সরদার ফারুক
ছন্দের প্রয়োজনীয়তা
যদিও গদ্যছন্দ বলে একটা ছন্দ আছে, এবং সমর সেনসহ অনেক বিখ্যাত কবিই গদ্যছন্দে লিখেছেন, তবু আমি মনে করি ছন্দের প্রয়োজন কখনো ফুরোয়নি আর ফুরোবেও না। কবিতায় আমরা যে দোলা বা স্পন্দের কথা বলি তা এই ছন্দ থেকেই আসে। অনেকে ছন্দকে বন্ধন মনে করে বন্ধনমুক্তিতে বিশ্বাসী। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি-রবীন্দ্রনাথ সেতারের উদাহরন দিয়েছিলেন। সেতারের তারের বন্ধনেই সুরের মুক্তি। বন্ধনে মুক্তি অদ্ভুত শোনালেও চূড়ান্ত মুক্তি মানে বিশৃঙ্খলা। ছন্দে লিখুন বা না-ই লিখুন, জেনে রাখাটা দরকার। এটা কোনও আকাদেমিক আলোচনা না, কেবল একটা সহজ গাইড লাইন।
৩ ধরনের ছন্দ
আপনারা নিশ্চয় জানেন বাংলা কবিতার ছন্দকে মোটামুটি তিন ধরনের বলে ধরে নেয়া হয়, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত। মাত্রাবিচারের রীতিভেদে ছন্দও পাল্টে যায়।
মাত্রা কাকে বলে?
সোজা কথাই মাত্রা মানে পরিমাপক অর্থাৎ ইউনিট অফ মেজার। জল মাপি লিটারে, কাপড় মাপি মিটারে আর ছন্দ মাপি মাত্রায়। কবিতার এক-একটি পংক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং তাকে উচ্চারন করার জন্য মোট যে সময় আমরা নিয়ে থাকি, সেই উচ্চারনকালের ক্ষুদ্রতম এক-একটা অংশই হল মাত্রা। প্রবোধচন্দ্র সেন তারই নাম দিয়েছেন কলা। কলা মানে এখানে অংশ। ষোল কলায় যেভাবে চাঁদ পূর্ণ হয়, তেমনি কলা বা মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তৈরি হয় পূর্ণ এক-একটি পংক্তি (লাইন) উচ্চারনকাল।
কঠিন লাগছে? আরো সোজা ভাবেই মাত্রাবিচারের পদ্ধতি নিচে আলোচনা করবো।
অক্ষরবৃত্ত
বাংলা কবিতার খুবই বনেদি ছন্দ। রবীন্দ্রনাথের আগে, রবীন্দ্র কাব্যের সূচনাপর্বেও বাংলা কবিতা প্রধানত অক্ষরবৃত্তেই লেখা হয়েছে, এবং বিস্ময়করভাবে এখন পর্যন্ত অক্ষরবৃত্ত তার শীর্ষ আসন ধরে রেখেছে।
জীবনানন্দের গ্রণ্হভূক্ত কবিতার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো। এই মোট ৩৫২টি কবিতার ২৭৫টি অক্ষরবৃত্তে, মাত্রাবৃত্তে ১৬টি, স্বরবৃত্তে ৩৭টি এবং গদ্যছন্দে ২৪টি। ভেবে দেখুন!
আমার জানা মতে বিনয় মজুমদার তাঁর সমস্ত কবিতা অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন (উনি অবশ্য পয়ার বলতেন)। আমারতো মনে হয়, একজন কবি শুধু অক্ষরবৃত্তে লিখেই কবিজীবন পার করে দিতে পারেন।
অক্ষরবৃত্তের মাত্রাগণনা
অক্ষরবৃত্তের লক্ষণ কী? লক্ষণ মোটামুটি এই যে, এ ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ, তত মাত্রা অর্থাৎ কিনা প্রতিটি অক্ষরই এখানে ১টি মাত্রার মর্যাদা পেয়ে থাকে, যেমন-
১/ শ্যামল সুন্দর প্রভু কমললোচন (১৪ মাত্রা -গুণে দেখুন)
২/ পোড়া প্রণয়ের বুঝি জরামৃত্যু নাই (১৪ মাত্রা)
বিনয় মজুমদারের সহজ ফর্মুলা-
“বাংলা অক্ষরের উপরে যে মাত্রা দেয়া আছে আমি তাকেই মাত্রা বলি। যথা, ‘অ’ অক্ষরের উপরমাত্রা দেয়া আছে, সুতরাং অ অক্ষরে একটি মাত্রা। ‘ত’ অক্ষরে মাত্রা দেয়া আছে সুতরাং ত অক্ষরে একটি মাত্রা। ‘স্ক’ ‘ল্ল’ ইত্যাদিতেও একটি মাত্রা। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্তে যুক্তাক্ষরেও একটিই মাত্রা। ‘ৎ’ তে মাত্রা নেই, তাই ‘উৎফুল্ল’ অক্ষরবৃত্তে ৩ মাত্রা, ‘হঠাৎ’ ২ মাত্রা। তিনটি অক্ষরও যদি যুক্ত থাকে যেমন ‘উজ্জ্বলে’ –‘জ্জ্ব’ কে এক মাত্রা গণনা করে মোট ৩ মাত্রা হবে।”
এটাই নির্ভুল ও প্রাথমিক নিয়ম। অবশ্য এর পরেও অল্প কিছু ছোটো নিয়ম আছে।
স্বরবর্ণে ‘এ’ অক্ষরে, ‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। কিন্তু ‘এ’ অক্ষরে সর্বদাই এক মাত্রা ধরতে হবে, যেমন ‘এসো’ ২ মাত্রা। ‘এখন’ ৩ মাত্রা ।
‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। তবে অধিকাংশ শব্দেই ‘ও’ অক্ষরে একমাত্রা ধরতে হবে। অল্প কয়েকটি শব্দে ‘ও’ অক্ষরে শূন্য মাত্রা। ‘ওঠ’ ২ মাত্রা, কিন্তু ‘হাওয়া’, ‘যাওয়া’, ‘খাওয়া’, ‘চাওয়া (অর্থাৎ- শব্দের শেষে ‘ওয়া’ থাকলে) ‘ও’ শূন্য মাত্রা। এগুলোকে ২ মাত্রা বলেই গণ্য করতে হবে।”
*(কেন করতে হবে সে বিশদ ব্যাখ্যাই না গিয়ে কেবল এই শব্দগুলো মনে রাখতে বলছি )
“এবার ব্যঞ্জনবর্ণ। ব্যঞ্জনবর্ণে প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘ঙ’ এবং ‘ৎ’ – এই দুটি অক্ষরের উপরে মাত্রা আঁকা হয়না। বাঙ্ময়, কঙ্কাল, অঙ্ক এবং অনুরূপ সব শব্দে ‘ঙ’ অক্ষরের সঙ্গে অন্য অক্ষর যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর তৈরি হবার ফলে এই যুক্তাক্ষরে এক মাত্রা। অর্থাৎ ‘কঙ্কাল ‘ ৩ মাত্রা, ‘অঙ্ক’ ২ মাত্রা।
তবে শব্দের শেষে ‘ঙ’ থাকলে ‘ঙ’ অক্ষরে সর্বদাই একমাত্রা ধরতে হবে। যেমন- ‘রঙ’ ২ মাত্রা।
‘ৎ’ শব্দের মাঝে থাকলে শূন্যমাত্রা। যেমন ‘উৎপ্রেক্ষা’ ৩ মাত্রা। আবার শব্দের শেষে থাকলে ‘ৎ’ ১ মাত্রা দাবি করে, যেমন ‘প্রদোৎ’ ৩ মাত্রা, ‘হঠাৎ’ ৩ মাত্রা।”
“মাত্রা গণনার নিয়মাবলী এখানে সমাপ্ত। বাংলা অভিধানের এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার-এর অধিক শব্দগুলির মাত্রাগণনা এই অল্প কটি নিয়ম দিয়েই আমি সারা জীবন করেছি ।”
আমরা অক্ষরবৃত্তে মাত্রা গণনার নিয়ম আলোচনা করেছি। এবারে একটি পংক্তিতে (লাইনে) কয় মাত্রা বসানো যায় সেকথা বলছি। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চাল আসলে ৪ মাত্রার চাল। প্রতিটি পর্বে (অংশে) থাকে ৪টি মাত্রা, শেষে থাকে ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব। সোজা কথায় অক্ষরবৃত্তে মাত্রাসংখ্যার ফর্মুলা হচ্ছে ৪ এর গুণিতক +২।
যেমন :
৪ x ১ +২ = ৬
৪ x ২ + ২ = ১০
৪ x ৩ + ২ = ১৪
এই নিয়মে ১৮, ২২ , ২৬ , ৩০ এভাবে মাত্রাসংখ্যা হতে পারে। অবশ্য অত বড়ো লাইন কেবল জীবনানন্দ দাশই লিখে গেছেন।
*৬ মাত্রার পংক্তি ভেঙে দেখাই —
খেলাঘর / ভাঙে
ঝড়ের আ / ঘাতে।
*১০ মাত্রা ভেঙে দেখাই —
মুখ নেই, / লোভ ফুটে / আছে ;
শিকারীর / সহজ উ / দ্যম
নিরঙ্কুশ / সফলতা / আছে।
(উদাহরনগুলো এই অকবির রচনা বলে ভাল নাও লাগতে পারে)
*১৪ মাত্রা ভেঙে দেখাচ্ছি —
সহসাই / ফুঁসে ওঠে / কুলীন গো / ক্ষুর
অন্ধ রোষে / বিষ ঢালে / নরম মা/ টিতে।
* ১৮ মাত্রার উদাহরন—
বজ্রের উ / ল্লাসে খোলে / বৃক্ষদের / তৃষ্ণার দ / রোজা।
*২২ মাত্রার উদাহরন বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে —
সুদূর স / মূদ্রজলে / একটি গী / টার ভেসে / চলেছে এ / খন
যখন স / কলে ডুবে / নিশ্চিহ্ন হ / য়েছে / সব হারিয়ে গি / য়েছে ।
আর উদাহরন বাড়াবো না। আপনারা ২৬ মাত্রা এমনকি ৩০ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে নিজেরাই খুঁজে বের করুন ।
আরো কিছু জরুরী কৌশল
এভাবে ৪ মাত্রা করে লিখতে গেলে পাগল হয়ে যাবেন। তাই সহজ কায়দা হলো- দুটো মহাপর্বে লাইনটাকে ভাগ করে নেয়া। প্রথম মহাপর্বে থাকবে ৮মাত্রা, বাকি মাত্রাগুলো পরের মহাপর্বে। অর্থাৎ ভাঙতে হবে নিচের নিয়মে।
(*৬ মাত্রা এভাবে ভাঙার কিছু নেই )
১০ মাত্রা=৮+২
১৪ মাত্রা= ৮+৬
১৮ মাত্রা+৮+১০
২২ মাত্রা=৮+১৪
এইভাবে বাকিগুলো আপনারা ভেঙে নিন।
এই নিয়মে ভাঙলে লাইনের নতুন চেহারা হবে–
সম্রাজ্ঞীর মতো চোখে / তার খেলা করে
অযুত গোলাপ, আর / পাতক কীটেরা
কুরে কুরে খায় সেই / চোখের ঐশ্বর্য
তীব্র হিমে ক্ষয়ে যায় / ফুলের প্রতিভা।
(অধমের অক্ষম কবিতাকে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।)
এরপরে সবচে’ জরুরী কথা হচ্ছে, প্রথম ৮ মাত্রার মহাপর্বকে না ভাঙার চেষ্টা করবেন। যেমন এভাবে ভাঙবেন না —
তোমাদের এখানে পা / হাড়ী ঝর্ণা আছে?
