কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। আমাদের প্রিয় দুলাল ভাই। শিকড় বেড়ে ওঠার সাথে সাথে আমাদের সম্পর্কের বয়স দুই যুগের বেশি। শিকড়ের জন্মলগ্ন থেকে দুলাল ভাই শিকড় ও আমাদের আত্মার সাথে সম্পৃক্ত একজন আত্মিক স্বজন। শিকড়ের সাথে নানাভাবে জড়িয়ে আছেন, ইদানিং শিকড় ও গ্লোবালের নানা বিষয়ে দুলাল ভাইয়ের সাথে কথা হয় এবং নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আজ কবির ৬৩তম জন্মদিন এবং খুবই সীমিত পরিসরে হলেও শিকড়ের পক্ষ থেকে তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা, শুভ কামনা। শুভ জন্মদিন।
ফারুক আহমেদ রনি
কাছে থেকে দেখা কবি পরিচয়:
কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, জন্ম: ৩০ মে ১৯৫৮, শেরপুর। স্ত্রী: অপি মাহমুদ। দুই কন্যা সন্তান অনাদি নিমগ্ন ও অর্জিতা। পিতা, আলহাজ্ব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, মাতা: সারা শহীদুল্লাহ। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল মূলত কবি হলেও শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করছেন। তাঁর কবিতায় গ্রাম বাংলা থেকে শুরু করে নগরায়ন, নাগরিক জীবন, জীবনের জটিলতা, প্রেম, পরবাস, পরাবাস্তব প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়। বর্তমান বাংলা কবিতার মূলধারাকে তিনি শাণিত করছেন, বাঁক ও বিবর্তনে ভূমিকা রাখছেন। কবিতায় যুক্ত করছেন নতুন টার্ম, নতুন ফর্ম। তাঁর 'তিন মিনিটের কবিতা' গ্রন্থটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি গদ্যের মতো পদ্য নিয়েও গবেষণা করেন। সেজন্য কবিতার বিষয় নিয়ে চিন্তার গভীরে প্রবেশ করেন। মানুষের মনোজগতের অন্তর্নিহিত খনিজ তুলে আনেন ডুবুরির মতো। ফলে দুলালের কবিতা হয়ে ওঠে ব্যতিক্রমধর্মী তথা স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে প্রবাসযাপন করলেও এক মুহূর্তের জন্যেও তিনি শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। বরং প্রবাস জীবনের নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। কখনো কখনো স্বদেশ ও বিদেশের নানা বিষয়আশয় দ্রবীভূত হয়েছে তাঁর কবিতায়; বলা যেতে পারে, তা এক ধরনের চিন্তার অনুবাদ। ছাত্রাবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু। পরে দেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদান। এক সময়ের জনপ্রিয় বিটিভির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’র উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রবাসী বাঙালিদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন নিউজ এজেন্সি ‘স্বরব্যঞ্জন’, সেই সাথে ‘পাঠশালা’র প্রকাশনা। বর্তমানে তিনি সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছেন ।দৈনিক ইত্তেফাকের কানাডাস্থ বিশেষ প্রতিনিধি এবং সাপ্তাহিক বাংলা মেইলের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে দায়িত্বরত আছেন এবং ১৯৭১’ নিয়ে গবেষণা করছেন।
