সাহিত্য পরিষদ মানে আমরা সবাই যেন ছিলাম একই নাওয়ের যাত্রী। আমাদের সেই সময়গুলো ছিলো সংশয়হীন, ঈর্ষাহীন এবং যথেষ্ট আন্তরিক।
আমি আগে বলেছি আবু মকসুদকে নিয়ে লেখার অনেক বিষয় আছে, তার গুনগত দিকগুলো আমাকে প্রায়শ্চই নাড়া দেয়, মাঝে মাঝে ভাবি তার মত হতে পারলে মনে অনেক কাজ করতে পারতাম। তিনি যে বিলেতের বিশেষ বিশেষ কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে ক্রমশই লিখে যাচ্ছেন সেটা যে কতবড় বিষয় সেটা নিতান্তই একজন মহাত্মন ছাড়া বুঝবেনা।
আমরা একসাথে অনেক কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, নানা অনুষ্টান, আড্ডা ছাড়াও সংহতির কবিতা উৎসবকে কেন্দ্র করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমরা কাজ করেছি। আমাদের বাংলা ব্লগ নিয়ে আমাদের এক সাথে কর্ম যাত্রার যে শুরু হয়েছিলো সেটা যদিও একটা সময় এসে থমকে গেছে নানা প্রতিকূলতার জন্য তবে আমাদের বাংলা বিলেতের সকল কবিদের শুধু না পৃথিবী নানা দেশের কবিদের একটি বিশেষ প্লাটফর্মে নিয়ে এসেছিলাম। সেদিনও প্রসঙক্রমে আমরা সে কথাটা্ই আলোচনা করছিলাম, যদি আবার আমাদের বাংলাকে দাড় করানো যায়। এই প্রসঙগুলো নিয়ে আসার একটিই কারন, আবু মকসুদ। আবু মকসুদ পরিশ্রমী। বিশেষ করে সাহিত্যের পরিমন্ডলে তিনি সবসময় একই রকমভাবে সক্রীয়। বিলেতের সাহিত্যের অবস্থান বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের পরেই স্থান তাই আমরা এই জায়গাটিকে তৃতীয়বাংলা হিসাবে আখ্যায়িত করি। আর এই তৃতীয়বাংলার নান্দনিক সাহিত্যের পরিবেশ তৈরী করতে আবু মকসুদের অবদান নি:সন্ধেহে সামনের সারিতে। আমরা সব সময় প্রশস্ত রাস্তায় হাঁটতে পছন্দ করি, পন্কিল রাস্তা কারোরই পছন্দের না। কিন্তু এই তৃতীয়বাংলার পন্কিল সরু রাস্তাকে যাদের মাধ্যমে প্রশস্ত হয়েছে তাদের মধ্যে আবু মকসুদ একজন সার্থক শ্রমিক। আমি সবশেষে একটি কথাই বলবো। আবু মকসুদ বয়সের হিসাবে তিনি পঞ্চাশ হলেও তিনি এখনো পূর্ণাঙ্গ যুবক। আমি তার সার্বিক সুস্বাস্থ্য কামনা করি। কবির দীর্ঘায়ু কামনা করি। সাথে সাথে আমরা যেন আরো কটা দিন এক সাথে সাহিত্যের জন্য কাজ করে যেতে পারি। শুভ জন্মবার্ষিকী কবি।
কবি আবু মকসুদঃআমাদেরই লোক
দিলু নাসের
নদী যেখানে জীবনের গান শোনায় ,ভোরের সূর্য কণা কণা রোদ ছড়িয়ে যেখানে বয়ে আনে জীবনের প্রাচুর্য। যেখানে কান পাতলে শোনা যায় নদী আর মানুষের কান্না, মাঝিমাল্লাদের বিচিত্র কোলাহল সঙ্গীত, দেখা যায় ধনুকের মতো মানুষের দীপ্ত জীবন আর ঘর্ম রিক্ত পিঠ। যেখানে মনু নদী বাঁক নিয়েছে ,আর অন্য পাশে সবুজে সবুজময় চা বাগান, উচু-নিচু পাহাড়ের সারি,দিগন্ত জোড়া ধান ক্ষেত,জল থৈ থৈ হাওর। সেই অপরূপ সৌন্দর্যের রূপ অঙ্গে মেখে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের কিছু দিন আগে, আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের সেই হিরণ্ময় কালে মিছিল মিটিং আর শ্লোগান মুখর উত্তাল সময়ে,সুন্দরের অনন্ত তৃষ্ণা বুকে নিয়ে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলো তার নাম আবু মকসুদ। আমাদের সকলের প্রিয় বহুমাত্রিক লেখক কবি আবু মকসুদ।