*এভাবে ভাঙলে একবারে অশুদ্ধ হবেনা, তবে পাঠকের পড়তে কষ্ট হবে। তাই যতটা সম্ভব ৮ মাত্রার প্রথম মহাপর্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টা করবেন।
অক্ষরবৃত্তের আরো কিছু নিয়ম
শব্দের পরে শব্দ গাঁথারও একটা নিয়ম আছে। ছন্দের জাদুকর নামে খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একটা সোজা কথা বলে দিয়েছেন– বিজোড়ে বিজোড় গাঁথো, জোড়ে গাঁথো জোড়।
অর্থাৎ বিজোড় শব্দের সাথে বিজোড় শব্দ এবং জোড় শব্দের সাথে জোড় শব্দ ব্যবহার করবেন। কেন করবেন? কারন তাহলে পাঠকের কান আহত হয়না।
কখনো নিচের নিয়মে সাজাবেন না–
৩+২+৩, ৫+২+১, ২+৩+৩, কেউ কেউ অবশ্য ৫+৩ ও নিষেধ করেন। অবশ্য ৩+৫ ঠিক আছে।
আপাতত অক্ষরবৃত্তের নিয়মের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এটুকু আস্তে আস্তে অনুশীলন করুন। অল্প কিছু কথা বাকি কিস্তিতে দিয়ে দেবো। অবশ্য এই আলোচনাটুকুও আমার কাছে যথেষ্ট মনে হয়।
জরুরী একটা ভুলে বসে আছি। এখন অক্ষরবৃত্ত বেশির ভাগই অমিল মুক্তকে লেখা হয়। অমিল তো বুঝতেই পারছেন অন্ত্যমিল নেই (অবশ্য অন্ত্যমিলেও দারুণ কবিতা লেখা যায়), আর মুক্তক মানে বিভিন্ন লাইনের বিভিন্ন দৈর্ঘ্য হতে পারে একই কবিতায়। যেমন এক লাইনে ১৪, আবার পরের লাইনে ১০, তারপর আবার ৬ কিংবা ১৮, কবির প্রয়োজনে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
ভূমিকা:
বন্ধুরা, আমরা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা মোটামুটি শেষ করেছি। এবারে আমরা মাত্রাবৃত্ত নিয়ে কথা বলবো। প্রথমেই বলে নেই, এই পদ্ধতি অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির থেকে ভিন্নতর। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছন্দ শেখার যে সহজ ফর্মুলা দিয়েছেন তা থেকেই মূলত আমি আমার মতো করে সংক্ষেপে মাত্রাবৃত্তের নিয়মগুলো তুলে দিচ্ছি। তবে এও বলে রাখি- স্বরবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রে কিন্তু এইসব সহজ ফর্মুলায় চলবেনা, সেক্ষেত্রে সিলেবল বা দল (মুক্তদল ও রুদ্ধদল) দিয়েই মাত্রার হিসাব করতে হবে। ওখানে আর অক্ষর দিয়ে হিসাবের সহজ কায়দা চলবেনা। সিলেবল হচ্ছে উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট বা একক। অর্থাৎ স্বরবৃত্তে আর চোখের হিসাব চলবেনা, কানের বিচারে চলতে হবে বেশি করে।
আমি সহজ ফর্মুলার লোক, তাই মাত্রাবৃত্ত পর্যন্ত গিয়েই থেমে যাব। স্বরবৃত্ত নিয়ে যেহেতু নতুন কায়দা খুঁজে পাইনি, সেহেতু ওটা নিয়ে আপাতত আলচনা করছি না। আমার উদ্দেশ্য নিশ্চয় বুঝতে পারছেন? বাংলা কবিতার প্রধান ৩ ছন্দের মধ্যে যদি ২টি ছন্দের সোজা পদ্ধতি যদি আমরা জেনে নিতে পারি, আর কী চাই?
বাংলা কবিতার সিংহভাগ এখনো এই দুটো ছন্দেই লেখা হয়। ছড়ার ছন্দটি স্বরবৃত্তের, ওটা আপাতত আলোচনা করছি না- তবে স্বরবৃত্তে জীবনানন্দ দাশসহ অনেক কবিই সার্থক কবিতা লিখেছেন। যাহোক, আমি নিজে অবশ্য একটাও লিখিনি।
মাত্রাবৃত্তে মাত্রা গণনা :
অক্ষরবৃত্তে আমরা মোটের ওপর (কিছু ব্যতিক্রম আগেই উল্লেখ করেছি) যত অক্ষর তত মাত্রা এই ফর্মুলায় চলেছি। যুক্তাক্ষরকেও এখানে আমরা ১ মাত্রা দিয়েছি। তবে মাত্রাবৃত্তে যুক্তাক্ষরকে কিন্তু পূর্ণ মূল্য দিতে হবে, অর্থাৎ ২ মাত্রা দিতে হবে। অনেকেই তাই মাত্রাবৃত্তকে ‘যুক্তাক্ষর ভাঙা ছন্দ’ বলে অভিহিত করেন। একটা উদাহরন দেই–‘কষ্ট ’ শব্দটি অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা, কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ভেঙে গিয়ে হবে ‘ক ষ্ ট’ – ৩ মাত্রা। বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়? আরেকটা বলি- ‘ছন্দ’ অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা, আর মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা (ছ ন্ দ )।
তবে এখানেও একটা ব্যতিক্রম মনে রাখতে হবে। তা হচ্ছে শব্দের প্রথমে কোন যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা ভাঙা সম্ভব নয়, সে কারনে মাত্রাবৃত্তেও সে ১ মাত্রাই পাবে। বোঝেন নি? ধরুন ‘ক্লাস’ শব্দটি। এটি কিন্তু অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত দুই ছন্দেই ২ মাত্রা পাবে। কারণ শব্দের শুরুতেই যুক্তাক্ষর ‘ক্ল’ কে ভাঙা যাচ্ছেনা।
তাহলে সোজা কথায় আমরা জানলাম- শব্দের মাঝখানে অথবা শেষের যুক্তাক্ষরকে আমরা মাত্রাবৃত্তে ২ মাত্রার মর্যাদা দেব, আবারও বলি শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে ১ মাত্রা-ই দেব।
রবীন্দ্রনাথই এই ছন্দের স্রষ্টা। ‘মানসী’ পর্বের কবিতা থেকেই এই ছন্দের সূচনা। ‘মানসী’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।” বোঝাই যায়, এখানে পূর্ণ মূল্য বলতে ২ মাত্রার মূল্য।
যুক্তাক্ষরের বাড়তি বোঝা নিয়ে অক্ষরবৃত্ত যদি হাতির চালে চলে, মাত্রাবৃত্ত চলে তেজী ঘোড়ার মতো।
অক্ষরবৃত্ত জোড়া দিতে চায়, মাত্রাবৃত্ত চায় ভাঙতে।
মাত্রাবৃত্তের নানারকম চাল
আমরা অক্ষরবৃত্তকে দেখেছি ৪ এর চালে চলতে। এর লাইন তৈরি করেছি ৪ এর গুণিতক + ২ দিয়ে। এখানে মাত্রাসংখ্যা সব সময় আমরা ৪ যোগ করে বাড়িয়েছি, যেমন- ৬, ১০, ১৪, ১৮, ২২ – মনে আছে নিশ্চয়? কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন করতে পারেন ওখানে আবার +২ কেন বাপু? এরও কারন আছে, ছন্দোগুরুরা এম্নি এম্নি এই বাড়তি ২ মাত্রা সবখানে রাখেননি। কবিতা পড়তে পড়তে একটু দম ফেলার অবকাশ চাই, একটানা ছুটতে গেলে নাভিশ্বাস উঠে যেত। ঐ ২ মাত্রাতেই সেই দম ফেলার জায়গা।
বাড়তি ২ মাত্রা না থাকলে এ রকম হতো :
বাজে লক্ষ ঢাকঢোল
চতুর্দিকে হট্টগোল ।
আর সহ্য হয় কত,
প্রাণ হল ওষ্ঠাগত।
ভক্তেরা বিষম খান,
দলে দলে মূর্ছা যান।
–দাঁড়ি-কমা থাকা সত্ত্বেও লাইনের শেষে দাঁড়ানো যাচ্ছেনা। ছন্দের তাড়না প্রবল হয়ে পাঠককে পাগলের মতো ছুটিয়ে মারছে।
অক্ষরবৃত্তের চাল কেবল ৪ মাত্রার চাল, তবে মাত্রাবৃত্তের চাল কিন্তু এক ধরনের নয়। হ্যাঁ, মাত্রাবৃত্ত নানান চালে চলে।
এখানে অক্ষরবৃত্তের মতো ৪ মাত্রার চালের পাশাপাশি ৫ মাত্রার চাল, ৬ মাত্রার চাল, আর ৭ মাত্রার চাল আছে।
লাইনের এক-একটা অংশে বা পর্বে মাত্রাসংখ্যা দিয়েই আমরা বিচার করবো, কোনটা কত মাত্রার চাল। কঠিন লাগছে? আরে ভাই, উদাহরন দিতে শুরু করলে দেখবেন পানির মতো!
মাত্রাবৃত্তে ৪ মাত্রার চাল
একটা বানিয়ে ফেলি—
নির্জন রাত্রিতে কাকে তুমি ডাকো ?
কান্নার জল দিয়ে কার ছবি আঁকো !
ভেঙে দেখাই—
নির্জন / রাত্রিতে / কাকে তুমি / ডাকো ?
কান্নার / জল দিয়ে / কার ছবি / আঁকো?
(ইসরে, কাঁচা পদ্য একেবারে! যাক বাপু ছন্দ বোঝা গেলেই চলে। এখানে নির্জন = নি র্ জ ন, রাত্রিতে = রা ত্ রি তে, কান্নার = কা ন্ না র)
*এখানে কী দেখছি? ৩ টে করে ৪ মাত্রার পর্ব (অংশ) প্রত্যেক লাইনে, শেষে একটা ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব। ভাঙা বলছি এ জন্য যে, এটি ৪ মাত্রার তো আর নয়।
যাহোক, মাত্রাবৃত্তে এই ভাঙা পর্ব আপনি রাখতেও পারেন, নাও পারেন। ভাঙা পর্বের মাত্রাসংখ্যা ১, ২ বা ৩ – আপনার ইচ্ছেমতো রাখতে পারেন।
আরেকটা উদাহরন তৈরি করা যাক–
অস্ফুটে বলেছে সে কী,
আমি তার কিছু শুনিনি।
*ভেঙে দেখি চেহারাটা–
অস্ফুটে / বলেছে সে / কী,
আমি তার / কিছু শুনি / নি
** অস্ফুটে (অ স্ ফু টে – ৪ মাত্রা)। এখানে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক লাইনে ২টা করে ৪ মাত্রার পর্ব, আর একটি করে ১ মাত্রার ভাঙা পর্ব।
তাহলে বোঝা গেল প্রতি লাইনে পর্বের সংখ্যা আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। ভাঙা পর্বেও বৈচিত্র্য আনতে পারেন। ইচ্ছে করলে প্রতিটি লাইন শেষে একই মাত্রার আবার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার ভাঙা পর্ব রাখতে পারেন (১,২,৩) ,আবার নাও রাখতে পারেন।
আর একটা কথা- অন্ত্যমিল রাখা না রাখাও কিন্তু আপনার ব্যাপার।
মাত্রাবৃত্তে ৫ মাত্রার ছন্দ
এবারে ৫ মাত্রার কিছু দৃষ্টান্ত দেয়া যাক-
তোমার চোখে কিসের ছায়া গভীর কালো?
