কবি ও কবিতা
কবি কামরুন নাহার রুনু
জন্ম বাংলাদেশের হবিগঞ্জ শহরে। কবিতা লেখা, আবৃত্তি, জলরঙে ছবি আঁকা, ছোট গল্প এবং গান লিখে আসছেন দীর্ঘদিন, তবে কবিতায় তিনি সাবলীল। বিএ পাশ করার পর থেকে দেশের বাহিরে আছেন। গত ৩০ বছর তিনি আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রতি তাঁর মন ও মননে নাড়ির টান যার প্রতিফলন হচ্ছে কবির সাহিত্যের নানা বিষয়ে একনিষ্ঠ বিচরণ। তাঁর কবিতায় শৈল্পিক বিষয় পাঠককে সহজে নাড়া দেয় বলে তিনি অল্প সময়ে সাহিত্যাঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষ্ম হয়েছেন।
এযাবৎ কবির ৭টি একক কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়াও বেশ কিছু সম্পাদিত সংকলনেও তাঁর লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৮ সালে প্রথম কবিতাগ্রন্থ বৃত্তের আবর্তে প্রকাশিত হয় এবং তারপর অনুভবে আমন্ত্রণ, বোতাম খোলা বিষণ্ণ বিকেল, এসো বৃষ্টি নামাই এবং গাঙ ফড়িঙের ডানা সহ নির্বাচিত ১০০ কবিতা ও একটি সাঁকোর দীর্ঘশ্বাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
ক্ষুধা
হে অনন্তকাল...
হে জল, বায়ু, অগ্নি...
আমার কোন রঙ কিংবা গন্ধ নেই
এ ক্ষয়িষ্ণু জীবনে আমার ক্ষুধা নেই, নেই আত্মাভিমান!
ক্রমশই ম্রিয়মাণ আমি ক্ষুধা শব্দের খুব কাছাকাছি গিয়ে দেখেছি
ও গাঁয়ে কোন মোলায়েম জীবন নেই
ওকে উলট-পালট করে দেখেছি
যেদিক থেকে দেখি তার আকৃতি কেবল ক্ষুধা !
এতোটাই রুক্ষ যে মনে হয়, বুকে কাঁচের কোনো ক্ষত
পুরানো এই শব্দটা বড় হিংস্র , বড় স্পর্শকাতর
সে উচ্চারণে যতোই ছোট, ততোবেশী ধারালো !
ও শুধুই একই নামে পরিচিত
ক্ষুধা...
কিংকর্তব্যবিমুঢ় (বিচ্ছিন্ন পঙক্তিমালা)
ক)
এখন আর ভাসাইনা শৈশব কাগজের ডিঙিতে
বাতাস কাঁপানো হাসিতে প্রতিধ্বনিত হয়না সময়ের চিলেকোঠা
মূলত সময় পাইনা সময় কাটানোর
অবলীলায় চলে যায়;
জীবনের খাড়ি খাড়ি সিলেবাস মুখস্থ করতে করতে
অর্ধেক অভিধান ছিঁড়ে গেছে, চলছি নতুন শব্দকোষের সন্ধানে
নেপথ্য ঘটনার নাভিমূলে কি ছিলো মূল ঘটনা; তারই জের ধরে
চলছি প্রত্যুষ হতে রাত অবধি...
খ)
প্রতিদিন নিত্য ব্যবহার্য চিরুনির মতো
নিজেকে গুছিয়ে নেবার অভ্যেস করার চেষ্টা করেও
অপারগ হই বারবার...
গ)
ভাবছি এবার মাটির স্পর্শে পা ভেজাবো
জুতো জুড়াকে দেবো বিসর্জন
নিজেকে চিনে নেবার শেষ চেষ্টাটুকু না হয় আর একবার করি!
ঘ)
গাছেরও আবরণ আছে, রোদ-উত্তাপ সয়ে নিতে জানে
হাঁড়িকেই কেন পুড়ে পুড়ে দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা?
ভাগ্যিস দীর্ঘশ্বাসগুলো কেউ দেখতে পায়না
নয়তো প্রতি সেকেন্ডে স্বর্গচ্যুত হতো বিশ্বাসী নিশ্বাসের।
অনুভব
জেনে গেছে ইন্দ্রলোক...
খরাপুড়া রোদেও ফলে চন্দন-সুরভি!
জেনে গেছি আমি .........
তুমিই সেই অচেনা অনুভব, যাকে ঘিরে ক্রমশই দ্যুতি ছড়ায়
কৃষ্ণচূড়ার লালরঙ, অরণ্যের সীমানা জুড়ে ছড়ায় এতোটা সবুজ, এতো হাসি,
এতো সরব ভালোবাসা!
এ অনুভব জীবনীশক্তি বাড়ায়, অদৃশ্য বিষণ্ণতায় খুঁজে পায় সোনালি খামে পুরা
এক টুকরো হলুদ বিকেল।
ওগো সারথি...
আজ অমরাবতী ভরে গেছে সব বিশ্বাসী মায়াফুলে।
একান্ত নিজের সাথে
ফিরে দেখি, ব্যক্তিগত আলো-আঁধার!