কবি প্রাপ্তি ও পুরষ্কার: সূচিপত্র সাহিত্যপত্রের জন্য তিনবার মুক্তধারা একুশে পুরস্কার ১৯৮৭, ১৯৮৮ এবং ১৯৯২; শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব গ্রন্থের জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার ১৯৯৭, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পদক ১৯৯৬, জাপান থেকে বিবেক সাহিত্য পুরষ্কার ২০০৫, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাব্যশ্রী খেতাব ১৯৭৭ এবং মাইকেল মধুসূদন পদক ২০০৫ সালে। শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্মৃতি পদক ২০১৩ সালে এবং আবু হাসান শাহীন স্মৃতি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৮। আন্তর্জাতিক রূপসী বাংলা পুরস্কার ২০১৮, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম বঙ্গ। সাহিত্য দিগন্ত সন্মাণনা ২০১৯, ঢাকা। প্রবাসে সম্মান ও সংবর্ধনা। ইংরেজি, জাপানি, ডয়েচ, ফ্রান্স, উর্দু, সুইডিশ, হিন্দি ভাষায় তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে/ ভারত-বাংলাদেশের শতাধিক সংকলনে কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধ গ্রন্থিত।
কবির প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৬০টি । কাব্যগ্রন্থ: তৃষ্ণার্ত জলপরী, তবু কেউ কারো নই (নাসিমা সুলতানের সাথে যৌথ), অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো, ফেব্রুয়ারি, শহরের শেষ বাড়ি,, ঘাতকেরহাতে সংবিধান, একি কাণ্ড পাতা নেই, দ্রবীভূত গদ্যপদ্য, ঐক্যের বিপক্ষে একা, ফেব্রুয়ারি ২০০০, ম্যাগনাম ওপাস, মুক্তিযুদ্ধের পঙক্তিমালা, এলোমেলো মেঘেরমন, নির্জনে কেনো এতো কোলাহল, পরের জায়গা পরের জমি, নিদ্রার ভেতর জেগে থাকা, ঘৃণিত গৌরব, কবিতাসমগ্র,ফেব্রুয়ারি, নীড়ে নিরুদ্দেশে, সাতে নেই, পাঁচে আছি, প্রেম বিরহের কবিতা, (শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সাথে এক বক্সে) রবি ঠাকুরের প্রাইভেসি, পাখিদের গ্রামে আজ একটি গাছে সাথে সাক্ষাৎ করার কথা, ফেরোমনের গন্দে নেশাগ্রস্থ প্রজাপতি, তোমার বাড়ি কত দূর, প্রেমের আগে বিরহে পড়েছি, সঙ্গমের ভঙ্গিগুলো, তিন মিনিটের কবিতা, আমার সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হবে আজ।
গবেষণা/প্রবন্ধ ; সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব, ১৯৯৩ অনিন্দ প্রকাশ। শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ: মুজিব হত্যা মামলা। নাটক : আজ আমাদের ছুটি, জাদুকরের উদ্দেশ্যে যাত্রা,। গল্প : তুমি, যাদুকর, কথা, কয়ড়া গ্রামে বুনো হাতি, ভূতের পাসওয়ার্ড, । রেসকোর্সের অশ্বারোহী। উপন্যাস: বীর বিচ্ছু, যুদ্ধশিশুর জীবনযুদ্ধ, গাছখুন।স্মৃতিকথা: *কাছের মানুষ দূরের মানুষ, দূরের মানুষ কাছের মানুষ, । ছড়া একাত্তরের দত্যি, কবি ঠাকুর রবি ঠাকুর, টাকডুমা ডুম ডুম, পড়ার বই ছড়ার বই, এক যে ছিলো শেখ মুজিব,
সম্পাদনা : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নির্বাচিত কবিতা, ১৯৮৭ নওরোজ কিতাবিস্থান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নির্বাচিত ছড়া, ১৯৯০, * Poems of Liberation World, বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা, স্বরব্যঞ্জন ২০০৫, মুক্তিযুদ্ধ ষয়ক নির্বাচিত কবিতা (বাংলাদেশ, ভারত এবং ভিবিন্ন ভাষায়), কথাশিল্পীদের কবিতা, বঙ্গবন্ধুঃ ১০০ কবির ১০০ কবিরা, স্বরব্যঞ্জন ২০১৯, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ১০০ ছড়া, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত নির্বাচিত গল্প। অন্যান্য: কবিতা সমগ্র ১ অনন্যা ২০০৯। বঙ্গবন্ধু সমগ্র, শিশু কিশোর সমগ্র, ২০২০।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের তিন মিনিটের কবিতা
৪৮
যীশুর একটি বোন ছিলো-
সে ইংরেজি বর্ণমালার ২৭তম বর্ণ,
ঘুমিয়ে থাকে কুমারী মেরীর গর্ভে।
যুদ্ধশিশু নয়;
ঈশার অপ্রকাশিত বোন! রূপকথার ভ্রুণ।
পাদ্রীপিতা, ধবধবে ফাদারের কাছে তার প্রশ্নঃ
সম্পর্কের তৃষ্ণা পেলে কাকে ‘বাবা’ বলে ডাকবো?