ছিন্ন পাতা ঝরে পড়ছে হাওয়ার হাতে;
কোথাও যেন মেঘ জমেছে বিষণ্নতার
কেউ জানেনা কারনটা কী মন খারাপের।
পর্ব হিসাবে ভাঙলে এ রকম দাঁড়াবে:
তোমার চোখে / কিসের ছায়া / গভীর কালো?
ছিন্ন পাতা / ঝরে পড়ছে / হাওয়ার হা / তে;
কোথাও যেন / মেঘ জমেছে / বিষণ্নতা / র
কেউ জানেনা / কারনটা কী / মন খারাপে / র।
* প্রতি লাইনে ৫ মাত্রার ৩টি করে পর্ব। প্রথম লাইনে ভাঙা পর্ব নেই। অন্যগুলোতে ১ মাত্রার ভাঙা পর্ব। (ছিন্ন = ছি ন্ ন / ৩ মাত্রা, বিষণ্নতা = বি ষ ণ্ ন তা / ৫ মাত্রা )।
এই দুর্বল কবিতায় মন না ভরলে ভাল একটা কবিতা দেই :
আসতে-যেতে এখনো তুলি চোখ
রেলিঙে আর দেখিনা নীল শাড়ি।
কোথায় যেন জমেছে কিছু শোক,
ভেঙেছ খেলা সহসা দিয়ে আড়ি।
এখন সব স্তব্ধ নিরালোক;
অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে বাড়ি।
—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
ভেঙে দেখালে—
আসতে-যেতে / এখনো তুলি / চোখ
রেলিঙে আর / দেখিনা নীল / শাড়ি ।
কোথায় যেন / জমেছে কিছু / শোক,
ভেঙেছ খেলা / সহসা দিয়ে / আড়ি।
এখন সব / স্তব্ধ নিরা / লোক;
অন্ধকারে / ঘুমিয়ে আছে / বাড়ি।
*দুটো করে ৫ মাত্রার পর্ব সাথে ২ মাত্রার ভাঙা পর্ব।
আগেই মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে আমরা ঘোড়ার চালের সাথে তুলনা করেছি। আপনারা সবাই নিশ্চয় অশ্বখুরধ্বনি শুনেছেন? ৪ মাত্রার চাল এর ধ্বনি যদি হয় খট্ খট্, খট্, খট্; ৫ মাত্রার ধ্বনি তবে খটাশ খট্, খটাশ খট্। অন্য কথায় বলা যায়- বেজোড় জোড়, বেজোড় জোড়। মাঝে মাঝে অবশ্য জোড়-বেজোড় হয়ে গেলে তেমন কিছু দোষের নয়।
মাত্রাবৃত্তে ৬ মাত্রার ছন্দ
উদাহরন দেয়া যাক :
খেলার মধ্যে ভুল হলে আর নতুন খেলার
সুযোগ তো নেই। তলিয়ে যাচ্ছো ভুল আবর্তে,
আসবেনা কেউ অন্ধকারের অতল গুহায়।
*খুব একটা সুবিধার হলনা। তবু এখানে দুটো বিষয় দেখাচ্ছি- ১/ ভাঙা পর্ব রাখিনি, ২/অন্ত্যমিল রাখিনি। ভেঙেদেখাবো না কি আপনারাই ভেঙে দেখবেন?
আরেকটা উদাহরন দেই। এবারে নীরেন্দ্রনাথ থেকে :
যন্ত্রণা থেকে আনন্দ জেগে ওঠে
শোক সান্ত্বনা হয়;
কাঁটার ঊর্ধ্বে গোলাপের মতো ফোটে
সমস্ত পরাজয়।
ভাঙলে—
যন্ত্রণা থেকে / আনন্দ জেগে / ওঠে
শোক সান্ত্বনা / হয় ;
কাঁটার ঊর্ধ্বে / গোলাপের মতো / ফোটে
সমস্ত পরা / জয় ।
*এখানে দেখলাম সব লাইনে পর্বসংখ্যা সমান নয়। প্রথম আর ৩য় লাইনে ২টি করে পর্ব, কিন্তু ২য় আর ৪র্থ লাইনে ১টি করে পর্ব। আবার অন্ত্যমিলেও বৈচিত্র্য- ১ম-৩য়, ২য়-৪র্থ। ভাঙা পর্ব অবশ্য সবখানেই ২ মাত্রার। পর্বসংখ্যায় এই বৈবিচিত্র্যের নিরীক্ষাটি অবশ্য রবীন্দ্রনাথের আগেই শুরু করেন কবি বিষ্ণু দে।
৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত
এটা শেষ করতে পারলে এই যাত্রা বেঁচে যাই। ৪, ৫, ৬ মাত্রার তুলনায় ৭ মাত্রায় লেখা কবিতার সংখ্যা খুব কম। রবীন্দ্রনাথের পরেও অনেকে ৭ মাত্রায় লিখেছেন, তবে আজকাল তেমন একটা দেখিনা।
একটা উদাহরন দিয়েই কেটে পড়বো :
কে যেন বারেবারে তার
পুরনো নাম ধরে ডাকে;
বেড়ায় পায়েপায়ে, আর
কাঁধের পরে হাত রাখে।
ভাঙলে এ রকম–
কে যেন বারেবারে / তার
পুরনো নাম ধরে / ডাকে;
বেড়ায় পায়েপায়ে, / আর
কাঁধের পরে হাত / রাখে।
আপাতত এখানেই শেষ করছি। এরপরে সময় পেলে ছন্দের নানারকম নিরীক্ষা নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে আছে। যারা বিষয়গুলো আরও ভালভাবে জানেন, তাঁদের অংশগ্রহণে আরও শিখতে পারবো আশা করি।
সহায়ক গ্রন্থ –
১। কবিতার ক্লাস – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
২। ছন্দের বারান্দা – শঙ্খ ঘোষ
৩। ঈশ্বরীর স্বরচিত ও অন্যান্য নিবন্ধ – বিনয় মজুমদার
ছড়ার ছন্দ ও মিল এবং শব্দ প্রয়োগ
খালেক বিন জয়েনউদদীন
ছড়ার রয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার বিকাশ ও উত্কর্ষ আমাদের বারবার চোখে পড়ছে। বাংলা সাহিত্যের আদি সৃষ্টি বা নিদর্শন চর্যাগীতির প্রথম পদটি ছড়ার মূল ছন্দ স্বরবৃত্তে লেখা এবং এটি ছন্দ-মিলে রচিত। এই পদটি বাংলা সাহিত্যের আদি ছড়া বললেও ভুল হবে না।
আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মুখে মুখে এবং ছড়াই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। সাহিত্য লেখ্যরূপে পাওয়ার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত। লোক সমাজে ছড়াই ছিল ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। গদ্য সাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়ারে লৌকিক সাহিত্য বলে বিবেচিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন—’ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য’। আধুনিক সাহিত্যিকগণ এসব অভিধান মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—ছড়া বাংলা সাহিত্যের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো একটি প্রয়োজনীয় শাখা। এই শাখাটি অন্যান্য শাখার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্যতা সহজেই ধরা পড়ে।
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তার ‘লোক সাহিত্য’ গ্রন্থে ছড়াকে লৌকিক ছড়া, সাহিত্যিক ছড়া ও আধুনিক ছড়া—এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যে এই তিন শ্রেণীর ছড়াই বর্তমান। লৌকিক ছড়ায় রচয়িতার নাম নেই। সাহিত্যিক ছড়ার উপশ্রেণী শিশুতোষ ছড়া আর আধুনিক ছড়া কালের কৌশলকে মেজাজ ও রস বহন করে। তবে আধুনিক ছড়া সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে, বলা হয়—সমাজ সচেতন বা সমাজ বাস্তবতাকে নিয়ে রচিত ছড়াই আধুনিক ছড়া। এ কালের সাহিত্য গবেষকরা জোর গলায় বলে থাকেন—ছড়া কাস্মিনকালেও ছেলেভোলানো বা শিশুতোষ ছিল না। এমনকি শিশুদের জন্য কখনও সৃষ্টি হয়নি। তবে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে শিশুদের কাছে। আর যেহেতু ছড়া মুখে কাটার বিষয়, সেহেতু ছন্দ-মিলের বিষয়টি শিশুদের কাছে বেশি পছন্দনীয়। তাই বলে চর্যাগীতিকার প্রথম পদটি কি ছোটদের জন্য রচিত? কিংবা বর্গী-তাড়ানো ছড়া ‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো’ ছড়াটি বর্গীর ভয়ের কথা বলা হলেও এটি ঐতিহাসিক বিষয়কে নিয়ে কোনো এক অজানা ছড়াকার ছড়া কেটেছিলেন। এই ছড়াটি টিকে আছে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে এবং মানুষের মুখে মুখে।
১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন এবং গ্রন্থটির নাম দেন ‘খুকুমণির ছড়া’ এই গ্রন্থটির ভূমিকায় সর্বপ্রথম রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলিত করে ছড়ার গ্রহণযোগ্যতাকে মজবুত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ছড়া-সম্রাট সুকুমার রায় ছড়ার বিভাজন করেন ঠিকই, কিন্তু তাদের ছড়ার সমাজ বাস্তবতা খুব সচেতনভাবে ধরা পড়েছে। কবি জসিম উদ্দীন, সুনির্মল বসু, অন্নদাশংকর রায় প্রমুখের ছড়া-কবিতা বহুল পঠিত ও সমাদৃত।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর অন্নদাশঙ্কর রায় সমাজ বাস্তবতাকে নিয়ে প্রচুর ছড়া-কবিতা লেখেন। কিন্তু পূর্ববাংলার ছড়া লেখকগণ এই সময় শিশুতোষ ছড়া রচনায় মশগুল থাকেন। কিন্তু ‘৫২ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আমাদের কবিতা ও ছড়ার নতুন দিক নির্দেশনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ষাদের দশকে এর উন্মেষ ঘটে প্রবলভাবে। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ছড়া হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রধান হাতিয়ার। আগেই বলেছি ছড়া সমাজ জীবনের চিত্রাচিত্রণের উপযুক্ত মাধ্যম। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ ও টিপ্পনীর মাধ্যমে ছন্দ-মিলের কথা সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যের গৌরবের কাল হলো ষাটের দশক। এ সময় প্রকাশিত হয় এখলাস উদদীন আহমদ সম্পাদিত ‘ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ’ রোকনুজ্জামান খান সম্পাদিত মাসিক কচি কাঁচার বহুরঙা বুলেটিন, আখতার হুসেন ও আবু সালেহ সম্পাদিত চিচিংফাঁক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদ প্রকাশিত ঊনসত্তরের ছড়া এবং পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে তাকে নিয়ে লেখা হয় হাজার হাজার ছড়া। এভাবেই সচেতন বিষয়কে আশ্রয় করে রচিত হয় আধুনিক ছড়া-কবিতা। এসব ছড়া-কবিতা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে ছড়ার বিষয়, ছন্দ, মিল শব্দ প্রয়োগের মাধুর্যের কারণে। বাংলা সাহিত্যের লৌকিক ছড়ার-কবিতার রচয়িতাদের হদিশ আমরা পাই না। তারা ছড়া-কবিতায় লোকজ শব্দ ও লোকজ ছন্দের মিলন ঘটিয়েছেন। আমাদের আজ ঠিকানা লোকাশ্রিত পাড়া গাঁয়ে। এ কারণেই লোকজ ছড়া বা লৌকিক ছড়া-কবিতা আজও পাঠকপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাশঙ্কর রায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, আতোয়ার রহমান প্রমুখ লৌকিক ছড়ার শব্দ ও সুরকে আধুনিকীকরণ করে ছড়া-কবিতা লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু লৌকিকতা পরিহার করতে পারেননি। লোকশব্দ, লোকছন্দ ও লোকসুর তাদের ছড়া-কবিতাকে আরও পরিপক্ক করে তুলেছে।
বাংলা সাহিত্যের ছড়া লেখকদের তালিকা সুদীর্ঘ এবং তারা আপন বৈশিষ্ট্যে স্বখ্যাত। ছড়ার প্রাণ হলো ছন্দ ও মিল। সঠিক শব্দের প্রয়োগে ছড়ার বিষয় আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। একসময় ছড়া ছিল ধ্বনিনির্ভর ও অন্তমিল সংযুক্ত। কালের আবর্তে ছড়ার আধুনিকীকরণে ধ্বনি ও মিলের সাথে শব্দের সঠিক ব্যবহার ছড়াকে আরও ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে। এখানে বাংলা সাহিত্যের নামজাদা ছড়া-লেখকের কিছু ছড়ার আংশিক উদ্ধৃতি দিলেই বিষয়টি আরও সহজ হবে। নিচের প্রথম ছড়া বা পদটি চর্যাগীতিকার কাহ্নপাদের লেখা। ভাষা তথা শব্দ ও মিলের অপূর্ব সাঁকো তৈরি করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন :
চর্যাপদ
আলিএঁ কালিএঁ বাট
তা দেখি কাহ্নু বিমণা ভইলা
কাহ্নু কহিঁ গই করিব নিবাস।
জো মণ গোর সো উআস
শব্দ ও মিলের অপূর্ব নিদর্শন রবীন্দ্রনাথের খাপছাড়া। প্রতিটি ছড়ার অন্তমিলে দুই মাত্রা এবং বিষয় বর্ণনায় যুত্সই শব্দের প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে এর আগে কেউ করেননি। তিনি লিখেছেন :
ক্ষান্তবুড়ির দিদি-শাশুড়ির পাঁচ বোন থাকে কালনায়,
শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়,
হাঁড়িগুলো রাখে আল্নায়।
কোনো দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে,
নিজে থাকে তারা লোহা সিন্দুকে,
টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে বলে
রেখে দেয় খোলা জাল্নায়—
নুন দিয়ে তারা ছাঁচিপান সাজে, চুন দেয় তারা ডাল্নায়।
অনুরূপভাবে কাজী নজরুল ইসলাম তার ছন্দ-মিলের দক্ষতা দেখিয়েছেন কুলি-মজুর কবিতায়। তিনি লিখেছেন :
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নিচে ফেলে—
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগত্ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!