যেখানে অধরা কবিতারা নতুন কুঁড়ি ফোটানোর দায়ে
ক্রমাগত জাগিয়ে রাখে দিন-পরিক্রমা!
সময়ের জটিলতা পেরিয়ে গলা বাড়িয়ে রাখে
নৈঃশব্দ্য সঙ্গমে;
আমি গোধূলি পাড়ের নক্ষত্রে বুনে যাই
একাকী অক্ষর...
যতটা জীবন দেখি ততোটা মানুষ দেখিনা
বয়সের ফ্রেমে কেবল অন্ধের হাট-বাজার!
মাটির শরীরে ইটের প্রস্তর গাঁথা;
ওরা কঙ্কাল; রাত্রির অন্ধ দ্রাঘিমায়
মৌসুমি পাখিদের ভিড়ে
দু-দণ্ড নিশ্চয়তা খোঁজে নশ্বর জীবনে।
শুভকামনা
উঁচু –নিচু ঢেউ মেপে প্রশ্নবিদ্ধ করো না নদীকে
প্রবাহিত জল তার অন্তর্ভেদী চোখে রেখেছে কান্না চিরকালের
কখনও কি তাকে বলতে দেখেছো, কেঁদেছি!
গাছের বদান্যতায় যেমন শিখেছি ছায়াবোধ আনন্দ প্রবোধ
আমরাও তাই শিশুর নরম গালের মতো,বিশুদ্ধ ভাবনার মতো
চলো হয়ে যাই শুদ্ধ চারাগাছ!
যদি ঝেড়ে ফেলি যাপনের সব দুখ
বাকি থাকে কেবল সুখ
এমনি নিজস্বতায় বুনে নেই চারপাশ, ছুঁড়ে ফেলি সব জিজ্ঞাসার অসুখ
একদল পিচাশ যখন মানুষের পোষাকে মানুষেরই মুণ্ডু খাচ্ছে
আমরা তখন হয়ে যাবো ধানের মঞ্জুরির মতো সুহাস্য ভালোবাসা
একমুঠো উজ্জ্বল পূর্ণিমা হয়ে নাহয় আলো দিয়ে যাবো
প্রতিটা ভ্রু কুঁচকে থাকা সন্ধানী চোখে!
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ছিটকে পড়েছে যেটুকু মুগ্ধতা
আমরা না-হয় তাতে পুঁতে দেবো রাশি রাশি শুভকামনা।
অগ্নি পুরুষ
বুকের ভেতর পৌষের হিম কথা ডিঙ্গিয়ে
দেয়ালে ঝুলানো বর্ষপঞ্জিকায়
উপন্যাসের প্রারম্ভে তোমার শুরু;
তুমি মিশে থাকো-
মানুষের সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে,কচি পাতার গন্ধে,
মুহুর্মুহু রোদ্রঘ্রাণ ছড়াও চিকচিক বালুচর ঘিরে
রুক্ষ মেজাজি তুমি;
চঞ্চল, ঈশান কোণে ঝড়ের তাণ্ডব
উদোম হাওয়ায় উষ্ণতর প্রত্যাশার চিরকুট!
বটের ছায়ায়-
পুরনো শিকল ছেঁড়া আদিম পুরুষ!
মিশে থাকো মানুষের স্বপ্ন ও আমিষে, জল ও ঝড়ে,
তোমাকে ঘিরেই,
কৃষকেরা মগ্ন হয় উৎসুক প্রার্থনায়!
কৃষাণী পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে
উঠোনে ছড়ায় সদ্য ভেজা চুল।
তুমি বাসনার তীক্ষ্ণতায় আগত সন্তানের খুব চেনা মুখ,
তোমাকে আলিঙ্গন করি কল্প-সংগীতে,
মানুষের অঙ্কুরোদগমী বাসনায়
অগ্নি পুরুষ-
তোমাকে ঘিরেই উপন্যাসের পৃষ্ঠা শুরু।
অপ্রস্তুত
জীবন বড়ই অপ্রস্তুত যখন;
আত্মা মরে যায়!
চায়ের উষ্ণতাও তখন গলায় কাশী বাঁধায়
সময়সমগ্রে এখন জ্বর জ্বর ভাব
শীতনির্ধারিত প্রহর;
বসন্তেও ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে সন্ধি করে
কাঁচা আম ভাবতেই যতই টকস্বাদ ভাবি
আজকাল লেহনে কিংবা চর্বণে নেই
সুস্থ জিব্বার আলোড়ন!
বাহিরে বাহিরে গোলাপের উচ্ছ্বাস চোখে পড়লেও
ভেতরে তার খোকলা একেলাপনা !
মূলত জীবনের ডায়েরীতে ঝুলছে অসংখ্য প্রশ্নোত্তর পর্ব
তার মূল উত্তর জানে বহুকাল থেকে মাটিতে মিশে থাকা
গাছের ছায়ারা;
মানুষ ভুলে যায়
শেষ উড়ালে নেই ফিরে আসার সম্ভাবনা!
