দেলোয়ার হোসেব মনজু
তৃতীয় বাংলার কবি ও কবিতা
তৃতীয় বাংলার কবি ও কবিতা নিয়ে আমাকে বলতে বলা হয়েছে দু’এক দিন আগে। আমার জিজ্ঞাসা- আমাকে কেন লিখতে বলা হলো না! এ জিজ্ঞাসা ক্রমবর্ধিত হতে পারে- বলাটা জরুরী না-কি লেখাটা জরুরী? আমরা যখন কোনোকিছু লিখি প্রথমে কি মনে মনে বলি তারপর লিখি? সক্রেটিস নামের মহাজ্ঞানী এক জন্মে কিন্তু কিছুই লিখে যাননি; বলে গেছেন। আমি সক্রেটিসের সময়ের একটি শব্দ লিখে এনেছি। শব্দটি হলো প্যারামাকন। গ্রীক ভাষায় প্যারামাকন শব্দটি দ্বিমাত্রিক অর্থবহন করে। প্রতিকারক এবং আক্রমণাত্বক। তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কখনো কখনো জাদুখণ্ড হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। আবার ঈশ্বর থুত লেখ্যরূপকে প্যারামাকন হিসেবেই উপস্থাপন করেন। ঐ সময় মহান ইজিপ্টের রাজা ছিলেন থমাস, গ্রীকবাসী যাকে বলে আমন বলে সমে¡াধন করত। ঈশ্বর থুত নিজ উদ্ভাবনা প্রদর্শন করেন এবং ইজিপ্টবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাবনা রাখেন। কিছু কিছু উদ্ভাবনা বাতিল করে থমাস আলোকপাত করেন লিখন পদ্ধতির দিকে। প্লেটোর ফার্মেসী বা প্লেটোর ঔষধালয় (১৯৬৭) গ্রন্থে জাক দারিদা ফেড্রুসের অধিশ্রয়ন করেন যা সক্রেটিস এবং ফেড্রুস দু'টি ঐতিহাসিক চরিত্রের কথোপকথন। ফেড্রুস ছিলেন একজন তরুণ এথেন্সবাসী যিনি আন্দোলিত হয়েছিলেন অলঙ্কারশাস্ত্রজ্ঞ দ্বারা। দারিদার বিষয় ছিল প্রেমিক ও অপ্রেমিকের আপাত মূল্য, দর্শন ও অলঙ্কারশাস্ত্রের মর্যাদা এবং লেখা ও বলার মূল্য।
সক্রেটিসের ভাষ্য ছিলো- 'আমার উদ্বেগ বলা এবং লেখা নিয়ে। আমি পরীক্ষা করি সংক্ষিপ্ত ও চূড়ান্ত অধ্যায়। লেখার চেয়ে বলা অধিকরতর শ্রেষ্ঠ।'এই বলে সেক্রটিস
ফেড্রুস নামের তরুণটিকে আশ্বস্ত করেছিলেন। এ-বিষয়ে জাক দারিদার ডিসকোর্স যদিও আমার আলোচ্য বিষয় নয়, তবে তৃতীয় বাংলার এক্স ওয়াই জেড এর কবিতার সাথে রাধারমণ, লালন ফকির বা জন ডানের কবিতার মিল খুঁজে পাওয়া বা তাদের কবিতা বিনির্মাণবাদী বা উত্তরাধুনিকতায় সয়ম্ভূ ইত্যকার প্রথাগত রচনা তৈরি হতে আমাকে নিবৃত করে। আমি বরং উদ্বুদ্ধ হই বৃক্ষের শাখা হতে কুসুম নির্গমন এবং অন্তর্নিহিত প্রসব বেদনার পথে। আমি সাক্ষাৎকার তৈরি করি মৃত কেদার ভাদুরীর। তিনিই আসলে বলতে পারেন- আজ রোদ উঠবে, নারীর রক্তে রোদ লাগবে, ধীরে তা দুধ হয়ে যাবে।’ ‘পাঠাকে ধরে আড়াই পোঁচে যখন বধ করে কসাই তার ছটফটানি লক্ষ্য করেছো কখনো? শুয়োরের জগতে আমি এক পাঠা। কলজে থেকে বেরিয়ে আসে এক নিখাদ যকৃত- রঙ তার সেই নারীটির মতো। আমি ছটফট করি, কাতরাই কেউ কিছু খবর রাখে না। কেননা ঘরে থেকেআমি একা একাই।’