ছড়া-সম্রাট সুকুমার রায় কম কিসে। তার ছড়া-কবিতার পাঠক ছোট-বড় সবাই। তিনি খাওয়া নিয়ে ছড়া কেটেছেন এভাবে!
খাই খাই করো কেন? এসো বসো আহারে
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত খুশি খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে
জড়ো করে আনি সব—থাকো সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফলমূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ চর্ব্য ও চোষ্য
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি।
উপযুক্ত শব্দের ব্যবহার ও ছন্দের গাঁথুনিতে বর্ণনা হয় হূদয়গ্রাহী। কবি জসিম উদ্দীনের পল্লী জননী তার অপূর্ব দৃষ্টান্ত। তিনি লিখেছেন :
রাত থম্ থম্ স্তব্ধ নিঝুম, ঘন ঘোর আঁধিয়ার
নিঃশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম্ ঘুম্ যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
ছড়া রচনায় অন্নদাশঙ্কর রায় ছন্দ মিলের আশ্রয়ে বিষয়ের প্রতি জোর দিয়েছেন বেশি। তার ছড়া-কবিতা তাই চিন্তাশীল, অপরদিকে সকলের জন্য লেখা। ‘খোকাখুকু’ ছড়াটিতে তিনি লিখেছেন :
তেলের শিশি ভাঙল বলে,
খুকুর পরে রাগ করো?
তোমরা যেসব বুড়ো খোকা,
ভারত ভেঙে ভাগ করো?
তার বেলা
ভাঙছো প্রদেশ ভাঙছো জেলা
জমিজমা ঘরবাড়ি
পাটের আড়ত, ধানের গোলা
কারখানা আর রেলগাড়ি-
তার বেলা?
সুকুমার বড়ুয়ার ছড়া-কবিতায় ছন্দ মিলের পাশাপাশি বিষয়ের প্রতি অটুট ভাবনা দৃষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে শব্দের সঠিক ব্যবহার তিনি সচেতনভাবে করেছেন ‘ঠিক আছে’ ছড়াটিতে তিনি লিখেছেন :
অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
Report this ad
রেসনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙা-চোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
সাম্প্রতিক বিষয়কে নিয়ে রফিকুল হক, মাহবুব তালুকদার, আখতার হুসেন, মাহমুদ উল্লাহ, আবু সালেহ, শাহাবুদ্দীন নাগরী, রোকেয়া খাতুন রুবী, ফারুক নওয়াজ, লুত্ফর রহমান রিটন, আবদুল হামিদ মাহবুব, আমীরুল ইসলাম, সারওয়ার-উল-ইসলাম, জসীম মেহবুব, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, বশির আহমদ জুয়েল, জগলুল হায়দার, হাসনাত আমজাদ প্রমুখ প্রচুর ছড়া-কবিতা লিখেছেন। এদের ছড়া-কবিতায় ছন্দ-মিলের অর্পূব দ্যোতনা এবং শব্দের সঠিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। শুধু বিষয়ই নয়, শব্দ-ছন্দের কারুকাজ প্রতিটি পঙিক্ততে পঙিক্ততে গাঁথা। যেমন লুত্ফর রহমান রিটন লিখেছেন শাহবাগের ছড়ায়:
গোলাম রে তোর হবে ফাঁসি
সোনার বাংলা ভালোবাসি
যারা হাত মিলিয়েছে ঘাতকের সঙ্গে
তাদেরও বিচার হবে জানি এই বঙ্গে।
ছড়ার শরীর নির্মাণের জন্য পদ্যকার ও গদ্যকারের মতো ছড়া-লেখকের অভিধানের দ্বারস্থ হতে হয় না। কিংবা অভিধান ঘেঁটে বেছে বেছে একগুচ্ছ শব্দ টেবিলে নিয়ে বসতে হয় না। লৌকিক ছড়ার সৃষ্টিকর্তারা আদিতে মুখে মুখে ছন্দ, শব্দ ও মিল খুঁজে পেতেন আধুনিককালের ছড়া-লেখকরাও পূর্বসূরিদের মতো ছড়া নির্মাণ করেন। তবে সাহিত্যের যেকোনো সৃষ্টির মাধ্যমে হওয়া উচিত গ্রহণযোগ্য ভাষা। পদ্যে রহস্যময়তা থাকে,
কিন্তু ছড়ার বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট হতে হয়।
ছড়ার শব্দ-ঝঙ্কারই পাঠককে বিমোহিত করে এবং ছড়ার চলার গতি আপন ছন্দে-আনন্দে। শব্দের সাঁকো তার আপনা-আপনি তৈরি হয়ে যায়।
নবীন কবিদের কবিতা : ‘কঠিন’ শব্দ ও ‘কঠিন’ কবিতা;
‘কাঁচা’ হাত ও ‘কাঁচা’ কবিতা বনাম ‘পরিণত’ হাত ও ‘পরিণত’ কবিতা
খলিল মাহমুদ
কবিতা কাকে বলে সেই ডেফিনিশনে না যেয়ে, এবং কে কবি আর কে কবি নন, সে আলোচনা না করে শুরুতেই ধরে নিচ্ছি যিনি কবিতা লিখেন তিনি কবিতার সংজ্ঞা জানেন; এবং একটা কবিতাকে কবিতা হিসাবে এবং একজন অপরিণত কবিকে পরিণত কবি হিসাবে গড়ে ওঠার পথে কী কী অন্তরায় রয়েছে, এ পোস্টে সে বিষয়টি খুব খোলামেলা ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। পরিণত ও প্রতিষ্ঠিত কবিগণ এ পোস্টের আওতার বাইরে; এবং উঠতি কবিদের উপকারার্থে তাঁদের পরামর্শকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।
নবীন কবিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ‘শব্দরোগ’। নতুন নতুন শব্দের বদলে তাঁরা হন্যে হয়ে কেবল ‘কঠিন’ শব্দ খোঁজেন। সমস্যা এখানেই শেষ নয়- যখন কবিতা লিখতে বসেন, স্মৃতিতে যতগুলো ‘কঠিন’ শব্দ জমা পড়েছে তার সবগুলোই এক কবিতায় ঢেলে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কবিতা লেখা শেষ হলে তৃপ্তির হাসি হেসে মনে মনে বলেন- এইতো, একটা ‘কঠিন’ কবিতা লিখে ফেললাম, এর অর্থ বের করতে পাঠকের এবার প্রাণ ওষ্ঠাগত না হয়ে যাবেই না।
কিছু পাঠক এরূপ ‘কঠিন’ কবিতা পড়ে চমৎকৃত হোন। তাঁরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কবিতাকে বিশদ বিশ্লেষণ করেন; কবিতায় যা বলা হয় নি, গুরুগম্ভীর শব্দে তাও ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান। একদিকে তাঁর ব্যাখ্যাটি দুর্বল ও অ-সঠিক হয়, অন্যদিকে কবি এই ব্যাপক আলোচনা পেয়ে গর্বে আপ্লুত হয়ে ভাবেন- তিনি শীর্ষে উঠে গেছেন। এরূপ পাঠকেরা আদতে কবিতা কম বোঝেন, তাঁদের পরিচিত শব্দসংখ্যা খুব সীমিত; এমনও হতে পারে তাঁরা কবিতা বোঝেন না, শব্দও চেনেন না। ফলে এই কবির ‘সুবিশাল’ শব্দভাণ্ডার দেখে তাঁকে শব্দসম্রাট, শব্দের জাদুকর, শব্দের কারিগর, ইত্যাকার মহৎ অভিধায় ভূষিত করে মাথায় তুলে নাচতে থাকেন। কবি তীব্র সুখে এই আনন্দ উপভোগ করতে থাকেন।
একটা কবিতা ভালো কবিতা হিসাবে দাঁড়িয়ে যায় কিছু ‘কঠিন’ শব্দের উপস্থিতিতে নয়, বরং ঐ শব্দগুলোর সঠিক প্রয়োগে। সঠিক প্রয়োগের ফলে কিছু মামুলি শব্দের সমাহারেও একটা কবিতা অনন্য হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত, শব্দ কখনো ‘কঠিন’ হতে পারে না, শব্দের প্রয়োগই তাকে কঠিন করে তোলে। সব ‘কঠিন’ শব্দেরই ‘অভিধানে’ স্থান রয়েছে, যা থেকে তার অর্থ পাওয়া সম্ভব। অর্থ নেই, এমন কোনো শব্দ কবিতায় বসালে তা একটা জটিল কবিতার আকার ধারণ করবে; কেননা,এতে কবিতার কোনো অর্থ সৃষ্টি হয় না। কবিতার ভিতরে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন, সেই মূল মর্মটি ‘কঠিন’ হতে পারে- কারণ, সকল দর্শন সকলের কাছেই যে বোধগম্য হবে, ব্যাপারটা এরকম নয়। কবিতার সারমর্ম কোনো শব্দকোষ বা কাব্যকোষে নেই। কবিতার ‘কঠিন’ কিছু থেকে থাকলে সেটি তার শব্দ নয়, অন্তর্নিহিত ভাবার্থ।
একটা উৎকৃষ্ট কবিতার বৈশিষ্ট্য এই নয় যে সেখানে জটিল ও ‘কঠিন’ শব্দ ব্যবহার করতে হবে। কবিতার গাঁথুনি বা নির্মাণশৈলী, এর অন্তর্নিহিত ভাব বা বক্তব্যই কবিতাকে উপরে তোলে। এই গাঁথুনির কাজে শব্দগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করা হলো, বা এর বিন্যাস কী রকম- কবিতার গুণগত মান দেখতে হলে সেই জিনিসটাই বিবেচনা করতে হবে।
একটা কবিতাকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করার মধ্যেই প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। মনের ভিতরে জমা হওয়া সব শব্দকে কবিতায় না বসিয়ে কেবল কবিতার প্রয়োজনে সঠিক অবস্থানে সঠিক শব্দটাকে বসাতে পারলেই একটা কবিতা সাবলীল ও সার্থক হয়ে উঠবে।
অনেকে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করেন। এটা খুবই ভালো কথা, এবং সৃজনশীল কাজ। অনেকে এমন শব্দ আবিষ্কার করেন যে আবিষ্কৃত শব্দের কোনো অর্থ নেই। এরূপ ‘অর্থহীন’ শব্দেও কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠিত কবিদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়া যায় বলে তাঁরা দাবি করেন। যিনি সম্পূর্ণ নতুন একটা শব্দ তৈরি করে কবিতায় ব্যবহার করেন, আমার বিশ্বাস, তিনি নিশ্চয়ই এটার একটা অর্থ কল্পনা করেই এ কাজটি করে থাকেন। তা না করে থাকলে এটা ‘আগডুম, বাগডুম, ঘোড়াডুম’ ধরনের শব্দের মতো হবে, যেগুলো গানের মধ্যে ‘লা লালা লালা লা’, ‘হো হো হো’ ইত্যাদি রূপে ফিলার হিসাবে কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে, নতুন শব্দ সৃষ্টি করা কোনো বাহাদুরি নয়। এই দেখুন, কত বিচিত্র ও নতুন নতুন শব্দ বানানো যায়- যোগনূর, যোগতাল, যোগীনূর, যোগামৃত, যোগবল, যোগাসুখ, যোগসুখ, যোগাতুর, যোগার্ত, যোগমৃত, যোগময়, যোগমায়া, যুগঞ্জয়, যোগসিৎ, যোগসিক্ত, যোগালয়, যোগনৃত্য। এগুলো কি কিছু হয়েছে? হ্যাঁ, এর প্রতিটা শব্দেরই অর্থ বের করা সম্ভব।
