top of page
Farhana Khanom.jpg

কবি ফারহানা খানম

 

কবিতার মানসকন্যা ফারহানা খানম। কবিতার বিষয়ে তিনি চ্যালেঞ্জিং, অনেকটা কুণ্ঠাবিহীন। কবির অবস্থান কোনভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। চিত্তাকর্ষক কবিতার জন্মদাত্রী ফারহানা খানাম যেমন কবিতার বিষয়কে তার সর্বাত্মক সৃষ্টিশীল মহিমায় উপস্থাপন করে আসছেন, তেমনি তার কবিতায় সারল্য স্বভাব আরো বেশি করে মোহনীয় করে তুলে। বিশেষ করে শব্দ, মাত্রা ও ছন্দের প্রতি তার প্রখরদৃষ্টি এবং কবিতার জন্য পরিমিত  অলঙ্করণ কাব্যবিন্যাসকে ভিন্নস্বাদে আবিষ্ট করে।  

 কবি’র জন্ম ও বেড়ে ওঠা  ঢাকা শহরেই। বর্তমানে বসবাসও ঢাকায়। ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশা শিক্ষকতা। কবিতা লেখেন ছোট বেলা থেকেই তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সুযোগ করে দিয়েছে তার কাব্যিক অবস্থানকে বিস্তৃতি করতে। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ  ইছামতি  কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯১৩ সালে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তৃষ্ণার্ত বালুতট প্রকাশকাল ২০১৬ সাল, অমর একুশে বই মেলায়  অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে  ও অনলাইন পোর্টালে তার কবিতারব্যাপ্তি আমাদের সবার নজরকাড়ে।

কবিতা

দ্বৈরথ

মৃন্ময় কখনো তুমি পাথরের বুকে নিপুণ ভাস্কর্য! অথবা অকর্ষিত পলিতে অযাচিত ঝোপ; যেন বন্ধ্যা মনে জেগে থাকা জ্যোতিষ্মান নক্ষত্রালোক!! জ্যোৎস্না রাতে অন্ধ গায়কের সকরুণ আর্তি। কিংবা জ্যোৎস্নাগ্রস্থ কবির বিহ্বলতা! দেখ আমাদের বসবাস কি আশ্চর্য সংঘাত – সাহচর্যে যেন পড়োবাড়ির উঠোনে জীর্ণ মাচায় তুমুল বেড়ে ওঠা লকলকে লাউলতা। মৃন্ময় তুমি জানো ,জানেনি মন কি বিবর্ণ আহ্লাদে বয়ে যায় নিত্যকার জীবন।

কারাবাস

 

কাটাকুটি খেলায় আমার তেমন আগ্রহ ছিলনা কখনো

তবুও প্রায় দেখতাম বন্ধুদের কাটাকুটি খেলা

স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওরা খাতার পেছনে

ছক কেটে কেটে চিহ্নের পর চিহ্ন বসাতো

বোর্ডে যখন স্যার লিখতেন ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি... 

তখন ছকের ঘরে কেউ শূন্য বসাচ্ছে

আর একজন জয়ের আনন্দে চাপা উল্লাসে ফেটে পড়ছে

দেখতে দেখতে একসময় আমিও হয়ে উঠি মস্ত খেলোয়াড়

ছক দেখলেই বলে দিতে পারি হারজিৎ।

 

আজ জীবন সাজাতে সাজাতে 

আমিও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি কালো ছোপ ছোপ ছকে

ঠিক বলে দিতে পারি কখন ঘোর লাগে

শূন্যতা ঘিরে ধরে চারপাশ; ফাঁদ হয়ে গিলে খায় কারাবাস।

জল জ্যোৎস্নার কোলাহল

সন্তাপে নয় নির্বিকার চিত্তে ঝড় ওঠে কেন? 
অসহায় ক্ষোভ আর শ্রাবণের মেঘে ঘোর বর্ষণ লাগে যেন 

এলোমেলো গর্জন মনের সাম্রাজ্য জুড়ে 
চলে ভীষণ তাণ্ডব।

এক অস্থির সন্ধ্যায় খুলে গিয়েছিল আর্শিগুলো 
বিজলি আলোয় ঝলসে উঠেছিলো ঘাসের বুকে লেখা 
বিধি-নিষেধের ইশতেহার।

ঘুলঘুলি ছেড়ে উড়ে গিয়েছে রক্তাক্ত চড়ুই 
ওড়ে ধুলোঝর যেন দারুণ খরায় পাতা ঝরার উৎসব 
দাপুটে জলেরা চিরে নদীর বুক ভাঙে তীর। 
আজন্মকাল বুকে বয়ে চলা জল 
হয়ত নদীরও জানা ছিলনা কতোটা হিংস্র হতে পারে 
জল জ্যোৎস্নার কোলাহল।