তৃতীয় বাংলার কবিশামীম আজাদের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল- কেন কবিতা লেখেন? কবি হবার জন্যে, জয়দা জামালপুর উন্মোচনের জন্য? প্রত্যুত্তরে একমাত্র তিনিই বলতে পারেন- হত্যাকে হত্যার জন্যে। প্রসঙ্গক্রমে সেদিন কবি দিলু নাসেরকে বললাম- এখানকার যারা কবি প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সংগঠনভূক্ত; কবিতার চাইতে সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে অধিক মনোযোগী। তাঁর উত্তরটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি বললেন, আমাদের লাশও তো এদেশ থেকে যাবে না। কবিতা চর্চার জন্য যে উপযোগিতা প্রয়োজন ওগুলো তো আমাদেরকেই তৈরি করে নিতে হবে। সংগঠন ছাড়া কি কোনো বিকল্প আছে? তাঁর বক্তব্য থেকে আমাদের ডায়াসপুরিক অভিযাত্রাই যেন সয়ম্ভূ হলো। এর মানে এই নয়, আমি সমর্থন করছি মিডিয়াবাজি, হাইপার মিডিয়ার পুরস্কারবাজী ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রায় দেড়যুগ আগের কথা। এদেশে দুজন মানুষের নাম ঘন ঘন শুনি- ফারুক আহমেদ রনি এবং দিলু নাসের। এরা দুজন কবিতা লেখেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ান। তাঁদের কাজগুলো যে অগুরুত্বপূর্ণ ছিল না, দেড় যুগের ব্যবধানে বেশ মোটা দাগেই দৃশ্যমান হচ্ছে। বছরে দু’এক বার কবিতা নিয়ে ঝগড়াঝাটিই হোক আর বাক্য বিনিময়ই হোক বৈঠকখানাতো তৈরি হয়েছে। শামীম আজাদের মতো মূল ধারার কবি এখানে সক্রিয় থাকায় কাব্যাঙ্গন অনেকটাই আলোকিত বলা যায়; আর মুজিব ইরম শুধু ভাল কবিতাই লেখেন না ভাল প্রকাশনাও বোঝেন। প্রকাশিত লিটল ম্যাগগুলোর আকার আকৃতি উপস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে যে হৃদ্ধ কূটকৌশল দৃশ্যমান হচ্ছে এ কৃতিত্ব একমাত্র মুজিব ইরমের। মৃত্যুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে জগৎ সংসারে দুটি পঙক্তি রচিত হয়নি এবং হবেও না। এ অভিজ্ঞতা থাকলে কী রকম হতো আমাদের কাব্যভাষা? নতুন অর্জনের জন্য মনন স্তরকে ইদম পর্যায়ে কি নিয়ে যেতে হবে? শতবর্ষ আগে আমি এই ব্রহ্মাণ্ডে ছিলাম না; আমি কি তবে কবিতা লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিছুদিন পরেও আমি থাকবো না। এজন্য বোধহয় কোনো এক রচনায় বলেছিলাম- আমি যেন কবিতা লিখি মৃত্যুর পরে।
তৃতীয় বাংলার কবিতা লেখেন অনেকেই। তাদের নামের তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। এ তালিকায় সক্রিয় এবং আধুনিকদের নাম সংযুক্ত করে এবং অধিবিদ্যাকেন্দ্রিক কবিদের নাম সতর্কতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছি। সক্রিয় এবং স্বতস্ফূর্ত যে ক’টি নাম সর্বজন বিদিত- কবি শামীম আজাদ, মুজিব ইরম, ফারুক আহমেদ রনি, মাশুক ইবনে আনিস, আতাউর রহমান মিলাদ- এ পাঁচজনকে একটি তালিকায় নিয়েছি। তৎপরবর্তী তালিকায় সুমন সুপান্থ, আবু মকসুদ, মিলটন রহমান, কাজল রশীদ, সৈয়দ আফসার, মনি হক, শাহ শামীম আহমদ,ইকবাল হোসেন বুলবুল, শাহনাজ সুলতানা, ওয়ালী মাহমুদ, খাতুনে জান্নাত, তাবাসুম ফেরদৌস, আনোয়ারুল ইসলাম অভি