শব্দকে কীভাবে ভাঙতে হয়, জুড়তে হয়, একজন দক্ষ কবি সেটা জানেন। যদি কোনো কবি শব্দ ভাঙাজোড়ার বদলে নতুন শব্দ বানিয়ে ফেলেন, সেটা বেশ হাস্যকর হয়ে যেতে পারে। শব্দ ঠিক এভাবেই বানানো যায় বলে মনে হয় না; প্রতিটা শব্দের প্রকৃতি বা মূল থাকতে হয়। সতুন, প্রতুন, যতুন, মথুন, অতুন, মর্তুন, মানুশি, প্রনিভা, সুরুনিমা, আলুশিনা, প্রনিতি, বিরূশা, চাপিশা, যশোথী, কপালো, কাপিতা, কপিতা, নপিতা, রানিলা- শব্দগুলো কি নতুন নয়? কিন্তু এই নতুন শব্দগুলোর কোনো মূল নেই, তাই এগুলো অর্থহীন শব্দ। তবে আপনি নতুন শব্দ বানিয়ে যদি তার একটা অর্থ জুড়ে দিতে পারেন, সেটা একটা কাজের কাজ হতে পারে।
কিন্তু পৃথিবীর কোনো ভাষায় কোনো ভাষাবিদ এভাবে নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছেন কিনা আমার জানা নেই। শব্দ বা ভাষার উৎপত্তির ইতিহাস এরকম কিনা তাও আমি জানি না। তবে বর্তমান যুগে কেউ যদি এভাবে নতুন শব্দ বানাতে বসে যান তাহলে ভূরি ভূরি নতুন শব্দ বানানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে নতুন শব্দের আলাদা একটা অভিধান রচনা করার প্রয়োজন পড়বে বৈকি। এতে অবশ্য বিপত্তি যে কম কিছু হবে না তা নয়- একেক ব্যক্তি যদি নিজ নিজ সৃজনীশক্তি প্রমাণের উদ্দেশ্যে শত শত ‘ব্যক্তিগত নতুন শব্দের অভিধান’ রচনা করে বসেন, অবস্থাটা ভয়াবহ হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তা দ্বারা ভাষার কী উপকার সাধিত হবে? এজন্য, একটা নতুন শব্দ বানিয়ে ফেলেছি- এতে বিরাট কোনো কিছু ঘটে গেছে বলে আমি মনে করি না। সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায় শব্দকে ভাঙার ব্যাপারটা অনেক আলোচিত ও সৃজনশীল বিষয়। একটা শব্দকে ভাঙার উদ্দেশ্য কোনো অর্থহীন শব্দ সৃষ্টি করা নয়। কল্পনা করুন, অর্থহীন অনেকগুলো বানানো শব্দ দিয়ে একটা বাক্য লিখলেন; যে-শব্দের কোনো অর্থ নেই, সেই শব্দ দ্বারা গঠিত বাক্যের কি কোনো অর্থ থাকতে পারে? সে ভাষা পাখি বা পশুর ভাষার মতোই অবোধ্য হবে।
কবিতায় শব্দের ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। কবিতায় নুতুন নতুন শব্দ, এমনকি অপ্রচলিত শব্দও আমদানি করতে হবে, তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনোক্রমেই এর সহজবোধ্যতা ব্যাহত না হয়। সাবলীলতা কবিতার একটা বড় গুণ। সাবলীলতার গুণে লেখা প্রাঞ্জল ও বোধগম্য হয়ে ওঠে। অন্যথায় লেখা জটিল হয়ে পড়ে, বোধগম্যতার মাত্রা হ্রাস পায়। কবিতায় নতুন শব্দ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। তবে নতুন শব্দের অর্থ ‘সারবত্তাহীন স্বপ্রণীত’ শব্দকে বোঝায় না।
তবে এটা স্বীকার্য যে, প্রাথমিক অবস্থায় নবীন কবিদের হাতে কেবল শব্দই থাকে। সময়ের সাথে সাথে ভাবনায়, চিন্তায় এবং পাঠ অভিজ্ঞতায় পরিপক্বতা আসে; কবিতা সাবলীল ও সহজ হতে শুরু করে। একজন কবিকে অজস্র ‘কঠিন’ বা ‘দাঁতভাঙা’ শব্দ দ্বারা বাহবা বা প্রশংসা অর্জনের জন্য নয়, বরং কবিতার জন্যই ব্রতী হতে হবে। এজন্য প্রচুর পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হবে। এটাও আমাদের একটা বড় সমস্যা যে, আমরা আনন্দের জন্য পড়ি না; কিংবা আমরা আদৌ পড়ি না, অভিধান ঘেঁটে কিছু ‘কঠিন’ শব্দ জড়ো করি, এবং একই কবিতায় সবগুলো ‘কঠিন’ শব্দ ব্যবহার করতে মরিয়া হয়ে উঠি; এমনকি একই শব্দের যতগুলো ‘কঠিন’ প্রতিশব্দ আছে, পারি তো এক লাইনেই সবগুলো বসিয়ে দিই। এতে কবিতা জটিল হয়ে পড়ে।
আনন্দের জন্য পড়তে হবে। শব্দগুলো আমাদের প্রতিষ্ঠিত কবিরা কীভাবে ব্যবহার করেছেন, তা নিবিড়ভাবে খেয়াল করতে হবে। কবিতা লিখবার জন্য শুধু কবিতাই নয়, সব ধরনের লেখাই পড়তে হবে। একটি কবিতা লিখবার আগে অন্তত ১০০টি কবিতা, বিচিত্র স্বাদের অন্তত ১০টি গদ্যরচনা পড়া উচিত। ব্লগ বা ফেইসবুকে অনেকেই দিনভর বিরামহীনভাবে কবিতা পোস্ট করে থাকেন। তাঁদের কবিতা পড়ে সহজেই বোঝা যায় তাঁদের অধ্যয়নের পরিধি অত্যন্ত অপ্রতুল, যার ফলে তাঁরা 'আমি-তুমি-রোদ-বৃষ্টি-ফুল' থেকে বের হয়ে আসতে পারেন না। এতে কবির কল্পনার জগত সম্প্রসারিত হয় না। তিনি যা লিখেন, তা ঘুরে-ফিরে একই বিষয়ে, একই ছন্দে, একই শব্দে ভরা একঘেয়েমিময় বস্তু ছাড়া আর কিছুই হয় না। অর্থাৎ, সবগুলো কবিতাকে একই কবিতা মনে হয়; অর্থাৎ, একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতাকে আলাদা করা যায় না।
আমাদের মধ্যে এমন প্রতিভা অবশ্যই আছে, যিনি প্রতিদিন ১০টা কবিতা রচনা করার পর হাত-পা ছুঁড়ে এই বলে উল্লাস করতে থাকেন, রবীন্দ্রনাথের রেকর্ডকে তিনি ভঙ্গ করে ফেলেছেন। কিন্তু ওগুলো যে কবিতা হয় নি সেটা তিনি বুঝতেও পারেন না।পাঠক হিসাবেও আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ও ভাঁড়ামি আছে। আমাদের পর্যাপ্ত কবিতা-জ্ঞান নেই, হয়ত-বা একেবারেই নেই। তো এই অবস্থায় নবীন কবিদের ‘কঠিন’ শব্দসম্ভারে সাজানো কবিতা পড়ে বিস্মিত হই, এবং প্রশংসায় কবিকে মাথায় তুলে ফেলি। কবিও সেটাকে প্রাপ্য প্রশংসাই মনে করেন; তাঁর যে জানার অনেক ঘাটতি রয়েছে এটা বোঝার তাঁর আর কোনো ফুরসতই থাকে না। ফলে তিনি ক্রমাগত একই মানের কবিতা লিখে চলেন, কবিতায় উৎকর্ষ লাভ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
কী লিখেছি তা পড়তে হবে; বার বার পড়তে হবে। বাক্যগঠন যাতে জটিল না হয়, সেজন্য বার বার লেখাকে ভাঙতে হবে, প্রাঞ্জল করতে হবে, তাহলেই কবিতা সাবলীল হবে। বাংলা ভাষার সেরা কবিতাগুলো সরলরৈখিক, সাবলীল, প্রাঞ্জল বা সহজবোধ্য। আমি খুব জটিল কবিতা লিখেছি, যার অর্থ আমি ছাড়া আর কেউ বোঝে না, এ নিয়ে আমার গর্ব করার কিছু নেই।
দিনভর কবিতা লেখার কোনো মানে নেই, সেই কবিতার যদি কোনো মান না থাকে। কারণ, দিনের শেষে আমার ‘কবিতার সঞ্চয়’ শূন্যতেই পড়ে থাকবে। ভালো মানের কবিতা সপ্তাহে একটা, কিংবা মাসে একটা, এমনকি বৎসরে একটা লিখলেও তা আমার ‘কবিতার ভাণ্ডারে’ মূল্যবান সঞ্চয় হিসাবে জমতে থাকবে।
কঠিন শব্দের কোন মানে হয় না, যদি না তা পাঠককে ছুঁয়ে যায়। কবিতায় অসংখ্য ‘কঠিন’ শব্দ বসিয়ে হয়তো একটু সাময়িক আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়, কিন্তু শেষাবধি বেঁচে থাকে কবিতার বক্তব্য, জীবনঘনিষ্ঠতা।
কবিতা হলো শব্দের খেলা, শব্দের বুনন। পঙ্ক্তিস্থিত কোনো শব্দই এককভাবে কবিতা নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সবগুলো শব্দ নিবিড় বন্ধনে যুক্ত হয়ে একটি ভাব বা অর্থ প্রকাশ না করে। কঠিন শব্দ বলতেই তা মাধুর্যমণ্ডিত শব্দ নয়, তদ্রূপ সহজ শব্দ বলতেই যে সেগুলো রুক্ষ বা রসহীন বা সস্তা, তাও নয়। শব্দভাণ্ডারের কিছু শব্দ খুবই সুন্দর, কিছু শব্দ তত মোলায়েম বা সুন্দর নয়। একটা সুন্দর শব্দ যেমন ভুল প্রয়োগের ফলে পঙ্ক্তির সর্বনাশ ঘটাতে পারে, কিছু অতি সাধারণ শব্দ মিলেও কালজয়ী চরণ সৃষ্টি করে ফেলতে পারে। নি, কথা, রাখে, কাটলো, কেউ, বছর, তেত্রিশ- বহুলপ্রচলিত খুব সাধারণ মানের একগুচ্ছ শব্দ। কিন্তু এ থেকে যা সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের বুক ভেদ করে যায় - কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো।
কারো কারো মতে, আধুনিক কবিতায় কবিতার এক-তৃতীয়াংশ অর্থ উহ্য রাখতে হবে। এ নিয়ম অনুসুরণ করতে গিয়ে আজকাল কিছু কবি এমন কবিতা লেখেন, যেখানে পুরো কবিতাটাই দুর্বোধ্য, কিংবা অবোধ্য হয়ে ওঠে। আর ‘কঠিন’ থেকে ‘কঠিনতর’ শব্দের প্রয়োগে কবিতা হয়ে ওঠে অপাঠ্য। কবিতা হলো রহস্যময়ী নারীর মতো (যখন পুরুষরা ভাবেন)। নারী তাঁর কতখানি রহস্য উন্মোচন করবেন, আর কতখানি গোপন রাখবেন সেটিই হলো তাঁত কলা বা আর্ট। কবিতার ক্ষেত্রেও কি সেটা প্রযোজ্য নয়? কবিই ভালো বুঝবেন তাঁর কবিতাকে আকর্ষণীয় করার জন্য পুরোটাই রহস্যে আবৃত করে রাখবেন, নাকি কিছু অংশ প্রকাশও করবেন। কবিতা যদি অতিমাত্রায় সাংকেতিক হয়ে যায়, তাহলে তা রসকষহীন পাথরের মতো হয়ে যেতে পারে। আবার স্বচ্ছ কাঁচ বা তরল পানির মতো হলে কীরূপ হয়? স্বচ্ছতার মধ্যেও অনন্য মাধুর্য থাকতে পারে। সব প্রকাশের মধ্যেই আবার অব্যক্ত অনেক কিছু রয়ে যেতে পারে। অনেক কম বলেও অনেক বেশি প্রকাশ করা যেতে পারে; এটাই হলো কবির দক্ষতা ও সার্থকতা।
