top of page
mustafizshafi.jpg

কবি মুস্তাফিজ শফি

sikor logo 1.png

টানেলের শেষে

মুস্তাফিজ শফি

জাগরণে আমি তাকে ডাকি মেঘ- বৃষ্টি হয়ে ঝরুক না সে

টিনের চালে। আমার কি তবে বৃষ্টির সঙ্গে দেখা হয়,

দেখা হবে কোনো কালে? বৃষ্টি, আহা প্রিয় বৃষ্টি। বিষাদ সমগ্র বুকে নিয়ে সে তো এখন কেবল শুয়ে থাকে পৃথিবীর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর শীতকালে। আমার চোখের সামনে বর্ষাগুলো হারিয়ে যায়, নদীরা শুকিয়ে মরে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে।

 

সবুজ মাঠের পাশ দিয়ে আকাশের নীল বুকে শাড়ির পাড়ের মতো বয়ে যেতো নদী। দুই তীরে নুয়েপড়া বরুনের ডালে নকশার মতো পাখির কাকলী। নদীও যে কারো দীর্ঘশ্বাসের নাম হয় তখনও বুঝিনি। জলগামী রাজহাঁসও মাঝে মাঝে করে হাঁসফাস, বুঝিনি তাও।

 

মুহুর্তেই ফণা তোলে জলশঙ্খিনী সাপ। অন্ধকার রাতে দূরের তারাদের সাথে শুয়ে শুয়ে পাখিও হারায় উড়ালের কারুকাজ। সমস্ত শব্দের শেষে আজ কথা বলে যায় অন্ধকার। সবকিছু হাহাকার নয়, পরাজয় নয়। যখন পাতালগামী ট্রেনের

হুইশেলে নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান, কে তখন কথা বলে উঠে টানেলের শেষে আধো আলো আধো অন্ধকারে।

jonmodin Mshafi.png

আমরা এখনো জ্যোৎস্নার জল কুড়োচ্ছি দূর্বাঘাসে,

আমরা এখনো উদাসীন, নিশ্ছিদ্র আকাশ দেখে বিস্ময় রচনা করি;

নগ্নপায়ে ধুলোউড়িয়ে বাতাসে ঘুড়িচড়াই

শিশুতোষ গল্পপড়ে রহস্যময় স্বপ্নবুনার দিন এখনো শেষ হয়নি,

আমরা কতটাই বা সংসারের ছিদ্রচালে জোড়াতালি দেয়ার কথা ভাবতে পেরেছি;

এতেই নশ্বরতা পীছু লেগেছে, সময় তৈরি করছে বৈষ্যমতা

আমরা বুড়িয়ে যেতে শুরু করেছি…

 

শুভ জন্মদিন বন্ধু

ফারুক আহমেদ রনি

ভাবাও সকলে

শামীম আজাদ

শফিকে দেখার আগে তার বাঁশি শুনেছিলাম। দেখা হয়েছে তার প্রায় কুড়ি বছর পর।

সে বাঁশি যাদের বুকের বাতাসে পুষ্ট হয়ে ওষ্ঠ থেকে বাণী হয়ে আমার কানে পৌঁছেছিল তারা সবাই লন্ডনের বাসিন্দা ও আমার অনুজসম। তখন তাদের বয়স ছিল কুড়ি বা একুশ। আমি তখন বিলেতে পড়াতে এসেছি মাত্র।

ধারণা করি তাদেরও শফির মতোই ১৯৭১-এ জন্ম হয়েছিল। আর না হলেও তার কাছাকাছি সময়েই হবে। সে আজ থেকে কুড়ি বা বাইশ বছর আগের কথা। লন্ডনের সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকায় মুস্তাফিজ শফির লেখা নিয়ে আমি আমার আগ্রহ প্রকাশ করতেই সে বাঁশিগুলো বেজে উঠেছিল। আর আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। না, স্বরব্যঞ্জনার জন্য নয়, আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম ফারুক আহমেদ রনি ও আবু তাহের কীভাবে তাদের বন্ধু শফিকে চেনাচ্ছিলেন। মানুষ অচেনা জিনিসকে চেনা বিষয় বা বস্তুর সঙ্গে তুলনা করেই তাকে মূর্ত করে তোলে। ওই তরুণ কবি ও লেখক তাদের বন্ধুকে বর্ণনা করতে গিয়ে সব ভালো লেখা ও দেখা নিয়ে এসেছিল। তাদের চোখে-মুখে শুধু গর্বই নয়, শফির প্রতি তাদের প্রগাঢ় আস্থাও লক্ষ্য করেছিলাম। তাদের শেষ কথা ছিল, শামীম আপা আপনি ওকে দেখলে বুঝতেন।  

অতঃপর আমি মুস্তাফিজ শফির কিছু প্রতিবেদন পড়ি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার অবস্থান ও স্থানান্তর লক্ষ্য করি। কিন্তু তার লেখার বিষয়বস্তুতে একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করি। সবচেয়ে বড় কথা আমি তার সৃজনে যে মনন প্রত্যক্ষ করতে সমর্থ হয়েছিলাম তা তার বন্ধুদের ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল এবং তা কিন্তু তাকে বাস্তবে দেখার আগেই। বাস্তবে যেদিন দেখি, প্রথম সম্ভাষণেই আমরা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কুশল বিনিময় করি। সুদর্শন শফিকে দেখে মনে হচ্ছিল তার মাথার ভেতরে একটি ফ্রিজ বসানো। এতই স্থিত সে। কিন্তু স্বভাবের পরিচয় পেয়ে বুঝি এই মিষ্টত্ব আসলে তার জন্মভূমের জলঢুপি আনারসের মতোই।

তার গাত্রবর্ণও সে রকমই সোনালি। মুখের হাসিটি আবার কিন্তু প্রাজ্ঞের। আমি দেখে ভাবতাম, এমন ভাবুক হাসি সে কোথা থেকে পেল। পরে বুঝলাম, সাধারণত যে সময় আমাদের দেশের অধিকাংশ তরুণ অতিস্বচ্ছ বিষয় নিয়ে, বিনোদিত হওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে তা থাকেনি, থাকে না। ততদিনে নানান সময়ে আমার বাংলাদেশ আসা-যাওয়ার ও দেশের সাহিত্য জগতে নিরন্তর লেখালেখির কারণে আমি তার ‘আপা’ হয়ে গেছি। আর বিলেতে ফিরে এসে কথা প্রসঙ্গে তার প্রশংসা করলেই রনি ও তাহের লাফিয়ে উঠে বলেছে, আমরা কইছলাম না? আফা অনে দেখলা তো!