এই ক’টি নামের অভিনিবেশ হতে পারে। আমার জানার বাইরে অনেকেই হয়তো ভাল লিখছেন তাঁদের নাম উল্লেখ করতে না পারা আমারই পাঠকীয় বোধের সীমাবদ্ধতা এবং এজন্য দু:খ প্রকাশ করছি। এ-তালিকায় দিলু নাসের এবং টিএম কায়সারের নাম থাকলে আমার ভাল লাগত। কায়সারের কাছ থেকে নতুন কোনো কবিতা পাইনি প্রায় ১০ বছর হলো। তারপরও তিনি কবিদের কবি। দিলু নাসেরের ছড়া নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে নুরুল হুদা পর্যন্ত লিখেছেন। তালিকাবদ্ধ না করলেও বলা যায় দিলু নাসের কবিদের কবি। কবি শামীম আজাদ ও মুজিব ইরমকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু বলা যৌক্তিক মনে করিনা; বাংলাসাহিত্যে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের যে মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন তা নিয়ে ভবিষ্যতেঅনুপূক্সক্ষ আলোচিত হবে বলে মনে করি। ফারুক আহমদ রনি, মাশুক ইবনে আনিস, আতাউর রহমান মিলাদ, মুজিব ইরম, শামীম আজাদ এই পাঁচ জনের নাম উল্লেখ করা বিশেষ নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়।
বিলেতে বাঙালি লেখকদের অত্যুজ্জ্বল চিত্রই বলা যায়; ডায়াসপুরিক অভিযাত্রার ভেতর এজন্য আমাদেরকে শতবর্ষ অপেক্ষা করতে হয়েছে। অগ্রজ আবদুল গাফফার চৌধুরী, কেতকী কুশারী ডাইসন, সালেহা চৌধুরী, হিরন্ময় ভট্টাচার্য, কাদের মাহমুদ, দেবব্রত চৌধুরী, ভাস্কর চৌধুরী, গোলাম কাদের , সিকদার কামাল, সৈয়দ শাহীন প্রমুখের অবদান তৃতীয় বাংলার কবিতাসহ অন্যান্য শাখায় অনস্বীকার্য। যদি কথা বলে ফেলো বাতাসে বিলীন হয়ে যায় আর যদি লিখে রাখো বছর বছর থেকে যায়। কনফুসিয়াসের পরামর্শ মতো ইতিহাসবেত্তারা যদি না লিখে যেতেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বা পুওরের কথা আমরা হয়তো জ্ঞাত হতে পারতাম না। হয়তো কোনো কিছু লেখার আগে প্রথমে আমরা বলি তারপর লিখি ইত্যাদি ইত্যাদি। তৃতীয় বাংলার কবিতা নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। অনেকেই কবিতার রাজপুত্র খেতাব পেয়েছেন। ভাগ্যিস! তারা প্রজাপুত্রের খেতাব পাননি! সবার কবিতায় বিনির্মাণবাদী, উত্তরাধুনিকতায় ভরপুর, মরমী ভাবধারায় উজ্জ্বল, সাবানের মতো সুগন্ধি, এই জাতীয় আরামদায়ক আলোচনা অনেক শ্রুত হয়েছি। ভর্ৎসনা করে লাভ নেই। আলোচনা সাহিত্যের দৈন্য শুধু এখানেই নয়, বুদ্ধদেব বসু পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রায় বদ্ধমূল হয়েছে অথচ নতুন সাহিত্যতত্ত্ব, চিন্তার প্রাকরণিক বিকাশ মোটেও থেমে নেই। তত্ত্বগুলো সাহিত্য আলোচনার টুলস বা উপকরণ হিসেবে কেন যে অনেকে এড়িয়ে