মোটের উপর বাঙালিদের প্রকাশ ক্ষমতা, বিশেষ করে মৌখিক প্রকাশ ক্ষমতা খুব দুর্বল। যিনি যত সুন্দর করে ভাবতে পারেন, তিনি তত প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন। আমার ভাবনা যখন জট পাকানো থাকবে, আমার প্রকাশও তখন জটিল হবে। কেউ বুঝবে না। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, আমরা যখন একটা কবিতা বুঝতে বা হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হই, মনে করি ওটা খুব গুরুগম্ভীর ও উচ্চমার্গীয় কবিতা।
একজন কবি সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত হোন এবং আনন্দ পান বোধ হয় এই কমেন্টে- ‘আপনার কবিতা মাথার উপর দিয়ে গেলো। এটা একটা জটিল কবিতা। আপনি অনেক কঠিন শব্দ লিখেন! এত কঠিন শব্দ আপনি পান কোথায়? কট্ঠিন!’ কবির জন্য এসব বাচ্য বহুমূল্য পুরস্কারের মতো। কবির সুখ তখন বহুগুণ বেড়ে যায়। তিনি মাটিতে পা ফেলেন না; হাওয়ার উপর ভর করে হাঁটেন।
যাঁরা ‘কঠিন’ কবিতা লিখবার মানসে কেবল ‘কঠিন’ শব্দ খুঁজে খুঁজে কবিতায় জুড়ে দেন, পরিণামে তাঁদের কবিতাটি ‘কঠিন’ না হয়ে কৃত্রিম বা আরোপিত, মাঝে মাঝে বিভ্রান্তিকর বা জট-পাকানো হয়ে যায়, যা কোনো মহৎ বাণী প্রকাশের অন্তরায় হয়ে পড়ে। কবিতায় কোন্ শব্দগুলো আরোপিত, বা জোড় করে টেনে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, কবিতাটা পড়লেই তা বোঝা যায়। এরূপ কবিতা পাঠে প্রায়শ মনে কোনো ভাব জাগে না, কল্পনায় কোনো ছবি ভেসে ওঠে না; কখনোবা পাঠকের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করতে পারে। সহজাত লেখনিতে শব্দরা অনায়াস ভঙ্গিতে এসে পঙ্ক্তিতে নিজ জায়গায় বসে পড়ে। কবিতা পড়লে মনে হয় কবি খুব সহজভাবে কথাগুলো বলে গেছেন। শব্দ আরোপিত হলে পড়তে কষ্ট হবে,অর্থ উদ্ধার করতে যেয়ে দেখবেন এর কোনো অর্থ নেই। অনেকে ‘আজাইরা শব্দের বাহাদুরি’ দেখিয়ে কবিতাকে ‘জটিল’ ও ‘দুর্বোধ্য’ করার উদ্দেশ্যে পঙ্ক্তির ভিতরে অপ্রযোজ্য কিংবা অপ্রজোনীয় শব্দ বসিয়ে দিয়ে থাকেন।
কেউ কেউ আরও ইন্টারেস্টিং পন্থা অবলম্বন করেন- হুটহাট কিছু ভুল শব্দ বসিয়ে দেন চরণের মধ্যিখানে। এ কবিতার কী মর্ম, পাঠক এবার হাড়ে হাড়ে টের পান, যখন দেখেন এ থেকে কিছুই উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। বুঝতে-না-পারা বা এরূপ ‘অর্থহীনতা’কে অনেকে কবিতার মাধুর্য বা বহুমাত্রিকতা বলে মনে করেন। তাঁদের ধারণা, কবিতাটার অর্থ না থাকায় একেক পাঠক একেকরকম অর্থ তৈরি করে নিবেন। এতেই নাকি কবিতার প্রকৃত স্বাদ বা মাধুর্য। এরূপ ব্যাখ্যা আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হয়। একটা ভালো কবিতা এমন- এর একটা পঙ্ক্তি পড়া মাত্রই একটা ছবি বা ভাব আপনার মনের মধ্যে জেগে উঠবে। পুরো কবিতাটা পাঠ করার পর একটা আনন্দস্রোত আপনার মনেপ্রাণে প্রবাহিত হতে থাকবে।
সামহোয়্যারইনব্লগে এমন কয়েকজন কবির কবিতা আমি পড়েছি, সৃজনশীলতায় যাঁদের কবিতা খুব উচ্চমার্গীয়। এঁদের কবিতা পাঠে আমি চমৎকৃত হই এই দেখে যে- পরিচিত শব্দ, কিন্তু তাঁরা শব্দকে এমনভাবে ভাঙেন আর গড়েন যে, প্রতিটি প্রয়োগই আমার কাছে অভিনব মনে হয়। প্রতিটিই নতুন শব্দ। নতুন ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। এটা হলো কবির সৃজনীশক্তি।
তবে কবিতাকে শব্দকোষও বানানো যায়। কবি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করেন, তাহলে শব্দের বাহুল্যে কবিতার মূল বক্তব্য ডুবে যেতে পারে। কবিতা তখন ব্যর্থ। কবির অনন্য সৃজনশীলতাই এটাকে একটা কবিতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেবে। আর যে কবি ‘অনন্য সৃজনশীলতা’র আধার, তিনি কবিতাকে শব্দকোষ না বানিয়ে ‘ভাবকোষ’ বানিয়ে থাকেন। কবির সার্থকতা এখানে।
নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের রেকর্ড ভাঙার জন্য হাইস্কুল লাইফে দিনে ৮-১০টা করে কবিতা লিখতে চেষ্টা করতাম। কবিতায় একটা ট্রাঙ্ক ভরে গিয়েছিল। এসএসসি পরীক্ষার পর ট্রাঙ্কের সব কবিতা ছোটো ভাইকে দিয়ে দিলাম, সের দরে বিক্রি করে চানাচুর খাওয়ার জন্য। ঐগুলো সত্যিই কোনো কবিতা হতে পারে নি (আজও কিছু যে হয়ে ওঠে, তা বলছি না)। তো, আমার সেই হাইস্কুল লাইফে আমাকে কেউ এসব লেকচার শোনালে তাঁকে উলটো দৌড়ের উপর রাখতে সাধ হতো বৈকি। পরিণতিতে কী হতো? সবগুলো (অ)কবিতা ভস্মীভূত করা ছাড়া গতি হতো না। এখানে ‘আমি’ একটা প্রতীকী উদাহরণ। যাঁরা কবি, তাঁদের সবারই ট্রাঙ্কভর্তি কবিতা আছে এ কথা বলছি নবীন কবিদের অন্য আরেকটি অসুখের কারণে- সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। ভুলভাট কিছু লিখে ফেললেও তার উপর প্রশংসা ছাড়া কোনো সমালোচনা তাঁরা সহ্য করতে পারেন না। ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো’- এ কথাটা তাঁদের জন্য মিথ্যা।
অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে,ব্লগে প্রচুর সংখ্যক কবিতা দেখা গেলেও এর মধ্যে ভালো মানের কবিতার সংখ্যা খুব কম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমরা সবাই মনে করি যে আমরা খুব ‘বড় কবি’ হয়ে গেছি। আমরা প্রত্যেকেই মনে করি যে, আমার কবিতায় ‘কঠিন’ শব্দের সংখ্যা এত বেশি যে, সেই কবিতা বোঝার মতো কোনো পাঠক ব্লগে নেই। আমার কবিতার উপর একটা নেগেটিভ পয়েন্ট তুলে ধরছেন তো,অমনি আপনার হাত-পা ভেঙে গুঁড়ো করে দিতে উদ্যত হবো। এরপর দেখবেন, কী ভারী ভারী গম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বুলি বর্ষণ শুরু করে দিয়েছি।
আমরা যেমন সমালোচনা সহ্য করতে পারি না, তেমনি অনেক সময় প্রশংসাও গ্রহণ করতে পারি না। যেমন ধরুন, একজন কবির লেখা খুবই কাঁচা, যা কখনোই আমার মনঃপুত হয় না, বা ভালো লাগে না। হঠাৎ তাঁর একটা কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হলাম। আমি লিখলাম- এটা আপনার এ যাবত কালের সেরা কবিতা। তিনি অমনি মুখ গম্ভীর করে বলবেন- হুহ। আমি সব সময়ই ‘সেরা’ কবিতা লিখি। এটা নতুন কিছু না। তুমি কবিতার কী বোঝো? এরপর তিনি আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ঐ কবির হয়ত এটাই প্রত্যাশা ছিল আমি তাঁকে বলি- আপনি একজন তুখোড় কবি। আপনার সব কবিতাই আমার ভালো লাগে। আপনার সবগুলো কবিতাই অতি উন্নত মানের … এ হলো আমাদের প্রশংসা গ্রহণের ক্ষমতা।
একজন নবীন কবিকে সবচেয়ে বড় উপকার করেন তিনি, যিনি তাঁদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেন। যিনি এটাকে সাদরে গ্রহণ করেন, পরিণামে তাঁর উপকার সাধিত হয়। যিনি ভুলকে ভুল হিসাবে গ্রহণ না করে ‘সঠিক’ হিসাবে প্রমাণের জন্য প্রচুর যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কামনা করেন, এবং প্রশংসাকারীকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলেন- তাঁর জন্য প্রার্থনা- আমার মতো তাঁকে যেন কবিতার খাতা সের দরে বিক্রি করতে না হয়।
এবার সামহোয়্যারইনব্লগের কয়েকটি কবিতা পাঠকদের জন্য নীচে তুলে দিলাম। এসব কবিতায় আপনি ‘কঠিন’ শব্দের সমাহার দেখবেন না, কবিতার হৃদয়ে যে সুগভীর ভাবরস রয়েছে, এসব কবিতা পাঠে আপনি সেই অনুপম মাধুর্যের আস্বাদ পাবেন।
চোখগুলো যখন আর আমার সাথে থাকে না
ফড়িঙের পাখাবদলদৃশ্য দেখার সময় হয়ে ওঠে না আমার। চলে যায় বসন্ত,
বাসন্তী রঙের আভা রেখে বিদায় নেয় চৈত্র। খরার কথা মনে রেখে সাজিয়ে
রেখেছিলাম যে ছাতা, সে-ও ছায়া প্রদান থেকে বিরত থাকবে বলে ডাকে
ধর্মঘট। আর নগরে যারা ধার্মিক ছিল- তারা আমার পাপের বোঝা দেখে
ঘৃণায় ফিরিয়ে নেয় মুখ। পাপীদের প্রকৃত কোনো পথ থাকে না। তাই অন্ধ
হরিণের মতো উঁকি দিতে গিয়ে দেখি, চোখগুলো আমার সাথে নেই। ভাবি,
এই চোখ দুটি কি আমার ছিল কোনোকালে! যদি আমারই হতো- তাহলে
এত সত্য আমি কেন দেখতে পেলাম না! কেন আঁকতে পারলাম না কালিক
প্রস্থানপ্রবাহ রেখা!