তার জীবন চলা শুরু হয়েছে সবুজ স্নিগ্ধ ঘাসে পা ডুবিয়ে। শিশির ভেজা ঘাসের অনন্ত সুখের ছোঁয়া শিহরণ জাগিয়েছে তার কচি হৃদয়ে। মনকে মাতাল করেছে সোঁদা মাটি, আর দূর পাহাড়ের বুনো গন্ধ, জোসনা ধোয়া রাত্রি, আর পাখিদের কল কুঞ্জন।
প্রকৃতির অপরূপ হাতছানি ,আলোময় দিন তার হৃদয়ে স্বপ্নের সাঁকো গড়ে, সেই স্বপনীল সুবাসিত সাঁকো বেয়ে জীবনের প্রথম ভোরে শিউলি ফোটা শৈশবেই সে আনমনে পৌঁছে যায় কবিতার ভুবনে। আনন্দে রঙে স্বপ্নে সেই থেকেই সাহিত্যের মায়াবী জগতে মনে মনে তার অভিযাত্রা শুরু।
তার উন্মেষ কালে নিজ গৃহে ই ছিলো শব্দের ঝংকার, ছন্দের তাল,এই তালে আবু মকসুদ দোলায়িত হয়েছে নিজের অজান্তে।
তার অগ্রজ আবদুল হামিদ মাহবুব তখন ছড়ার মাঠে খই ফোটাচ্ছেন নিয়মিত। আর তার ছড়া আন্দোলিত করে ছোটভাই মকসুদকে। তাই বলা যায় আবু মকসুদ সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেছেন বড়ভাইয়ের পদাংক অনুসরণ করেই।
তার বিকাশ লগ্নে দেশ জুড়ে ছিলো রাজনৈতিক অস্থিরতা ।সন্ত্রাস- হানাহানি, সারা দেশ ছিলো স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনে বিক্ষুব্ধ-অস্থির। সেইকাল ছিলো মিছিলের , শ্লোগানের। তাই কিশোর আবু মকসুদ স্বাভাবিক ভাবেই সে সময় দেশপ্রেমে আন্দোলিত হন। সারা দেশের লেখক সমাজ এবং সতচেতন নাগরিকেরা যখন স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছেন তখন কিশোর মকসুদও বসে থাকেননি । তিনিও হাতে কলম তুলে নেন ।সেই ধোঁয়াচ্ছন্ন সময় এবং মিছিলের কথা গুলো আপন মনে ছন্দাবদ্ধ করেন । বাংলা সাহিত্যের প্রধান বাহন ছড়া দিয়েই সেই উত্তাল সময়ে সাহিত্যে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাই তার সে সময়ের লেখা গুলোতে মানুষের চিন্তা চেতনা শানিত ভাবে ফুটে উঠেছে। ছড়া শুধু ঘুম পাড়ানীর মন্ত্র নয়, ছড়া ঘুম তাড়াবার যন্ত্র। এই শ্লোগানকে বুকে ধারণকরে ঝরঝরে ভাষা, প্রখর কল্পনা শক্তি, এবং তীক্ষ্ণ জীবন দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে চলেন আবু মকসুদ।
শিশুতোষ বিষয় ছাড়াও সে সময় তিনি অনায়াসে তাঁর শিল্পমাধ্যম ছড়ায় তুলে আনেন সমাজের অনেক অসঙ্গতির চিত্র। অত্যান্ত সহজ সরল ভাবে তার রচনায় তিনি উপস্থাপন করেন জীবন বোধ এবং সাধারন মানুষের আশা আকাংখাকে।সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলার সাহস সঞ্চয় করেছেন তিনি অল্প বয়সেই।