শফির ‘একাত্তরের বিজয়িনী’ পড়ে আমাদের তৃণমূল পর্যায়ের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জেনে বিস্মিত হয়ে ভেবেছি বাংলাদেশের জন্মের সময় যে ছিল শিশু, সে কী করে এভাবে আমাদের দেশের আত্মার ক্রন্দন তুলে আনছে! আমার চোখ ভিজে গেছে। আর সে সময়টাই ছিল আজকের বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের সূচনাকাল। পঁচাত্তরের পর যে ধারার ধোঁয়া দেশের ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে আবছা করতে করতে মিথ্যাকে মিথে পরিণত করছিল, তখন এই তরুণের সত্য কথন আমাকে অবাক করেছে। বুঝে প্রত্যাশার বীজ বুনেছে। আজ মনে হয় পরাজিত শক্তির গোড়ায় শুধু দেশের বিরুদ্ধশক্তি একাই জল দেয়নি, দিয়েছে আত্মপ্রেমে বিভোর রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীরাও। দেশকে দেখানোর সময় বিউটিপার্লারের মতো বাইরে থেকে মেনিকিউর আর পেডিকিউর করা হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করা হয়নি।

দেশপ্রেমের ব্যাপারে আমি একটা কথা বলি। তা হলো, দেশপ্রেমও বাল্যকাল থেকে ধর্মের মতো করে শিক্ষা দিতে হয়। আমরা যে পরিবারে জন্ম নিই তার ধর্মীয় আচার-আচরণ রপ্ত করে পরকালে বেহেশতের ব্যবস্থা করি। আর সে বাড়ির সরাসরি নির্দেশনায় বিদ্যা শিক্ষা নিই অর্থ আয়ের জন্য, আরামে থাকার জন্য। কিন্তু ও দুটো বা তার সঙ্গে অন্য আনুষঙ্গিক আয়ত্ত করার জন্য যে দেশ আমাকে একটি জাতীয়তা দিয়েছে, ভূমি দিয়েছে, একটি ভাষা দিয়েছে তা নিয়ে ভাবি না। তা এত অনায়াস লব্ধ হয়ে যায় যে তার আর স্বাস্থ্যরক্ষা নিয়ে আমরা ভাবিই না। দেশকে ভালোবাসাও প্রেমের মতোই একই রকম, চর্চায় এর বৃদ্ধি এবং অবহেলায় তার সমাপ্তি। ধারণা করি আমাদের এই পঞ্চখণ্ডের ছেলেটির পরিবার তা করেনি।  

সাংবাদিক ছাড়াও শফির কবি ও লেখক হিসেবে প্রগাঢ় পরিচয় রয়েছে। এবং তার সব কিছুরই ভিত দেশের ইতিহাসের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই। এ আমাদের বড় সৌভাগ্য।  

সুবর্ণজয়ন্তীতে তাই শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে মনে হলো, শফির আপা বলে আমারও গর্ব তাকে নিয়ে। বেঁচে থাকো ভাই। আপনি আচরি ধর্ম ভাবাও সকলে। তোমার মঙ্গল হোক।

মুস্তাফিজ শফি ও তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আমার একটি আলোচনা। সেখান থেকে পাঠক কিছুটা হলেও একজন মুস্তাফিজ শফিকে জানতে পারবেন। আমাদের আয়োজনে আরো বেশ কিছু লেখা সম্পৃক্ত হবে...।  

ফারুক আহমেদ রনি

 

পড় তোমার প্রেমিকার নামে : মুস্তাফিজ শফি

 

১. আদি ভূমিকা

 

কবিতা হচ্ছে একান্তই কবির ঐন্দ্রজালিক শিল্পসৃষ্টি। ভাবের বৈচিত্র্য নিয়ে কবিতার শিল্পময় শরীর তৈরি করা হয় আর সেটাকে অলংকৃত করা হয়- শব্দ, ছন্দ, মাত্রা আর ধ্বনিগত সুষমার মাধ্যমে। কবিতা পাঠ বা শ্রবণের মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা এবং বিষয়-বর্ণনাকে স্বভাবগত ভাবেই আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে চাই। কিন্তু অনেক সব কবিতা সবার জন্য সহজতর ভাবে বিশ্লেষিত করা সম্ভব হয়না বলেই কবিতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা বা বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

‘’Whenever a person reads a poem, they begin to interpret, or make meaning, out of what they read. Some poems are more difficult to interpret than others—perhaps their language is so heightened or abstract that it no longer resembles common speech, or the metaphors, context, or author's point of view are too unfamiliar to the reader for them to gain entry into the poem. Literary criticism can be helpful at these moments to bridge the gap between reader and poet. Interviews, also, can be useful for understanding a poet's intentions.’’