যান ভেবে পাইনা। তৃতীয় বাংলার ক্ষেত্রে ডায়াসপুরিক চিন্তা ভাবনাকে কাব্যালোচনার পদ্ধতি বা টুলস হিসেবে ব্যবহার করা আমার কাছে বেশ যৌক্তিকই মনে হয়। এতে করে মূল ভূখণ্ডের কবিতার সাথে এখানকার কবিতার যোগসূত্র যেমন তৈরি হবে তেমনি তৃতীয় বাংলার কবিতা ঢাকা বা কোলকাতার কবিতার চাইতে কতোটা পৃথক, কী তার রঙ-রস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বাংলা কবিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় বহুধা বিস্তৃতি অস্তিত্বশীল হবে।
আরেকটু ব্যাখ্যাত হোক বিষয়টি। আমরা এখানেই মারা যাবো। আমাদের লাশ বাংলাদেশে যাবে না। আমরা চর্চা করি বাংলা ভাষা। কবিতা লিখি বাংলায়। দিনের অর্ধেক সময় কথা বলি ইংরেজী ভাষ্যে। বয়স হিসেব করলে দেখা যাবে জীবনের আশিভাগ সময় কাটিয়ে দিলাম এখানে অথচ এখানকার মূলধারার সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র নেই বললেই চলে। অপেক্ষা করি একুশে বইমেলার। উড়াল দেই ঢাকায়। যাই হাজার পায়ে ফিরে আসি এক পায়ে। মূল ভূখণ্ডের মানুষের সঙ্গে আমাদের চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়ে গেছে। আমরা খেয়ালই করিনি। এতোদিনে আমাদের ভাষাও অনেক বদলে গেছে। ওগুলো চিহ্নিত হওয়া অজরুরী নয়। শব্দ , শব্দব্রহ্ম, শব্দব্রহ্মকেন্দ্রিকতা, কূটকৌশল, বৈপরীত্য, যুগ্ম বৈপরীত্য, শব্দ বা বাক্যের আর্থ সামাজিক কাঠামো, অবকাঠামো, ভাষাকেন্দ্রিক ও চিন্তাকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে মনোসমীক্ষণজাত আলাপ আলোচনা শুধু জরুরি নয়, অনিবার্য বলে মনে করি।
এখানকার একজন গদ্যশিল্পী যখন বলেন ‘তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় একটি ফিউনারেল অনুষ্ঠানে’- এখানে আমরা দৃশ্যকল্প পাচ্ছি- লাশ, সেমিট্রি, মর্গ, কফিন ইত্যাদি
ইত্যাদি। যখন বলবো ‘তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় মৌতা দাফনের দিন’- এটি হলো আমাদের মূল ভূখণ্ডের ভাষা। এখানে মৌতাদাফন ও ফিউনারেল মৌলিক ও এক বিষয় হলেও আচার অনুষ্ঠান আবহ সম্পূর্ণ আলাদা এবং পৃথক। এখানকার কবরের সঙ্গে আমাদের সিন্দুকি
কবরের অমিল রয়েছে অথচ আমরা যারা স্মৃতি বহন করছি শৈশবের স্মৃতিকে যদি ডায়াসপুরিক স্মৃতি বলে সংজ্ঞায়িত করি তাহলে দেখা যাবে আমাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে সিন্দুকী কবর, লাশের খাটিয়া, জুলেখার মুখ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর আইনস্টাইন থেকেই তো আমরা জানি- যে যতো প্রতিভাবান সে ততো তার শৈশবকে উন্মোচন করতে পারে। আর আমার এতো কথা বলার মূল কারণটিই হলো আমাদের চেতনা প্রবাহকে চিহ্নিত করা, কাব্য চিন্তাকে শনাক্ত করা; ঢাকার কবিতা , কোলকাতার কবিতার পাশাপাশি তৃতীয় বাংলার কবিতা পৃথকভাবে আলোচনা করা।
কবি ও কবিতা নিয়ে আমার বিচ্ছিন্নভাবনা ও বিচ্ছেদ জোড়া লাগানো গেলে হয়তো একটা রচনা তৈরি হতে পারে। আমার প্রত্যয়ের খসড়া আপনার ধৈর্য ধারণ করে শুনলেন বিষয়টি স্নিগ্ধ। নিশ্চয়ই আপনারা স্নিগ্ধসম্প্রদায়ভূক্ত।
(সূত্র: বাংলা একাডেমী বইমেলা, যুক্তরাজ্য, জুলাই ২০১০-এ পঠিত)