তার প্রথম ছড়াগ্রন্থ "ন'টার ট্রেন ক 'টায় ছাড়ে" এই নাম করণের মাধ্যমে তিনি সমাজে জিজ্ঞাসা তৈরী করেন।
সেই গ্রন্থেই অনেক ছড়ায় তিনি পাঠককে বুঝিয়ে দেন ছড়া শুধু শিশুতোষ বিষয় নয়। ছড়া প্রতিবাদের ভাষা।বুলেট বোমা এবং আনন্দ বেদনার চারুপাঠ। বাঙালির মহান ভাষার লড়াই, হিরন্ময় মুক্তিযোদ্ধ, এবং নব্বই এর স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন, ক্ষমতার মোহ, গণতন্ত্রের নামে স্বেচ্ছাচারিতা ,স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্তান, রাজনৈতিক অস্থিরতা তার অনেক ছড়ায় চমৎকার ভাবে চিত্রিত হয়েছে। পাঠক দেখেছেন তার ছড়ার বক্তব্য কখনও সরল কখনও বা ঝলসে ওঠা বারুদের মতো ।
আবু মকসুদ শুরু থেকেই তার পারিপার্শিকতা নিয়ে ভাবতেন,তাই তার কাব্য চর্চার মূল সুর জীবনবোধ এবং মানবতাবোধ। তিনি আজন্ম নিপীড়িত মানবতার বিবেকী কণ্ঠ।
দেশপ্রেম এবং মানব প্রেমে তিনি প্রত্যয়ী।
ছড়ার মাধ্যমে তিনি সাহিত্য জগতে প্রবেশ করলেও গত তিন দশকে বাংলা সাহিত্যের সব গুলো ক্ষেত্রেই তার অবাধ পদচারণা। কবিতা , গল্প, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্যের মাধ্যমে তিনি দেশে বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেও একজন বলিষ্ট কবি হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন বেশী । দীর্ঘ দিন থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ সহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত বাঙালীদের কাছে প্রতিশ্রুতিশীল বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে তিনি সমাদৃত।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ- নটার ট্রেন কটায় ছাড়ে (২০০৪ সাল), মিথ্যাবাদী রাখাল ছেলে (প্রথম প্রকাশ ২০০৫ সাল, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৮ সাল), একটি গুলি (২০০৬ সাল), দূরতর গ্রহ জীবন (২০১০ সাল), ক্রমাগত ঘুমের উনুন (২০১৩ সাল), খনিজ ভুলের কাছে জমা রাখি জলের মোহর (২০১৩ সাল), মৃত্তিকার মেঘলা ভ্রমণ (২০১৪ সাল), পাশে রেখে শুদ্ধ শিশির (২০১৫ সাল), আহত ঐতিহ্যের নদী (২০২০ সাল)। সম্পাদনা গ্রন্থ- বিলেতের ছড়া (২০০২ সাল), তৃতীয় বাংলার কবি ও কবিতা (২০০৯ সাল)।
মনু, সুরমা ,কুশিয়ারা খোয়াই সহ অসংখ্য নদ-নদীর সাথে তার যেভাবে হার্দিক সম্পর্ক তেমনি বাঙালী এবং বাংলাদেশের জনমানুষের জীবনবোধের সাথে ও তার রয়েছে গভীর অন্তরঙ্গতা ।তাই সুদীর্ঘকাল থেকে এই ভিন্ন দেশে ভিন্ন মাটিতে বসবাস করেও তার কাব্য এবং অন্যান্য রচনায় অনায়াসে ওঠে আসে বাংলাদেশের সমসাময়ীক সামগ্রিক চিত্র। দেশের প্রতিটি দুর্যোগে, দুর্দিনে আনন্দ- উতসবে তিনি তার শিল্প মাধ্যমে চিত্রিত করেন গণমানুষের হাসি-কান্না আনন্দ বেদনা। তুলে আনেন সমাজের অবক্ষয়, মুল্যবোধের সংকট, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক নৈরাজ্যের চিত্র।তার কাব্যকলা দেশ, মাটিও মানুষের একাত্মতায় সম্পৃক্ত।