একজন কবির সাথে সাধারণ পাঠকের সম্পর্ক তখনই সুদৃঢ় বা শক্তিশালী হতে পারে যখন কবির কবিতা সহজভাবে উপজীব্য হয়ে ওঠে। কবিতা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা যেমন অত্যাবশ্যক তেমনি আলোচনার মাধ্যমে কবি-সত্তাকেও আবিষ্কৃত করার দায়বোধ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। কবিতা থেকে যে আস্বাদন পাঠক মনে পুলক জন্মায় সেটা সাহিত্যের অন্য কোন বিভাগে সম্ভব নয়। তাইতো কবিতাকে ধারণ করার ক্ষমতাও সকল পাঠকের জন্য অনুভূত বিষয় নয়। যারজন্য কবিতাকে নিয়ে মুক্ত এবং সুশৃঙ্খল আলোচনার মাধ্যমে অভিনিবেশ স্বীকার্য। পার্থিব জীবনের নশ্বরতা নিয়ে কবির ভাবনার ভেতর দিয়ে যে প্রখর আক্ষেপণ, নির্দেশনা,  রসবোধ, ঘটনা-বিন্যাস, অন্বেষণ এবং বিভাজন ইত্যাদি কেবল মাত্র কবিতার বিশ্লেষণে পরিস্ফুটিত হতে পারে, কবিতার আলোচনা, সমালোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হতে পারে। একজন কবির ভেতরের চিন্তার শিল্পসম্মত ব্যঞ্জনাকে সরাসরি পাঠকের কাছে উপলব্ধি বা উপস্থাপনের জন্যই উত্তম প্রচেষ্টাই হলো মুক্ত আলোচনা।

কবি মুস্তাফিজ শফি রচিত ‘পড় তোমার প্রেমিকার নামে’ গ্রন্থ নিয়ে আলোচনার এক ধরনের দায়বোধ রয়েছে, তার কারণও যথেষ্ট।

 

২. কবি মানস: মুস্তাফিজ শফি

চেয়ে দেখো, আমি সেই দু’পানির

জলের শিশু- দুরন্ত বালক,

এখনো হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরি

তীরবিদ্ধ শালিকের ধূসর পালক।

 

সুদর্শন কবি, মুস্তাফিজ শফি। একান্তই নিভৃতচারী কবি। যাঁর পরিচয় সে নিজেই, আর কর্মই হচ্ছে তার নিজস্ব সত্তা বা অস্তিত্বের মুল স্ফুরণ । আমি তাঁকে সম্মান  করি বন্ধু বলে নয়, তাঁ কর্মের জন্য। কর্মের প্রতি ত্যাগ আর শ্রদ্ধাই তাকে সাংবাদিকতার মত কঠিন পেশায় প্রতিষ্ঠালাভে সম্পূর্ণভাবে পরিপূরক হিসাবে সহায়তা করেছে।

মুস্তাফিজ শফির সাথে আমার পরিচয় গত তিন দশকেরও বেশি সময়। শিকড় ও   সংহতির জন্মলগ্ন থেকে নানাভাবে আমাদের সাথে কাজ করে আসছেন। তাকে কবি হিসাবেই চিনতাম। যাঁর মধ্যে দেখেছি ‘ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন’ সৃজন-কল্পনা। দেখেছি সুদূর প্রসারী সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের মন্ত্রশক্তি।

সম্ভবত ১৯৯২ সালে তাকে আমি ঢাকায় দেখি- যদি আমি ভুল না করে থাকি অধুনালুপ্ত ‘লাল সবুজ’ নামের খুব ছোট একটি দৈনিক কাগজের স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কাজ করতেন। বেশি দিন না,খুব অল্পদিনের মধ্যে মুস্তাফিজ শফির ডাক আসে আজকের কাগজ পত্রিকায়, আর তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক দৈনিক মানব জমিন, প্রথম আলো, আমার দেশ,  কালের কণ্ঠ, বর্তমানে তিনি সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তাছাড়াও যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ থেকে একযোগে প্রকাশিত মাসিক সাহিত্যের কাগজ শিকড়ের জন্য আমারা একসাথে কাজ করেছি বেশ কিছুদিন।  বিশেষ করে শিকড়ের জনপ্রিয়তার পিছনে তার সর্বোপরি ত্যাগ আর শ্রম ছিল অগ্রণী ভূমিকায়।

মুস্তাফিজ শফি সময়ের সিঁড়ি ভেঙে খুব দ্রুততর এগিয়ে যেতে থাকেন। অর্জন করেন নানা স্বীকৃতি। রিপোর্টস ইউনিটি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, লায়ন্স ক্লাব, ইউনেস্কো ক্লাব মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ও জাতিসংঘ গোল্ড সিড এ্যাওয়ার্ড সহ নানা পুরস্কারে পুরস্কৃত হোন।  তাই সাংবাদিকতা জীবন নিয়ে ব্যস্ত সময়ের বেশ ক’বছরের ব্যবধানে একজন কবি মুস্তাফিজ শফি তার মৌলিক জগত থেকে হঠাৎ করে হারিয়ে যান। কারণ একটিই, প্রতিষ্ঠা। আমি রীতিমত ভয়ে ছিলাম, মাঝে মাঝে তাঁকে বলেছিও মুস্তাফিজ আমরা কি একজন কবিকে হারিয়ে ফেলছি?

মুস্তাফিজ হাসতেন, না আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসছি!

আমাকে আশাহত হতে হয়নি, মুস্তাফিজ শফি ঠিকই ফিরে এসেছেন। তার কাব্যশক্তির সঞ্জীবিত ভাষাচিত্র আর তাঁর  অন্তর্নিহিত কাব্যরসের সন্ধান পেয়ে গেলাম। আজ আমার হাতে চলে এসেছে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ- ‘পড় তোমার প্রেমিকার নামে। আমি আলোচক নই, আমি গ্রন্থটি নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাব না।

নেহাতই মুস্তাফিজ শফির প্রতি আমার অনুরাগ বা ভালবাসাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে সার্বিকভাবে একটা আলোচনার সুযোগ নিয়েছি মাত্র। কবিতা মুস্তাফিজ শফির মন ও মননে লালিত শিল্পকলা, সময় এবং অবস্থান সাময়িকভাবে তাঁকে বিচ্ছিন্ন  করেছে মাত্র কিন্তু  বিচলিত করতে পারেনি,  বিধ্বস্ত করতে পারেনি। পারবেইবা কেন? একজন কবির অভিজাত বন্ধন হচ্ছে  তাঁর  কবিতার সাথে আর কবিতা হচ্ছে তার প্রাচুর্য। তাঁর  ইহকাল-পরকালের উৎকৃষ্ট সম্পদ। । কবি ওয়েস্ট্যান হিউজ অড্যান  কবিতা বা কবির প্রাপ্তিকে অসামান্য আবদার হিসাবে কেমন করে পরিস্ফুটিত করতে চেয়েছেন, এমন একটি উক্তি যদি দেখি, যেমন;

God may reduce you

on Judgment Day

to tears of shame,

reciting by heart

the poems you would

have written, had

your life been good.