রঙ বদল
যখন মাছেরা
টেনে নেয় পরিধেয়, নিজেকে কেটে কেটে
বানালাম আস্ত কাঠের নৌকা
অনুতপ্ত রাত প্রশ্ন করেনি প্রথম সাক্ষাতে
আমি তখন প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত,
দেখেছি মেঘের গর্জনে কেমন গুটিয়ে নেয়
জলের স্বজনরা!
আকাশের সীমানা থেকে ঝরে পড়ে কিছু কিছু পালক
জলে কিংবা স্থলে বসবাস এক ব্যাপক পৃথিবীর
উল্টেপাল্টে তাকে যতই দেখো;
সবখানেই রুটির মতো চাঁদের ভেতর গড়ায় নীল সবুজ মার্বেল!
ভাবছি দুপাড়ের মাঝে এবার সংসার পাতি,
পাড়াগাঁয়ের সমস্ত রঙ গায়ে মেখে দেখি
কেমন তার রূপ!
জানি, এরই মাঝে পাখিরা রটিয়েছে গুজব!
আমি মাটির বংশধর
তারপর ডুবে যাই অন্ধকারে,
হাতে লেগে থাকে গেরুয়া মাটির গন্ধ!
আপাদমস্তক ভিজে যাই মলাটবন্দি শীতলতায়
মনে পড়ে-
আমি ছিলাম জেলে পাড়ার মেয়ে, ঘোলা জলে মাছের সাথে
আমার ভীষণ ভাব,
আমি যে উলো পাড়ার ভোরের কারিগর,
ধানের শীষ ঠোঁটে বাবার পান্তা ভাতের খোরাক,
আমি গোয়ালা পাড়ার জ্ঞাতি,
আমার জাত-গোষ্ঠী কামার,কুমার,তাঁতি!
ভাষা চাষা-মালকোঁচা, বাউলের দেহাতি সুর, আমার ভাষা
শস্য-লতাগুল্মের সবুজ থেকে সোনালি আভা,
এই গালে-মুখে লেগে আছে মাটির তর্জমা,
আমি মাটির বংশধর-
সুপারির ডালে ধেয়ে আসছে শৈশব,
বন্ধুর যমজ ছায়ায় ভাসছে রোদেলা দুপুর
আমাদের কথাগুলো জমা আছে নদীর কাছে,গাছের বুকে,
আছে মৃত্তিকার প্রতিটা বাঁকে!
জেনে গেছি-
জীবন গোলাপের সপুষ্পক ব্যাকরণ,
আমি এখন কাঁচাসোনা রোদ কুড়াই,
কুড়াই মাটি-ভাষা সময়ের বীজমন্ত্র…
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শিকড়ের কবিদের কবিতায়
স্মরণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি
স্বাধীনতা তোমার সাথে কথা ছিলো ঢের
কামরুন নাহার রুনু
কথা ছিলো অনেক কথা, কথা ছিলো ঢের
মায়ের দুগ্ধ আহারে যে স্বাধীনতা,তার হিসাব দেয়ার কথা নয়
কোন শিশুর!
শীতের প্রকোপে সূর্যের ওম বুকে জড়িয়ে আলোর নির্যাসে নিজেকে জড়ানোর কোন হিসাব কাউকে দেবার কথা ছিলো না কোন পাতা কুড়ানির! তোমাকে পাবার পর, অসমাপ্ত সিগারেটের আগুনে ষোড়শীর সতেজ চেহারা গুচ্ছ গুচ্ছ মৃত ফুলে রূপ নেবার
কথা ছিলো না। তাই, আজ তোমার সাথে ঢের কথা বলার ইচ্ছে আমার!
তুমি হয়তো ধ্বসে যাওয়া বুভুক্ষু শতাব্দীর পাটাতনে চাপা কান্নায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছো; তুমি হয়তো প্রসবকালীন ব্যথা ভুলতে পারছো না, আর অভিমানে আমাদের দিকে তর্জনী নিক্ষেপ করছো। আমিও আজ এই স্বাধীনতার দিনে উনপাজুঁরে স্বপ্ন-ভাঙা ওইসব মানুষের একজন। যাদের স্বপ্ন ও পতাকায় বিষবৃক্ষ জন্মেছে। সময়ের মহা-সড়কের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জায়গা করে নিয়েছে কদর্য শ্বাপদের ঢিবি।
তাই, তোমার সাথে ঢের কথা বলার ইচ্ছে আমার। আমিও চেয়েছিলাম তোমার আগমনে চিরযৌবনা হয়ে প্রতিটা খেটে-খাওয়া মানুষের শ্বেত-সিক্ত ললাটে পরম যত্নে চুমু এঁকে দেবো। আমিও চেয়েছিলাম সময়ের সব ভুল পৃষ্ঠা ছিঁড়ে শুদ্ধ অণুচ্ছেদে নতুন করে জীবনের সংজ্ঞা ও ব্যাকরণ খুঁজে পাব।
স্বাধীনতা তোমার সাথে কথা ছিলো, অনেক কথা, কথা ছিলো ঢের।