তাঁর রচনায় দেশ - সমকাল -সামাজিক অনুসঙ্গ যেভাবে আছে তেমনি প্রেম ভালোবাসা এবং ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ -বিষাদ ও ব্যর্থতা উচ্চকিত। তিনি খুব সহজ সরল ভাষায় তার ভাবনা গুলোকে পাঠকের জন্য তুলে ধরেন। পাঠকে চমকে দেবার মতো উচ্চ বিলাসী বিষয় তার কাব্যে মিলেনা। অধুনা অনেক কবির মধ্যে দেখা যায় তাঁরা যতটা না কাব্যের ভাব সৃষ্টি তে প্রয়াসী তার চেয়ে বেশি আগ্রহী নতুন নতুন কঠিন শব্দ সংযোজনের প্রতি। অনেকে খামোখাই জড়িয়ে পেঁচিয়ে সৃষ্ট ধুম্রজালে ভাবকে অস্পষ্ট করে তুলেন ।ফলে পাঠক এবং কবির মধ্যে ইদানীং সৃষ্টি হচ্ছে দুরত্ব, যা কোন কবির জন্যই সুখকর নয়। কিন্তু কবি আবু মকসুদ সে দলের কবি নন। তার কবিতায় কোথাও অবয়ব কে চাপিয়ে উঠেনি অলংকরণের দৌরাত্ম্য। একান্তই আটপৌরে শব্দ ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে এই কবি কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টি তে সদা একনিষ্ঠ। কবিতার শব্দ চয়নে উপমা প্রয়োগে অথবা জীবনের রূপকল্প নির্মাণে তার রয়েছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।
কাব্য সৃষ্টির প্রেরণা এই দূরদেশে তাকে বিনিদ্র রাখে
এই ভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিবেশে সাদা কালো মানুষের ভীড়ে কবিতার জন্য তিনি নিস্পলক।তাই প্রবাসজীবনে এতো ব্যস্ততার মাঝে তিনি প্রতিনিয়ত সাজিয়ে যাচ্ছেন শব্দের পসরা।
তার রচনার অনেক চরণ আছে যেগুলো আমাদেরকে শুধু ইতিহাসও ঐতিহ্য বোধেই সচেতন করেনা বরং মনও মননে মিথ্যা, অন্যায় , অবিচার ,ভ্রষ্টাচার, নিপীড়ণ ,জীবনও সমাজের ক্লেদও কিন্নতার বিরুদ্ধে শানিত তরবারির মতো কাজ করে।
আবু মকসুদ স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক দালাল রাজাকার আল বদর, সাম্প্রদায়ীকতাও বর্ণবাদের বিরুদ্ধের এক বলিষ্ঠ কলম সৈনিক ।
আবু মকসুদ তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ লগ্নেই দেশছাড়া হন জীবন এবং জীবিকার তাগিদে। স্থায়ী আবাস গড়েন সাত সাগর তের নদীর পার আলো ঝলমল লন্ডনে।কিন্ত এখানে এসে অন্যদের মতো তিনি হারিয়ে যাননি ।লন্ডনের চাকচিক্যময় জীবন সাদাকালো বাদামী মানুষ আর গগনচুম্বী অট্রালিকার ভীড়ে তার সমবয়সীরা যখন ম্যাডোনা জ্যাকসনের গান আর পাশ্চাত্যের জীবনধারায় গা ভাসিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন তিনি বুকে স্বযত্নে পুষেছেন রবীন্দ্র .নজরুল .শামসুর রাহমান. সুনীল .