শেষ বিচারের দিন বিধাতাও হয়ত কবিতার জন্য একজন কবিকে তার কষ্টকে সীমিত করে দিতে পারেন! কবিতার মর্মবোধ এবং কবিতার প্রতি আনুগত্য আমাদের জীবন সম্পর্কে কতটা ফলপ্রাপ্তি হতে পারে তার নুন্যতম ধারণা হয়ত কবির দর্শন বা অভিব্যক্তি থেকে তাঁর আত্মতৃপ্তির উৎকর্ষ হিসাবে ব্যঞ্জিত হয়েছে।

কবিও কবিতাকে ছোট করে দেখার কোন উপায় নেই। হয়ত কবিতাকে নিয়ে ভাবনার সুযোগ আছে অথবা আলোচনার সুযোগ থেকেই যায়।

 

৩. কবিও কবিতা: পড় তোমার প্রেমিকার নামে

কবিতা হচ্ছে এক ধরনের চুম্বকের আকর্ষণের মত- ইস্পাতহীন বস্তুর সাথে যেমন চুম্বকের যোগ নেই, তেমনি ভাবহীন পাঠকের কাছে কবিতা নিষ্প্রাণ। তবে কবিকেও চুম্বক আকর্ষণের দায়বোধ থেকেও মুক্তি দেয়া যাবেনা, যতক্ষণ না একজন কবি তাঁর  আত্মগত ভাবকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশে বা অনুভবে ব্যক্ত করতে না পারছেন ততক্ষণ তার কাব্যশক্তি পাঠকের কাছে আবেদনহীন এবং দুর্বোধ্য থেকেই যাবে।

মুস্তাফিজ শফির কাব্যগ্রন্থ হাতে পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি- আবেগে আপ্লুত হয়েছি। মুস্তাফিজ শফির তিনটি গ্রন্থ একসাথে প্রকাশিত হয়েছে ২০১০ সালের একুশে বইমেলায়। তার মধ্যে ‘পড় তোমার প্রেমিকার নামে’- কাব্যগ্রন্থ আর অন্য দুটি হচ্ছে বিলেতের বাঙালিদের নিয়ে লেখা, প্রবন্ধ-‘বিলেতের বাঙাল’ এবং অনুসন্ধানীমুলক প্রতিবেদন- ‘নির্বাচিত অনুসন্ধান’। তবে আমি অতীব উৎসাহী তার কাব্যগ্রন্থ নিয়ে।

গ্রন্থটিতে সংকলিত হয়েছে ৪৪টি কবিতা। প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। প্রচ্ছদ করেছেন মাহবুবুল হক। প্রকাশ কাল মাঘ ১৪১৬, ফেব্রুয়ারি ২০১০।

গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন-

যারা প্রেমে পড়েছেন, যারা প্রেমে পড়বেন এবং যারা প্রেমে পড়ে ব্যর্থ হয়েছেন।

তাঁদের র উদ্দেশ্য করে। তাঁরই কথা-

প্রেম মানে শত শূন্যতার যোগফল

এক ফালি আশা

দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ হয়

তবুও সত্য সে যে

শাশ্বত ভালোবাসা।

গ্রন্থটি নিয়ে আমি খুবই হালকা আলোচনা করবো। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাছে ভাল লাগা না লাগার বিষয় উত্থাপিত করবো। তবে ভাল বা খারাপ লাগার বিষয়টা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। পাঠকের কাছে তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে এবং বাঞ্ছনীয়।

কাব্যশক্তিই হচ্ছে কবির সবচেয়ে বড় সম্পদ, একজন কবি তার  সাহিত্যকর্মের ভেতর দিয়েই আত্মমুক্তির সন্ধান করেন, সমালোচনা বা আলোচনার মধ্যদিয়ে তার সৃষ্টির উত্তরণ স্পষ্টতর করা হয়। কিন্তু আজকাল সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা কতটুকুই বা হচ্ছে, সেটা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতা শুধু নয় বিশ্ব সাহিত্যের বিবেচনায়ও আমরা সেটা আজ উপলব্ধি করতে পারি। বর্ডসীট কাগজগুলোতে সাহিত্যের কতটুকু জায়গা আছে আমরা কাগজগুলো হাতে নিলেই তার অভাবনীয় অবস্থান জরিপ করতে পারি। এক সময় সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতায় বর্ডসীট কাগজগুলোই মুলত প্রধান ভূমিকা রেখে এসেছে। দুঃখ করে মার্কিন সাহিত্য সমালোচক জন বার সাম্প্রতিক তারই একটি আলোচনায় লিখেছেন;

A century ago our newspapers commonly ran poems in their pages; fifty years ago the larger papers regularly reviewed new books of poetry. Today one almost never sees a poem in a newspaper; and the new poetry collections reviewed in the New York Times Book Review are down to a few a year. A general, interested public is poetry's foremost need.

সম্ভবত আশির দশকেই বলতে গেলে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে এমনই ক্ষোভ পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে লিটলম্যাগ বা সাহিত্যের ছোট কাগজের প্রতি অনুরাগ, এবং বিকল্প চিন্তা হিসাবে বলতে গেলে লিটলম্যাগ  বাংলা সাহিত্যে বড়সড় একটা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। যেখানে প্রতিদিনের বর্ডসীট কাগজগুলো হা হয়ে বিশেষ বিশেষ সংখ্যার জন্য কবিদের কাছে ধর্ণা দিতে হয়। যাইহোক, কবিতার প্রসঙ্গে ফিরে যাচ্ছি.. ‘পড় তোমার প্রেমিকার নামে’।

মুস্তাফিজ শফির প্রথম কাব্য গ্রন্থ, আলোচনার সুযোগ পেয়েছি তাই কবিতাগুলোকে শিল্পসঙ্গত, সৌন্দর্য এবং সৃষ্টির সূতিক্ষ্মভাব দৃষ্টি নিয়েই পড়তে হয়েছে। কারণ, মুস্তাফিজ শফিকে বন্ধু ভাববার আগে একজন কবি হিসাবেই ভাবছি। একজন সুচিন্তিত কাব্যস্রষ্টাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি তারই কাব্যসৃষ্টির ভেতর দিয়েই; গ্রন্থের প্রথম কবিতার উদ্ধৃতি থেকেই আমরা দুই মুস্তাফিজ শফিকে আবিষ্কার করতে পারি।

ক.