সময় 

জানি সত্যব্রত, খুঁজে পাওনি; নীল খামের সুগন্ধি চিঠিগুলো সম্বোধনটা আছে এপিটাফের মতোই

অনেকটা গড়িয়েছে জল, নেপথ্যের গল্পগুলো তলিয়ে গেছে পলিতে তবু অসঙ্গত কৌতূহলে নেচে ওঠে মন। 
যে ছায়ার আঙুল ছুঁয়ে ছুতে চেয়েছ নৈবের্ত্তিক সময় তা এখন বিলুপ্ত ইতিহাস! 
জানোইতো শিকারের মত পথেরও কিছু ব্যাকরণ থাকে সেই পাঠ ঠিকঠাক জানা ছিলনা আমাদের

তাই পথ হারিয়েছি গলির নিঃশব্দ অন্ধকারে; আলেয়াকে তুমি আলো ভেবেছিলে অথচ পূর্ণিমায় যখন জোয়ার

এসেছিল তুমি আবেগের পাড় ভাঙলে প্রবল আক্রোশে।

তবুও এই ভালো নুয়ে থাকি সনাতন বিশ্বাসে, জমে থাকা জলে করি সমুদ্র-দর্শন ।

ভুল

 

কেন ভেঙেছি জানো? সবটাই ভুল 

একটা চিল ডানা মেলে বলে গেল সব অনধিকার চর্চা ,

স্বপ্নেরা বড় বেশি ভঙ্গুর!

 

নিজেকে টুকরো করে দেখেছি শুধুই পৌনঃপুনিক 

অনিবার্য পরিণতিতে ;  ভেঙেছে আশ্বাস 

ফিরিয়ে নিয়েছি  প্রতিশ্রুতি ...

আমাদের চোখে জল গোপনের বাহুল্য ছিল না 

ছিল প্রশ্নবোধক চিহ্ন ... 

 

দরজার ওপাশ থেকে তুমি সরে গেলে  ধীরপায়ে 

আমিও উপড়ে ফেললাম লালগোলাপের ঝাড় .

স্মৃতির স্তূপ

১. দক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো খুড়ে চলি স্মৃতি স্তূপ নগর -তোরণ পেরিয়ে মনের গভীরে নেমে যাই উপত্যকা ধরে বয়ে গেছে দুঃখ নদী, তীর ঘেঁষে পাইনের বন পাতায় পাতায় শোক আর আকাঙ্ক্ষারা খেলা করে শুকসারি গান গায় দিনমান। হৃদয়ের গাঢ় অন্ধকারে প্রাচীন ওক গাছের নিচে খুঁজে পাই স্মৃতির নগর! পোড়ামাটির ফলকে লেখা এক জীবনের ইতিহাস ডুবে যাই প্রত্ননগরের গোপন রহস্যে আরও গভীরে ছোট্ট পাথরের বুকে আঁকা তোমার ছবিটা এ যেন কালের অকাট্য দলিল! সময়ের পলি জমে জমে অস্পষ্ট মলিন! মনে পরে এখানেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা আদিম আবাস গড়েছিল । নিউরনে জমা স্মৃতি গুলো জেগে ওঠে একসাথে , ফিরে আসি বর্তমানে। হিজলের গাছে রোদ থমকায় গোধূলি এখন দক্ষিণের বারান্দায় উদাসী হাওয়ায় কিছু স্মৃতি ভুল স্বপ্ন বুনে যায় একাকী চড়ুই নিশ্চুপ চেয়ে থাকে দূরে...।

 

২.  জলের তাণ্ডব বুকের ভেতর তোলপাড় করে এক নদী প্রবল উচ্ছ্বাসে আর আক্রোশে একি জলের তাণ্ডব? হলুদ পাতায় ছাওয়া মনোভূমি! আকণ্ঠ তৃষ্ণার সাগর না বলা প্রেমের পদাবলী কিংবা সন্ত্রাসী জ্যোৎস্না পেলব আলোয় গ্রাস করে যখন সমগ্র পৃথিবী! তাণ্ডব মানে কি কৃষ্ণ রাতে বুনোঝোপ থেকে আসা আদিম ঘ্রাণ? জোনাক আলোয় একসাথে থাকা হাজার বছরের অজ্ঞাত ইতিহাস? না কি ভোরের আকাশে উড়ে যাওয়া শালিক-যুগল আনন্দ-আভাস? তাণ্ডব মানে কি? কিশোরীর কলাবতী মন, বিহ্বল দৃষ্টি ! অমীমাংসিত ভালোবাসার প্রগাঢ় চঞ্চলতা , সমুদ্র গর্জন? ঘর -গেরস্থালীর কথকতা? আমি ঠিক জানিনা। ভুঁইফোড় আমি, এসব আমার জানার কথা নয় আমি শুধু জানি কি করে ঢেউ ভাঙে অমাবস্যার ভরা জোয়ারের কালে আমি জানি কি তাণ্ডবে ভাসায় উপকূল জল , জলের অভিঘাতে , তারপর তটভূমে রেখে যায় ধ্বংসের স্মৃতি চিহ্ন। 