আল মাহমুদ সৈয়দ হক কবি দিলওয়ার। অচেনা শহরের জনারণ্যে কবিতার খোঁজে কাটিয়েছিন বিনিদ্র রজনী। আলো ঝলমল টেমসের পারে বসে রোমন্থন করেছিন পদ্মা মেঘনার কলতান। গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ রমনার বটমূল আর বাউলের একতারা তাকে হাতছানি দিয়েছে বারবার, তাই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় আর তুষার বৃষ্টিতেও তার হৃদয়ে ফুটে উঠেছে হাসনোহেনা,রজনীগন্ধা , জুঁই-চামেলি আর রক্তকরবী। সেইসব পুষ্পসুবাস তার প্রবাসী জীবনযাপনকে আলোকিত করেছে। তাই এই ভিন্ন মাটিতে তিনি বাংলা বর্ণমালা চাষে নিমগ্ন হয়েছেন।
যে আলো তিনি পদ্মা,মেঘনা সুরমা,যমুনা এবং মনু নদীর অববাহিকা থেকে ধারণ করেছিলেন সে আলোয় তিনি এখানে নিজের পথ তৈরী করেন।
এখানে এসেই তিনি যুক্ত হন পূর্ব লন্ডনের বাঙালী সাহিত্য কর্মীদের সাথে।তার সাথে আমার পরিচয় সে সময় থেকেই। চিন্তা চেতনার মিল থাকায় শুরু থেকেই হৃদ্যতা গড়ে উঠে।তাছাড়া তার অগ্রজ ছড়াকার আবদুল হামিদ মাহবুবকে আমি চিনতাম এই সুবাদে মকসুদ আমাকে প্রথম থেকেই ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। লন্ডন তখন বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির বিরাণভুমি। সেসময় সদ্য দেশ থেকে আসা যে কজন তরুণ এই ভিন্ন দেশে ভিন্ন মাটিতে অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছেন মকসুদ তাদের সহযোদ্ধা।
গত তিন তিন দশকে তৃতীয় বাংলায় সাহিত্য সংস্কৃতির সকল সফল কর্মকান্ডে তিনি অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছেন। তার সম্পাদিত ছোট কাগজ শব্দপাঠ দেশে বিদেশে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ব্যাক্তি আবু মকসুদ সহজ সরল এবং স্পষ্টবাদী।যা বলার তা সরাসরি বলতে ভালোবাসেন তিনি। দীর্ঘদিন একসাথে অনেক কাজ করেছি আমরা। মকসুদ বন্ধু সুলভ সদালাপী। তাই সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের সবার সাথে তাঁর হৃদ্যতা। একসাথে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় মতের অমিল হয়েছে । মনোমালিন্যও হয়েছে। কিন্ত মকসুদ তার মনের ঔদার্য দিয়ে আমাদেরকে বারবার ভালে্বাসায় আবদ্ধ করেছেন। দীর্ঘদিনের সম্পর্কে আমাদের সকলের মনে যে ভালোবাসার সাঁকো তিনি তৈরী করেছেন তা জন্ম জন্মান্তর সুদৃঢ় থাকুক।
আপাদমস্তক এই কবি এবং প্রকৃত বাঙালি ডায়াসপুরা লেখক আবু মকসুদের আগামী দিন হোক কুসুমাস্তীর্ণ। তার অর্ধশত জন্মতীথিতে আমার এটাই কামনা। প্রিয় কবির আয়ুস্মান হোক শতবর্ষ।
কবি হিসাবে তার খ্যাতি আর সুনাম ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়। তার জয় মানে আমাদেরই জয়, কারণ কবি আবু মকসুদ আমাদেই লোক।
কবিতায় নস্টালজিয়ার স্থপতি : কবি আবু মকসুদ
মোহাম্মদ ইকবাল
স্বপ্নের মনু নদী যাঁঁর বুক দিয়ে হেঁটে যায় তিনি কবি আবু মকসুদ
"মনু নদীর পাড় দিয়ে বহুকাল আগে হেঁটে গেছি
অনন্তকাল পরেও মনু নদী আমার বুক দিয়ে হেঁটে যায়......."