দু’জনের দেখা হয়, কথা হয় নিরন্তর-

অভিজ্ঞতা বলাবলি করে, হাত ধরে হাঁটে।

একজন খবরের কারিগর, আরেকজন রঙের মিস্ত্রি;

কাব্যকলা করে, জ্যোৎস্নারাতে ছোটে ভাবনদীর ঘাটে।

আবার বলছেন;

একজন সরব ভীষণ, আরেকজন মৌনতার করে চাষাবাস-

স্মৃতির কলসে বান্ধে বাউরি বাতাস;

খুঁজে ফেরে মাধবকুণ্ডের মেয়ে, বারুণী বেলা;

আরেকজন ভাবে এইসব নিতান্তই ছেলেখেলা।

একজন নির্বোধ খুব, একজন অদ্ভুত চালাক।

বাইরের মানুষ বোঝেনা ভেতরের ফারাক।

-মুস্তাফিজ শফির সঙ্গে মুস্তাফিজ শফির যত অমিল      

গ্রন্থের প্রথম কবিতা, চমৎকার একটি পঙক্তি। কবিতাটিতে একান্তই কবি নিজের সাথে নিজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিভেদ অথবা ক্ষোভের অন্তর্নিহিত অবস্থান  পরিলক্ষিত হয়।

কবিতার প্রতি পাঠকের অনুরাগ একান্তই ছন্দের উপর নির্ভরশীল। ছন্দের কারুকাজের মধ্যেই ভাললাগার বিষয়টা কাজ করে। আমার কাছে ভালোলাগার অন্যতম একটি কবিতা, সান্তাহারের সালেহা, নাটোরের ট্রেন।

খ.

সান্তাহার ছেড়ে বনলতার দেশে কখন যে ছুটে চলেছে আন্তঃনগর ট্রেন।

ওপাশে বর্ষার নদী, এপাশে বেদেনীর কোলাহল। বুড়ো বট। ছায়া থরথর মধ্যদুপর।

ধাবমান হরিণীর মতো দূরে কোথায় কেবলই হারায়- ও কালো মেয়ের আলোকিত ঝিলিক।

- সান্তাহারের সালেহা, নাটোরের ট্রেন

সত্যি আমি যেন নাটোরের ট্রেনে ছুটে চলেছি, খুঁজতে যাচ্ছি নাটোরের বনলতা নয়, সান্তাহারের সালেহাকে। প্রকৃতিকে কাছে থেকে দেখার অদ্ভুত অনুভূতি, নস্টালজিয়া যেন কবিতায় অপরূপ ছন্দবদ্ধ আর বোধসম্পন্ন। শব্দ ব্যবহার, ধ্বনিমাধুর্য, ছন্দসুষমা নিয়ে যে পরিমিত মাত্রা প্রয়োগ হয়েছে তা অনায়াসে পাঠক মনকে আকৃষ্ট করবে। কবিতাটির শরীরজুড়ে রয়েছে পাঠের আবেদন, শিল্পের বুনন প্রভাবিত একটি রূপ-সৌষম্য সৃষ্টি।

 

যেমন; আরেকটি কবিতা- একই ভাবে মাত্রা-বিন্যাস ও ছন্দের অসীম শক্তিকে সুস্পষ্টভাবে অলংকৃত করা হয়েছে।

গ.

আগামী পূর্ণিমার আগে ও নদী আবার জাগাব তোকে

আবার শুনাবো তোকে হারানো সেই গান

যে গানে উথাল পাতাল অসীম সাহসে বুকে তোর

নেমে আসে জলের তুফান-

-           হাছন রাজার গান

সাম্প্রতিক কালে বাংলা কবিতায় গদ্যছন্দ একটি ভিন্ন দ্যোতনার প্রয়াস হিসাবে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। বর্তমানধারার কাব্য চিন্তায় গদ্যছন্দের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কাব্য সাহিত্যের উঠোনে যে বিস্ময় আমরা লক্ষ্য করি তা হচ্ছে কাব্যধর্মী গদ্য; অনেকটা মুক্তকছন্দ কবিতার প্রভাব বাংলা সাহিত্যে উর্বরতাকে আরো বেশি করে সজীব ও গতিময় করে তুলছে তাতে সন্দেহ নেই। গদ্যছন্দের প্রভাব এখন বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক আধিপত্য সেটা কবিতার সাথে মেলামেশা না করলে বুঝা যাবেনা। বাংলা কবিতায় বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বিকাশ বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই শেষ পর্যন্ত গদ্যছন্দের প্রতি লোভবান হয়ে পড়েন, পরবর্তীতে আমরা গদ্যছন্দের কারিগর হিসাবে জীবনানন্দকে ধরে নিতে পারি এবং তারই ধারাবাকিতায় আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কবিরা গদ্যছন্দে সবচেয়ে বেশি সাবলীল।

কাব্য-ধর্মী গদ্য কবিতাকে আমরা সহজভাবে এখনো নিতে পারছিনা কিন্তু অস্কার ওয়াইল্ডের ‘letter to Lord Alfred Douglas’ নিয়ে নানা বিতর্কের সুযোগ তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত গদ্য-কবিতা হিসাবে সাহিত্যে একটি মাইল ফলক ।

যেমন; মুস্তাফিজ শফির কবিতায় আমরা গদ্যধর্মী ছন্দময়তাকে আবিষ্কার করি যে ভাবে:

ঘ.