বিষণ্ণতার প্রহর /// আহসান জামান
তারপর ছিঁড়ে, করি কুঁচিকুঁচি
এইসব দিনক্ষণমান। আলো ও অন্ধকারের
সারিসারি ঘর।
যাকিছু হৃদয়ে ছিল, দিয়েছি নিলামে;
শূন্যতা ছাড়া এখন আর কিছুই নেই।
ঝড় কি গড়ে বালিঘর? শান্ত চোখের নীড়!
প্রতিদিন খাতা খুলে, মুছে ফেলি অবাধ
অতীত, নাম-ধাম। মুছে মুছে; ভুলে যাই
কথার বিভাজন।
যত বেশি যোগ করি, ঢের করি বিয়োগ।
অগাধ দিয়েছ তুমি; বেদনা মোড়ানো জীবন।
শুধু স্মৃতিপটে জমে থাকে নরম ক্ষীরের মতো
বিষণ্ণতার প্রহর।
ঘঘুদহ /// মুক্তি মণ্ডল
জীবনের খানা-খন্দ ভরে গেছে
মাংসের ভেতর গেঁথে রাখছি শীতভরতি শিরিঞ্জ
সহসাই কেঁপে উঠছে
দেহখানা
কয়লার তলে জ্বলে ওঠা অগ্নিনায়িকার বাজুবন্ধে
মিলিয়ে যাচ্ছে মৃদু রোদের গতি
একটা পাতার মত
উড়ে উড়ে ফিরে আসছে হলুদ বাটা হাতের কাঁপন
মনে পড়তেছে ঘুঘুদহ
তার পানির নিচে নথ হারানো রমণীর একটা চুলের সাথে
তলিয়ে গেছে কার অন্তর?
আমার ক্ষমতা শুধু তোমাকে বপিত করে দেহে উঠা /// সোনালী ডানার চিল
আমাকে সব ছেড়ে দাগকাটা পাজামাটা পরতে দাও
সামনে বোতাম থাক আর না থাক
আমি ক্ষরিত বেদনায় আমার যৌবন লুকাতে চাই, পরিধানে;
যেখানে বিপরীত কাম খুব বেশি খোলামেলা হয়, সেখানে
আমার শক্ত পৌরুষ ঢলঢলে ছত্রাক হতে হতে বায়ু হয়ে যাবে
নিমিষেই-
খুব ভোরে, যখন শুধু শালিক জাগে
রতিক্লান্ত রাঙ্গাবউ চুপচাপ টুক করে ডুব দেয় দেওয়ান বাড়ির পুকুরে
তখন আমি ঢাকতে চাই আমার নিঙড়ে ফেলা নগ্নতা কাপড়ের বেভুল ভাঁজে
গোপনে যে খেলা চলে তোমার আমার
অবিরাম যে সুখে পাথর আকাশ
আমার ক্ষমতা শুধু তোমাকে বপিত করে দেহে ওঠা, কেমন যেন
প্রাণী প্রাণী ভাব আর শীত শীত কাঁপন
তাই ঢাকতে দাও আমার উরত আচ্ছাদনে, শালিক চোখের বৈরি চাহনি থেকে
নিজস্ব মেরুতে-
এখুনি পেশল রাখাল বেরুবে দঙ্গালে
সকালের কাঁচা মরিচ ভেঙে ভাত খাবে চাষি
আমি কেমনে বলো মগ্ন থাকি এ নগ্নতায়
আমাকে আচ্ছাদিত কর, আমাকে দাও উত্তাপ
সস্তা প্রেমের নাম কি কাম!
সস্তা চুমু কি গ্রাম্য নাবালকের অচেনা বিহার আর জুলফির তিরতিরে ঘাম
সস্তা দেহে কি শামুক গন্ধ এতটা বেহুঁশ করে
সস্তা সুখ মানে কি শরীর খুলে লোমকূপে দাহনের দুঃসাহস!
পিত চামড়া নখে তুলে আনে বিবশ লালা
তাই তো দাগকাটা পাজামাটা চাইছি
ঘুমের শুরুতে যে ছায়াছবি দেখে ঘুমায় মানুষ
সেই সব চরিত্রের কথিত সম্মেলনে তুমি আমি ঢাকবো পরাণপ্রেম!
স্তূপ থেকে আরো কিছু /// আশরাফুল ইসলাম দুর্জয়
আমাকে চিনে নি নীল, আমাকে চিনে নি সরল পথ।
চিনে নি নক্ষত্র, পথের শোভায় অহংকারী ঘাসফুল।
রাখে নি মনে প্রজাপতি, পাখায় লিখেছিলাম শপথ।
আমাকে চিনে নি ভেজা পথে শুয়ে থাকা শীত সকাল।
আমাকে চিনে অন্ধকার, শ্মশানের সে গোর খোদক
দেহ ছুঁয়ে যে গুনে ফেলে যাপিত জীবনের যোগফল।
ও গোর খোদক, তুমি কি শেষের হুইসেল জানো
মৃতের স্বজনকে বাঁচিয়ে রাখা দূরভিসন্ধি মানো?
কেন যে কে নিছক খেলে মিছিমিছি বাঁচিয়ে দেহ
দেহের ভেতর মৃত আত্মায় অভিশপ্ত পৃথিবী স্নেহ।
তুমি বরং নিশ্চিম অন্ধকারের বার্তাবাহক বনো।
ব্যাধ /// কুশল ইশতিয়াক
১.
এখন মাঝরাতে জানালার পাশে
বসে দূর হতে দ্যাখা যায় দেয়ালে লেপ্টানো ছায়া
অথবা, আটতলা থেকে পড়ে যাওয়া মানুষটির থ্যাতলানো মাথা
এও হতে পারে, দেয়ালের সাথে কোনো গোপন আলাপ
আছে তার- আমি জানি না; রাত গভীর হলে হয়তোবা
জড় রা জীবন্ত হয়, আর কেউ কেউ মরে যায়
ঘুমের ঘোরে, তবে ভৌতিক কোনো কিছু নয়-
একথা স্বভাবতই পুরোনো যে, অন্ধকারে-
মাঝে মাঝে এলোমেলো ভাবে জোনাকিরা ওড়ে- অনেক শখ নিয়ে
য্যামন শখ=সবুজ টাংস্টেন মিশ্রিত আলো; কিন্তু লাল কালো
অনেক অধিবৃত্তও দ্যাখা যায়, ওরা ছোটো থেকে বড় হতে হতে
আবার অদৃশ্য।
আমি তোমাকে বলি-
যেভাবে আমি অনুভব করি, তা নিতান্তই একটা অসুখ-
মহাজাগতিক,
ছিল জন্মেরও অনেক আগে, তবে পৃথিবীতে এসে আরও
বহু, বহু শখ জাগে
মোহগ্রস্ত হবার;
তবে পৃথিবীর নয়-
আমি তাই শব্দের ভেতরে ভাসি
প্রকাণ্ড উল্লাসকরণ শেষে, তারপরে খাপছাড়া- কেউ কেউ বলে, এগুলো কবিতা
কিন্তু আমি কবি নই; কারণ আমি যা লিখি
তা লিখি রক্ত দিয়ে;
মূলত রক্তেরও আছে অনেক গোপন অহংকার
এবং অনেক অস্থিরতা-
অতঃপর একটা ঘূর্ণিপাক
এবং আরও, (আরও) ১
পাক খাওয়া-
আমাকে টেনে নেয় একটা বিশাল চোখের ভেতর;
শূন্যতা : তাকে কীই বা বলা যায়?
আমি অনেক সত্যের উপরে গাঢ় প্রলেপ দিয়ে
একটা অবয়ব সাজাই;
পথিমধ্যে ঘূর্ণি- ধাবমান
এবং আমি গুনি
এক
দুই
তিন
চোখ : বিনিদ্র ও নশ্বর;
অথবা, একটা জানালা-
একদিন বন্ধ হবে, তবে তার আগে, যা দ্যাখার সাধ আছে- সবকিছু দেখে নিতে হবে
যদিও মাঠে ঘাটে ইঁদুর-বেড়ালেরা এমনিই মারা যায়,
ওদের চোখ খুলে, তবে সব মানুষেরা নয়-
কদাচিৎ,
কী বিচিত্র!
আমার প্রয়োজন ছিল শুধু একটা শব্দই, মনমতো
তাইতো আমি জেগে থাকি- একটা নো-ম্যান্স-ল্যান্ড-এর স্বপ্নে।
২.