৪৭
অনন্ত অবসরে যাবার আগে, আপনার সাথে এক কাপ
দীর্ঘ ঘুমের আগে, আপনার সাথে এক বিছানায়
না ফেরার দেশে যাত্রার আগে, আপনার সাথে একবার
সকল প্রস্তুতির আগে, আপনার সাথে এক সুরে
সূ্র্য ডুবার আগে, আপনার সাথে এক নদীতে
শেষ স্নানের আগে, আপনার সাথে এক টাওয়ালে
সূতো ছেড়া ঘুড়ি দেখতে দেখতে, আপনার সাথে এক আকাশে
হিমঘরে ঢুকার আগে, আপনার সাথে এক চাদরে
তীর্থযাত্রার পূর্বে, আপনার সাথে এক মলাটে
বৃষ্টিভেজা বিদায়ে, আপনার সাথে এক ছাতায়
মুগ্ধ মাদাম তুসো দেখার আগে, একবার আপনাকে
বিচ্ছিন্ন হবার আগে, আপনার সাথে যৌথ-যুগল
হারিয়ে যাবার আগে, আপনার সাথে এক ঋতুতে
পরবাসে পা দেয়ার আগে, আপনার সাথে এক রাত্রি...
৪৬
মালিক পক্ষের সাথে ইউনিয়নের নেতাদের হাত মেলানো আঁতাতের রাতে
শ্রমিক সঙ্গমে শিথিল হয়ে কেঁদেছিলো,
টিনের চালে ছিলো বৃষ্টি।
অথচ সে জন্মক্ষণেও কাঁদেনি;
হেসেছিলো, অদ্ভূত প্রথাবিরোধী।
এখনো গায়ে মাছের গন্ধ; জলঘ্রাণ
জালের আকর্ষণ।
মৃত্যুপূর্বে মা জানিয়েছিলো:
‘তোর জন্মে একটু ঝামেলা আছে! তোর রক্তস্রোতে এতো নদীর নেশা-
তুই জেলে হলে ভালো করতি!’
অথচ সংসারে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেই,
টিনঘরে আছে শুধু বৃষ্টি!
৪৫
আমাদের এখন পরষ্পর দেহদান করবো।
দান, অনুদান করার মধ্যে আনন্দ
সেবা এবং মহত্ব।
মহৎ হয়ে উঠি নির্মল বাতাসের মতো।
ঢাকা মেডিকেলে চক্ষু দান করেছি,
এবারের পর্ব পরষ্পরের দেহদান!
অথবা জায়নামাজে সেজদা
পুজা-প্রার্থনা পর আমরা ঋণে রচনা করবো
নক্সি জীবন!
৪৪
নিদ্রাস্বপ্নে যে মাওলানা খৃষ্টান হয়ে গিয়েছিলো,
তিনি ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলে চিৎকার করে উঠেন!
আমিও একবার ঘুমের ভেতর নারী হয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম- নিজের স্তন দেখে,
আর তোমাকে ভেবে ছিলাম- পুরুষ!
উস্কানিমূলক রোদের রথে চড়ে তৃতীয় স্থান হিথ্রোতে আসো,
টেমসে তালা ঝুলিয়ে ফেলে দেবো চাঁদ এবং চাবি।
শুধু আকাশের আলোতে জল-জাহাজে জ্বলবে আমাদের ধর্মহীন সম্পর্ক,
সঙ্গম খেলা।
তুমিও কি মাওলানার মতো বদলে যাও; পুরুষ হয়ে উঠো?