শিউলি ফোটা নির্জন রাতে অবিরল খেলা করে বাউল বাতাস

হিমশিম শীতলতায় মাড়াব কুয়াশার চাদর-

সামনে দাঁড়িয়ে দেখি সোনাইয়ের জলে ভেজা শ্যামল কিশোরী।

অনেক দুরে যাবো আমি- পথ আগলে দাঁড়ায় পাহাড় পাথারিয়া,

যার পাদদেশে খাসিয়া রমণীরা রচনা করে রহস্য আখ্যান।

 

আবার আরেকটি পর্বে-

এবার নিজেকে ফেরাই অন্যদিকে। সামনে রাশ উৎসব-

মণিপুরি সাজে সেজেছে আকাশ,

অদ্ভুত মুদ্রায় নৃত্যরত সফেদ সুন্দরীরা জানায় সম্ভাষণ।

-           শীত রাতের কাব্য

 

কবিতাটি রিপ্রেজেন্ট করছে প্রকৃতি, প্রেম- ভালবাসা, সবশেষে সংস্কৃতিকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং তাদের সংস্কৃতি বা উপ-সংস্কৃতির বর্ণনা এখানে চিত্রায়িত হয়েছে। যেমন; সিলেটের পাথারিয়া পাহাড়ে বসবাস করে খাসিয়া সম্প্রদায়, তারপর রয়েছে মনিপুরী সম্প্রদায়, এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রাশ উৎসব। মুস্তাফিজ শফি কবিতাটিতে বর্ণনা, বিষয়বস্তু এবং কাব্যরূপ দানে সৃষ্টির বিচিত্র নির্মাণ ক্ষমতা দেখাতে সচেষ্ট বলেই আমার বিশ্বাস।

 

ঙ.

সব নেব এই সব ভুল

ভোরের শিশির এবং

যত ঘাসফুল

শৈশবের রং নেব

কিশোরীর দুঃখ নেব

তিন মুঠো জল;

লাউতার বটছায়ার হাসি নেব

রাখালের বাঁশি নেব

মুগ্ধতার কারুকাজ নেব

নেব সেই হাওয়ের ফল।

তারপর-

তীর্থে যাব

সব নেব

শুধু তোমাকে নেব না।

-           শুধু তোমাকে নেব না

কবিতার চিত্রায়ন,তাঁর আদর্শগত দিক, ভাব প্রয়োগ পুর্বেকার কবিতার সাথে সামঞ্জস্য থাকলেও অলঙ্কৃত ছন্দ বা বিন্যাস ভিন্ন এবং দুটোর কোনটিকেই নীতিদ্রোহী বলা যাবেনা। পাঠক চেতনাকে আন্দোলিত করার প্রয়াস উদ্দীপ্ত।

চ.

পড় তোমার প্রেমিকার নামে

স্মৃতির বাক্সে তুলে রাখা শূন্যতার নামে

নদী ও নক্ষত্রের নামে

আবার,

পড় তোমার প্রেমিকার নামে-

ফেলে আসা সেইসব রুমালের নামে

উল্টো অক্ষরে লেখা বিচিত্র চিঠির নামে

আবার,

পড় প্রেম মানে শত শূন্যতার যোগফল

একফালি আশা

দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ হয়- তবুও সত্য সে যে

শাশ্বত ভালবাসা

-পড় তোমার প্রেমিকার নামে

 

কবিতাটিতে বিরতিচিহ্নের বালাই নেই, ১৬ লাইনের এই কবিতাটিতে কোন দাড়ি, কমা বা কোনরকম যতিচিহ্ন নেই কিন্তু গতি ঠিকই বিদ্যমান। কবি তার শিল্পশৈলীতে স্বতন্ত্র প্রভাব দেখাতে পেরেছেন এবং এখানেই একজন কবির সার্থকতা। বিশ্লেষণ ও ভাবের আভিজাত্য দৈন্যতাকে পরিহার করতে যথেষ্ট পরিপক্ব। প্রথাবদ্ধতার অবসানে এক ধরনের নতুনত্বের প্রবর্তন  ঘটানোর যে উদ্যোগ সেটা অবশ্যই নতুন না হলেও  কবিতায়, ছেদ বা যতিচিহ্ন আমরা পরীক্ষামুলক হিসাবে গ্রহণ করেছি। কিন্তু কবিতাকে উচ্চস্বরে পড়তে বা আবৃত্তি করতে গেলে ‘পাংচুয়েশন’ বা বিরতিচিহ্নের বিষয়টি এখনও বিতর্কিধীন রয়েছে। তবে একটি কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধির ব্যপারে কবির নিশ্চয় স্বতন্ত্র অভিব্যক্তিতো থাকবেই। তাই এই বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে কবি ও কবিতার উপর।

ছ.

আমি-তো প্রতিদিন তার সঙ্গে কথা বলি, বাগানে হাঁটাহাঁটি  করি, পুকুরে মাছেদের খুনসুটি দেখি- আগের মতোই বলাবলি করি- এবারের পৌষে বড়ভাই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরলে বড় রুই দুটোকে তুলে আনব। আর মাঝারি আকারের যেটা কাতল আছে ওরা থাক আরো কিছুদিন- মেজ ভাইয়ের বাড়ি ফেরা পর্যন্ত।

আবার

পবিত্র আয়াতের সঙ্গে মুঠোভর্তি মাটি দিয়ে ভরিয়েছি কবর.. শিয়রের কাছে শিউলি ফুলের চারা, বরই কাটা, মসুর ডাল, বাঁশের বেড়া। তারপর মোনাজাত..

আমি টের পাই, মা আসেন, বারবার আসেন। আমার কাছে গচ্ছিত রাখা জায়নামাজটি বিছিয়ে বসেন। আর আমি স্পর্শ পেতে সেজদার নামে প্রতিদিন চুমু খাই সেই জায়নামাজ।

-মায়ের জায়নামাজ

কবিতাটির বিষয় আমাদের সবাইকেই কম বেশি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অনেকদূরে.. নিজের বাড়ি, একান্নবর্তী সংসার, মায়ের স্নেহ-ভালবাসার সে এক অভিন্ন আকর্ষণ.. সে তো আর কেউ না বুঝুক  আমরা বুঝি। যারা জীবনের তাড়নায় মায়ের আঁচল ছেড়ে অথবা মা পাড়ি দিয়েছেন জীবনের সকল মমত্ববোধ থেকে পরপারে।

আমার ভেতরের কবি মানুষটি যেন জেগে উঠল মূহুর্তে।  কবিতায় রয়েছে স্পষ্টতর আবেদন, বেদনা, বিশ্বাস, ভালবাসা আর হারানোর কষ্ট। খুব ভাল লাগার উপাদান বিন্যস্ত কবিতার শরীরজুড়ে।

জ.