অসাধারণ পঙতি দুটির স্রষ্টা বিলেতের সাহিত্য পড়ার খানদানি কবি ছড়াকার শব্দপাঠ সম্পাদক অনুজপ্রতিম আবু মকসুদের।
কবিতা; "প্রথম প্রেম"
কাব্যগ্রন্থ ;"আহত ঐতিহ্যের নদী।"
ক্ষ্যাপাটে এই কবির সাথে পরিচয়ের গল্প;
বিলেত পাড়ি জমানোর সিলভার জুবিলিটাও পার হয়ে এসেছি, অবসরে আমার আমিকে যখন ভেঙ্গেচুরে বিশ্লেষণ করি তখন স্পষ্টতই দেখি শ্রেষ্ঠত্বের ভান কিংবা হীনমন্যতা আমাকে চরমভাবে ভোগাচ্ছিল জীবনের বেশ কিছুটা সময় এবং সেই সময়টা ছিল দেশ থেকে বিলেত পাড়ি দেয়ার সময়। আমাকে নিভৃতচারী বলে অনেকেই জেনে থাকবেন, সামাজিক যোগাযোগ ছিল ভীষণ রকমের সীমিত একে কোনও কোনও মনোবিজ্ঞানী মানুষিক বিকারগস্ততার পর্যায়েও ফেলে থাকতে পারেন। আমার আমিকে সেই মানুষিক স্থিতাবস্থা থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসি বড় জোর ছয় কিংবা সাত বছর আগে তখন হঠাৎ করেই কবিতার পুরনো ভূত নতুন করে ঘাড়ে চেপে বসে। তবে শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনে কবিতা লেখার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আমার অর্জনে ছিলনা আমি বিজ্ঞানের ছাত্র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ লেখা পড়া তাই কবিতাকে বুঝতে গিয়ে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে বিলেতের সাহিত্য পড়ার সুহৃদের সাথে তাঁদের মধ্যে অন্যতম অনুজপ্রতিম কবি এম মোসাইদ খাঁন, কবি একেএম আব্দুল্লাহ্, কবি আবির ইসলাম, শামীম আহমদ সহ আরো অনেকে, এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিলেতের সাহিত্য সংস্কৃতির আলিতে গলিতে পথ চলেছি, যথাসাধ্য অবদান রাখার চেষ্টাও ছিল এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরিচয় ঘটে কবি কথাসাহিত্যিক আবু মকসুদের সাথে তাঁর সাথে সামাজিক গণমাধ্যমে পূর্ব পরিচয় থাকলেও প্রথম সাক্ষাৎ "আমাদের বাংলা" ব্লগের কবিতার অনুষ্ঠানে। সদালাপী বিনয়ী সহজে যে কারো হৃদয়ে তিনি স্থান করে নিতে পারেন। তাঁর সাহিত্য কর্মের বিশ্লেষণে আমি যবো না সেই প্রতিষ্ঠানিক ক্ষমতাও আমার নেই তবে যে বিষয়টি তাঁর ব্যাপারে আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়েছিলো সেটা তাঁর নীতিতে অটল থাকার নীতি। আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করছি প্রয়োজনে তিনি একাই লড়ে গেছেন তবু হার মানার পাত্র তিনি নন এই বিষয়ে ডজন খানেক উদাহরণ সংযুক্ত করে দিতে পারি যাঁরা আবু মকসুদকে জানেন তাঁরা আমার সাথে অকপটে সেটা স্বীকার করে নেবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেখানে মুখ খুলতে ভয় থাকে সেখানেও আবু মকসুদের হুংকার সিংহের মতোই তাঁর অন্যায় এর সাথে আপোষহীন নীতিতে অবিচল থাকার কারনে সামাজে তিনি বিশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। মতদ্বৈধতা বা মতভেদ সমাজের সব জায়গায়ই কমবেশি বিদ্যমান, তবে আবু মকসুদকে সকল সময়ই একজন মধ্যস্থতাকারীর ভুমিকায় অবতীর্ন হতে দেখেছি।
তাঁর আবাসস্থল লন্ডন থেকে শেফিল্ডের চলে যাওয়ায় আমারা তাঁর অভাবের পীড়ন ভীষণ ভাবে অনুভব করি। বিলেতের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে যারা এগিয়ে নিয়ে এই পর্যায়ে দাঁড়া করিয়েছেন আবু মকসুদ তাঁদের অন্যতম। আমি তাঁর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর দীর্ঘায়ু সুন্দর পারিবারিক ও সামাজিক জীবন এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করি।