 

৩.  শূন্যতা নিশুতি রাতে দূরের বেলাভূমি থেকে ভেসে আসে ঢেউয়ের গর্জন সাথে জলপরিদের নূপুরের বোল, জলের গীত। গাঢ় অন্ধকার যেনো প্রেতের ছায়া; ছায়ায় ভাসে পৈশাচিক প্রলাপ ঝিঁঝিঁর সুর থেমে যায় ভয়ার্ত শুনশান নীরবতায়। নীরবতায় নির্জনতা ভাঙ্গে শূন্যতা, শূন্যতা জানে নির্জনতাকে চূর্ণ করে আঁধার কি করে প্রলম্বিত হয়। সে আধার ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাধ্যাকর্ষণের টান উপেক্ষা করে উঠে যাই ওপর থেকে আরও ওপরে, মহাশূন্যে। ঢুকে পড়ি কৃষ্ণগহ্বরের মহা কন্দরে। বিপন্ন অস্তিত্বে তখন চেতনালুপ্ত প্রায় ফাঁপা অনুভূতিতে আর্তনাদ করে একাকীত্ব। প্রারন্ধ অস্তিত্বে কেঁপে ওঠে মহাকালের হাওয়ায়, প্রলাপ থেমে যায় দূর আকাশে সূক্ষ্ম আলো! আলোর বৃত্ত অন্ধকারের প্রচ্ছদে আঁকে পাহাড় পাহাড়ের বুক কেটে বয়ে যাওয়া ঝর্না আর কাঁচপোকাদের উৎসব। 

 

৪.  প্রত্যাবর্তন অনিবার্য নয় প্রত্যাবর্তন অনিবার্য নয় চলে যাওটাই সত্য এই বিশ্বাসে চলে গিয়েছিলাম পাহাড়ের দেশে বিভক্তিতে বিশ্বাস ছিলনা তবু রোধ করা যায়না ভাঙ্গন রোজ দেখি প্রকৃতিও ভাঙ্গে পাহাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়ে সমতলে টুকরো পাতার ছায়ারা নকশা আঁকে মাঠে দীর্ঘ বৃক্ষের ছায়াও মিশে যায় অনেক ছায়ার সাথে। এভাবেই একটা জীবন মিশে যায় অনেক জীবনে এখানে সত্য ভাঙ্গে, সত্য গড়ে আপন নিয়মে আর মিথ্যেরা ব্যঞ্জনা পায় গতানুগতিক পথে। ক্ষণস্থায়ী বিকেলর রোদে বৈরাগ্য ছিল প্রকট এভিনিউ ধরে হেঁটে যেতে যেতে মনে হয় কারো কারো মনে সন্ন্যাস থাকে আর তার চলে যাওয়াটাই ধ্রুব।

নিপুণ কবিতা

একরঙা মোটা শাড়িতেও বড্ড সুন্দর দেখায় ওকে বেশ ফুটে ওঠে সুডৌল গড়ন লোভাতুর শকুনেরা চেটে খায় রোদজ্বলা শরীরের লাবণ্য। আতপ্ত দুপুর , শিশুটিকে বুকে ধরে অসহায় দৃষ্টিতে খোঁজে স্বস্তির আশ্রয়! অশ্বত্থের ডালে চনমনে রোদ ; বয়ে যাওয়া হাওয়ায় স্তব্ধতা! অনন্য ফাঁকিতে কেটেছে কিশোরী কাল। একফালি মেঘে স্বপ্ন বোনা ছিল , বর্ষাজলে ভেসে গেছে , হিসেব মেলেনি। জঠরে বীজ বুনে চলে গেছে কীট। ফুরিয়ে গেছে বসন্ত, ছটফটানি চৈত্র তেষ্টায় কালের ছোবলে ঝুলিতে জমেছে কিছু ধিক্কার আর লাঞ্ছনা। পাতে ধরে দিলে নুন আর লঙ্কা মাখা ভাত মেয়েটির ক্ষুধার্ত চোখে ফোটে খুশির ঝিলিক!সস্তা ললিপপে শিশুটির মুখে স্নিগ্ধ হাসি। পরিতৃপ্ত মুখ আর শিশুর নিষ্পাপ হাসি এমন নিপুণ কবিতা আমি দেখিনি কখনো।  

bottom of page