আমি কান পেতে রই। কুয়াশার জাল ছিন্ন করা ওদের ডাক শুনি। ওদের চিহ্ন লেপ্টে থাকে অনুজ্জ্বল আকাশের গায়। উজ্জ্বল হাসিমুখে ওরা আসছে। আমি কান পেতে রই। আমি চোখ খুলে রই। ওদের ছেড়ে দিতে দিতে সাইবেরিয়ার আকাশ কি কাঁদে না?

অসীম শূন্যতা বুকে নিয়ে চিড়িয়াখানার লেক আকাশের দিকে তাকায়। তবুও চারদিক লেপটানো অন্ধকারে শিকারিরা বন্দুক তাক করে থাকে। শিকারি অপেক্ষা করে, শিকারি কাঁদে  না।

- বিহঙ্গ পুরাণ

 

মুস্তাফিজ শফির পাখি প্রেম বিশেষ করে সাইবেরিয়ার পাখিদের নিয়ে তার দুর্বলতা  বা অতিথিদের প্রতি বেহাগ ভালবাসার সুগভীর মমত্ববোধ জেগে উঠেছে এই কবিতাটির মাধ্যমে। আমাদের সমাজের কতিপয় পাখি শিকারিদের প্রতি তার ক্ষোভ প্রকাশের একটি আদর্শগত চিত্রায়ন।

 

ঝ.

বেদনার বরপুত্র আমি, বেদনাবৃক্ষের ডাল দিয়েই বাঁধব ঘর। মনে রেখো জীবন

মানেই এক চিমটি স্বপ্ন, আধা লিটার দীর্ঘশ্বাস আর একমুঠো বিরহ- এসবের মাঝেও তুমি ঘুমভাঙা রোদ, সোনালি সকাল।

 

কবি মানেই কি দুঃখ  বিলাসী! কবিদের নিয়ে এমন সব জিজ্ঞাসা নতুন নয়। কবিরা আবেগপ্রবণ, তাদের ভেতরের চিরায়িত অবক্ষয় হচ্ছে বেদনা আর আকাঙ্ক্ষার মধ্যদিয়ে স্বপ্নালোকিত বিশ্বাস। সেখানে দুঃখ-বিলাসিতা হচ্ছে তাদের একান্ত সুপরিকল্পিত ভাবাবেগ। এই কবিতার ভেতর দিয়ে কবি তাঁর স্বপ্নকে আবিস্কার করতে চেয়েছেন, কষ্ট বা বেদনার স্থায়িত্ব থেকে মুক্তির অন্বেষণে। সকল বেদনার সমাপ্তি টানছেন ‘ঘুমভাঙা রোদ, অথবা সোনালী সকালের প্রত্যাশায়। স্বপ্ন এক চিমটি, দীর্ঘশ্বাস আধা লিটার এবং একমুঠো বিরহ- পার্থিব জীবনে উপমাগুলোর ব্যাখা হচ্ছে অমেয়, কিন্তু এখানে কবির প্রগমন নির্লিপ্ত, তাঁর অনুভূত খেয়াল মাত্র। শব্দের সাথে ব্যঞ্জনা বা রসের অনুপস্থিতি পাঠককে একটুখানি হলেও নিরাশ করতে পারে, আমার বিশ্বাস কবি ইচ্ছে করেই শব্দগুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং সেখানে তার প্রজ্ঞাবান উপলব্দি বিবেচিত হয়েছে।  

 

ঞ.

তুমি কোথাও নেই- তুমি কি ছিলে কোনদিন

তবুও তোমার কাছে জমা আছে একরাশ ঋণ

----

মগ্নবাউল যেমন টের পায় জ্যোৎস্নার হাসি

আমিও তেমনি পাই তোমার ডাক শূন্যতার বাঁশি

----

তুমি কোথাও নেই- তুমি কি ছিলে কোনকালে

তবুও তোমার নামে আটকে আছি এই মোহজালে

----

কিছু প্রেম ব্যতিক্রম- কিছু প্রেম কদাচিৎ আসে

নেই তবু তুমিই আছো নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে।

- অস্তিত্ব

 

অস্তিত্বকে খোঁজার প্রয়াস। কবি অস্তিত্বকে তার চিন্তা বা কল্পনার রুপময়তায় বিভিন্নভাবে আবিস্কার করতে চেয়েছেন। Realisation of existence নিয়ে বিজ্ঞান এবং দার্শনিক মতবাদ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু কবিদের কাছে ‘Self-realisation means self-discovery in the highest sense of the term.’ যেমন অস্তিত্ব নিয়ে কবি শ্রী চিন্ময়- এর আরেকটি কবিতায় এমনই metaphor বা ভাবনার দর্শক পরিলক্ষিত হয়। যেমন;

No mind, no form, I only exist;

  Now ceased all will and thought;

The final end of Nature's dance,

  I am it whom I have sought.

 

জাগতিক বিষয় নিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই অস্তিত্বকে খুঁজে বেড়াই এবং তারই কাব্যিক রূপ দিয়ে মুস্তাফিজ তাঁর ভাবনা আর খেয়ালের ভেতর দিয়েও অস্তিত্বের রহস্যজাল উন্মোচন করতে চেয়েছেন। কবি সজীব, বিশুদ্ধ দর্শনের মধ্যেই আস্বাদন অবলম্বন করতে পেরেছেন।

 

ট.

হন্তারক আমিও সামনে এগোচ্ছি অপরাপর মানুষের মতোই বেড়ে ওঠা স্বপ্নের বুকে ছুরি চালাতে চালাতে। তুমি তো ভালো করেই জানো, আমি আর ফিরব না।

জীবন সার্কাসের দড়ি, হেলে-দুলে সামনেই যেতে হয়।

পেছনে ফেরার কোন উপায় নেই।

-  সার্কাসের দড়ি

বাস্তবতাকে পরিহার করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই। অজ্ঞেয়তাবাদ আমাদের জীবনে নানা ভাবে প্রভাব ফেলে, আমরা ভাবিত হই, অন্তর্নিহিত এবং পারিপাশ্বিক অবস্থান সম্পর্কে আমাদের প্যারাডক্স প্রবৃত্তি  বা মানসিক বৈশিষ্ট্য অবলুপ্তির দিকে ধাবিত হতে থাকে। কবিদের কাছে তাদের চিন্তা বা ভাবনার জগতে চরোমোৎকর্ষ সৃষ্টি বা শিল্পদর্শনের ক্ষেত্রে metaphoric  ভাবাবেগ, স্থিতি ও শব্দ প্রয়োগের বিষয়টা লক্ষনীয়। মুস্তাফিজ শফি তাই করেছেন। জাগতিক নিয়মের প্রথাগত বৃত্তে তিনি মনস্তাপ বা ইন্দ্রিয়ক্ষোভে তাড়িত ।

 

ঠ.

প্রেমিকারা সব পাশের বাড়ির বেণি দুলানো মেয়ে,

যায় দিন যায় মাস তাদের পথ চেয়ে।

সব যেন এক বিমূর্ত ছবি নিপুণ তুলিতে আঁকা,

প্রেমিকার মন উদাসী হাওয়া হয়তো পাবেনা দেখা।

-           পড় তোমার প্রেমিকার নামে: দুই

 

ড.

বুকের ভেতর স্বপ্ন আছে, স্বপ্ন ঘেরা তুমি

বুকের ভেতর আকাশ আছে, দুর আকাশে তুমি।

অথবা

বুকের ভেতর তোমার ছায়া, শূন্য ছায়ার বুক

বুকের ভেতর কষ্ট ভীষণ, কষ্টে নাকি সুখ।

-           দিন যাপনের অ্যালবাম

 

ঢ.

যুদ্ধের দামামা বাজে, অমানিশা ঘোর

বড়ই বেয়াড়া সে রোদেলা দুপুর

-           জন্মগান ১৯৭১

ণ. এ কোন স্মৃতির গন্ধ ছড়ালে তুমি-

হায় পূর্ণিমা, হায় মাঘচন্দ্রা রাত!

বন জ্যোৎস্নায় এ কার হাহাকার

এ কার কান্নার ধ্বনি?

- বিরহগীত: দুই

 

উপরোক্ত পঙতিগুলো বিভিন্ন কবিতার অংশবিশেষ, কিন্তু ছন্দের কারুকাজ বর্ধিত করেছে কাব্যময়তার গতি ও ধ্বণিগাম্ভীর্যতা। অনায়াসে কবির দর্শনেরও গভীরতাকে উপলব্ধি করা যায় সহজে।

 

পড় তোমার প্রেমিকার নামে গ্রন্থের সবগুলো কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে পারলে হয়ত পাঠকদের কাছে গ্রন্থের আবেদন হয়তো বৃদ্ধি পেতো। গ্রন্থের অন্যান্য কবিতাগুলোর মধ্যে

-           মানবিক শান্তি পাবে

-           অনুসন্ধান

-           পলায়ন

-           রাত্রী শেষের বেদনা

-           প্রসব বেদনায় নীল এক কবি

-           সীদ্ধান্তহীন পদযাত্রা

-           নদী তোর অতো জল নীল নির্জন

সহ অন্যান্য সব কবিতাগুলোই স্নিগ্ধ, বস্তু-নিষ্ঠ এবং নির্মল। প্রতিটি কবিতাই স্ব স্ব চিত্রকল্প ও ভাব বিকাশে সুস্পষ্ট । সবশেষে গ্রন্থের আলোচনাকে বিস্তৃত করতে পারিনি বলে নিজের দায়বোধ থেকে যেন কোন ভাবেই মুক্তি পাচ্ছিনা। তবে আরো বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে আছে যাতে গঠনমূলক এবং সমৃদ্ধশালী করতে পারি।

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে মুস্তাফিজ শফি ইতোমধ্যে অভিষিক্ত হয়েছেন। একজন কবি মুস্তাফিজকে অনেক পেছনে ফেলে সাংবাদিক মুস্তাফিজ অনেক দূরে চলে গিয়েছিন বলেই আমার বদ্ধমূল ধারণার সমাপ্তি টেনে দিলেন। তিনি আজ আমার হাতে কবিতাগ্রন্থটি ধরিয়ে দেন। আমি মুগ্ধ হয়ে প্রত্যেকটি কবিতার ভেতর দিয়ে উচ্চার্য ছন্দ রীতির সার্থকতা উপলব্ধি করেছি। আমার ধারনার ফুল স্টপ হিসাবে ‘ডোমের টেবিলে স্বপ্ন অথবা কবির জবানবন্দি’ কবিতাকে চিত্রকল্পে নিখুঁত ও সুচারু ভাবে পাঠক হৃদয়ে পরিস্ফুটিত বা সঞ্চারিত করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।  কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো সুখপাঠ্য- সহজেই আকৃষ্ট করে এবং চুম্বকের মতো সামনে টেনে নিয়ে যায়।

নাগরিক জীবন, নস্টালজিয়া, দহন, ভালবাসা নিয়ে কবি তার কবিতায় স্পষ্টবাদী, ভিন্ন দ্যোতনা, ভিন্ন মাত্রায় আকৃষ্ট করতে পারে। মুস্তাফিজ শফির গ্রন্থটি পড়লেই বুঝা যাবে তিনি এখনো আপাদমস্তক কবি। শিকড়ের টানে আপ্লুত নস্টালজিক কবি, প্রেম-ভালবাসায় প্রলোভিত প্রেমিক কবি।

ফারুক আহমদ রনি

সম্পাদক, শিকড়

bottom of page