অনেক শব্দ নিয়ে ভাসি
বহুকাল, আমার ভেতরের আমি-কে চিনি না আমি
অহেতুক স্বপ্ন-গনিতায়
আত্মকামী ইথারের মাঝে বাসা বেঁধে
সকল বাহু ডুবিয়ে রাখার স্বাদ আছে।
মা,
সেদিন স্বপ্নে দেখলাম, একটা খোলা মাঠ
আর একটা সবুজ প্রাচীন বারান্দা;
তারপর, কী মনে করে আমি একবার আকাশের দিকে তাকালাম
এবং, দ্যাখা গেলো- একটা কালো ঘুড়ি, শতচ্ছিন্ন কাপড়ের মতো
থেমে আছে
মধ্য আকাশে
নাটাইহীন; একটা ছেঁড়া সুতো নেমে এসেছে নীচে
তারপর- সুতো ধরতেই ও আমাকে টানলো
অনেকবার
ভাসার জন্য,
ও কি জানে, আমি এমনিতেই ভাসমান
হয়ে হেঁটে বেড়াই পৃথিবীতে;
তারপর একছুটে পাড়ি দেই অনন্তকাল।
৩.
শব্দ; মাত্র একটিই, আমার জন্য - আমি জানি না সেটা কী;
আকাশের পিঠে এখন একটা ঘর বানাচ্ছি।
--------
রঙনদীর মাঝি /// প্লিওসিন অথবা গ্লসিয়ার
এরূপ সান্ধ্য নৌকাভ্রমণের জলকোলাহলের ভিতর
দিয়ে অনির্ধারিত পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ণ চোখের মেয়েটি
পাখি হয়ে উড়ে গেলো এবং ধরতে পারা গেলো না !
আহ, এ বড় ব্যর্থতা । ঘুড়ির ডানার মত নেমে আসে
অসংখ্য প্রত্নভাষা, ব্যাখাতীত। কে সে ঘুঙুরবিভ্রমের
আড়াল থেকে ডাক দেয় নাম ধরে , সংখ্যাহীন বেদনার দিকে ।
এইসব বেদনা টেদনা ফাও, পৃথিবীর মন হু হু করে উঠলে
সকল নীরবতা মুছে আমি প্রজাপতি ডানার রঙনদীর মাঝি হয়ে গেলাম !
মহীন /// শাহেদ খান
এ-ই তবে 'নীরবতা' - সময়ের গাঢ় ইতিহাস!
চিরকাল শরতের আকাশের চেনা পরিসরে
নিয়ত চলচ্ছবি পিছে ফেলে গেলে বুনোহাঁস,
তারপর ঘোড়াগুলো নেমে আসে পৃথিবীর 'পরে।
সময়ের নিঃশ্বাসে লন্ঠনে অবাধ কাঁপন;
মহীনের ঘোড়াগুলো দেখে হাই তোলে বুড়ি চাঁদ;
কত যুগ কেটে গেল - তাও বুঝি ঘোড়াদের মন
আজও খুঁজে পায়নি যা দেখেছিল একদা অগাধ?
আস্তাবলের পথে কুয়াশা'র আস্তর বাড়ে
ঘোড়াদের স্তব্ধতা প্রাণ পায়। আর নিরাকারে -
লৌকিক সব আলো নিভে গেলে ওরাও তাকায়;
তাকিয়ে তো থাকে জানি, তবে ওরা দেখতে কি পায়?
জীবনানন্দে মেতে এক কবি আজও হেঁটে চলে:
নক্ষত্রের নীচে পৃথিবীর প্রগাঢ় মায়ায়...
সময়ঘড়ি /// আহমেদ আলাউদ্দিন
কেন জানে না, কেন শোনে না
কেন বোঝে না, কেন সময়ের ঘড়ি
দম দেয়া ছাড়াও চলে বিস্তীর্ণ পথ
ধরে, কেন বৈশাখের উৎসবে ঘুমের
গ্রহণ লাগে না; কেন বারবার ভুল
করেও ভুলের সালতামামীতে লালদাগের
পরিবর্তে কুমারী আলোর হাসি
কেন সময় বোঝে না, প্রাণের অর্গল
নিভে গেলে তার আপন বলতে কেউ
থাকে না, কেন বুঝে না সময়।
রাত বাড়ার সাথে সাথে পুরনো রোগেরা
ফিরে আসে, কাশির দমকে, নাভিঃশ্বাস
উঠে প্রাণে; কেন বোঝে না, না বুঝেও সে
চলে চলতে থাকে, আমার আমাদের
কাঙালপনা দেখেও মুচকী হেসে বলে--
'সময়ের ঘড়িতে দম দেয়া লাগে না'
স্রোত হারা নদী মরে গেলেও সময়ের
ঘড়িতে কখনো মরণের নাম নেই।
সে মরে না, ঘুণপোকার দাঁতে সেই ধার নেই
যে ধারে কেটে নিতে পারে সময়ের কাঁটা।
কেন, কী কারণে সময়ের এই ছুটে চলা
মৃত নগরীর পাঁচিল ধরে, আমাদের তৈরি
সুখপ্রাসাদের দেয়ালে! তবে কি সময় দেয়ালে
ঝুলে থাকা সেই তৈলচিত্র যার বয়সের
সাথে সাথে দামের হিসেব নিকেষে অমূল্য
হয়ে ওঠে। তবুও সময়ের ঘড়িতে দমের
ঠিকুজি আমাদের নানাবিধ রচনায়!
হঠাৎ করেই এটা ঘটবে /// স্বদেশ হাসনাইন
আমি জানি এটা ঘটবে খুব হঠাৎ,
আমার সব কিছু সাজানো হুট করে নাই হবে যাবে,
আজকে যাকে আমি বিশ্বাস করে মসৃণতা খুঁজে চলছি, সে শুধু সময় নিচ্ছে
যে কোন ভোরে আমি চোখ মেলতেই দেখবো কিচ্ছু নেই।
খুব আচমকা ঘটবে, বুঝে ওঠার আগেই
ছবিটা তছনছ হয়ে আমাকে বোকা বানাবে,
আজকে যে ছায়া দিয়ে অভ্যস্ত করে ফেলছে, আমি ধরেই নিচ্ছে সে আছে
আর আমিও ধীরে ধীরে আমার যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি তার কাছে লিখে দিচ্ছি
সে এক স্বাক্ষরে আমাকে ভিখিরি করে দেবে,
সে একবার পিছনে ফিরে হাসারও সময় দেবে না
যেমন আজন্ম যার স্নেহ মাতৃদুগ্ধের মত আশ্রয় সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে
মরে যাবে যে কোন সকাল বা বিকালে
আমি বোঝার আগেই আমাকে নিঃস্ব করে চলে যাবে
আমার আজকে যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দ এসব ঘটছে কেননা
কিছুটা সময় লাগছে ষড়যন্ত্রের পরিণত হতে,
আমার যখন কিছু রইবে না, আমি অনেকবার ভাববো কেন আগে
জেনেও ব্যবস্থা নেই নি,
আলস্যে ভ্রমরের চাবি ঝুলিয়ে রেখেছিলাম প্রকাশ্য স্থানেই,
খুব মনে হয়েছিল মানুষ বড় মহান, তাই সবচেয়ে ভঙ্গুর মানুষের কাছে
আপাদমস্তক জানিয়ে দিয়েছি।
কবিতার আকুতি /// ইমন তোফাজ্জল
এখানে পলেস্তারা খসে যাওয়া ভবনের প্রতিটি ইটের গাঁথুনি
পুরাতন চুন সুরকি, ছয়া সবুজে ঘেরা পিতামহ বৃদ্ধ দালান ঘর
স্মৃতির খুপড়ি ঘর থেকে নিত্য সঙ্গীরা এসে জড়ো
ছত্রাক ছত্রাক গন্ধ নাকে লেগে চিত্তে জ্বলে উঠে কোমল আলোর পিদিম
আমার গায়েতে জমেছে শ্যামল শ্যাওলা----
আজ সকলের মন খারাপ
তাই দেয়াল ঘরে বিষন্ন বাতাসের আনাগোনা
তোমাদের কেউ একজন ভালো করে ভেবে নাও
গলাটাও একটু সেধে নিতে পারো
ছেঁড়া আর মলিন কবিতার পৃষ্ঠাগুলো সযতনে মেলে
ডায়াসে দাঁড়াও
ভারী চশমার উপর একনজর চেয়ে দেখে
আমাদের কেউ একজন একটি কবিতা শোনাও।
এবার চলুন, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবিদের কিছু কবিতা দেখা যাক।
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-’পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
উদ্ধৃত কবিতাটিতে এমন কোনো শব্দ দেখি না যা আমাদের নিত্যদেখা শব্দের বাইরে। এই সহজ-সরল শব্দগুলো দিয়ে কবি কোন্ মহৎ দর্শন সৃষ্টি করে গেছেন, তা বোদ্ধা পাঠকমাত্রই জানেন। কিন্তু এই সরল সব্দগুলো যে একেকটা পঙ্ক্তি বা চরণ রচনা করেছে, তার কোনো একটি কি জটিল বা কৃত্রিম মনে হয়েছে? এটাই সাবলীলতা। গঠন সাবলীল হলে লেখা প্রাঞ্জল হয়ে থাকে। গঠন দুর্বল বা জটিল হলে লেখার প্রাঞ্জল্য হ্রাস পায়।
বল বীর-
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
উঠিয়াছে চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর
বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!
এখানে কিছু কিছু শব্দ সব পাঠকের কাছে পরিচিত নাও থাকতে পারে। কিন্তু যাঁদের কাছে সবগুলো শব্দই পরিচিত, তাঁরা বিস্মিত হবেন এ পঙ্ক্তিগুলো গঠনের অনন্যতা দেখে- এত সাবলীল আর সুদৃঢ়। নজরুলের শব্দচয়নে অনুপ্রাণিত হয়ে হয়তো কোনো কবি লিখে ফেলবেন :
দুর্গম ত্র্যাঙ্গুল নেহারি কান্তার ভ্যূলোক দ্যুলোক ক্রকচ মরু
হিমাদ্রি ভবিতব্য নতশির প্রেমারা দুস্তর পৈশুন্য
খোদার আসন বিশ্ববিধাত্রীর মহাকাশ
শব্দের ব্যবহারে আমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। লেখালেখির পুরো ব্যাপারটাই স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার একটা সৃজনশীল কাজ। আমাকে কবিতা লিখতে কেউ বাধ্য করেন নি। গল্প লিখতে বাধ্য করেন নি। আমি যখন লিখছি সম্পূর্ণ নিজের মনের তাগিদেই লিখছি। সমগ্র শব্দভাণ্ডার আমার দখলে। ওগুলোকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার শতভাগ স্বাধীনতা রয়েছে আমার। আসলে, এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা কথাটা মনে হয় অপ্রযোজ্য। তবে, যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- এসব শব্দ ব্যবহারের যে-স্বাধীনতা আমরা উপভোগ করছি, তা কতখানি সার্থক হচ্ছে? শব্দভাণ্ডার থেকে স্বাধীনভাবে বেছে বেছে নিচের শব্দগুলো নিলাম, পাশাপাশি বসিয়ে কবিতা লিখলাম :
জৈতুন প্রিয়ব্রজ্যা ব্রততী ক্ষারিত আঙ্গার
অবীর সংবেদনা দুণ্ডুভ জিগৎসা
খেচর আর্গল পূরভাষ সমিদ্ধ রক্তিম
বাণকাড়া মনোবাঞ্ছা
বাহ! এখানে আমার কৃতিত্ব হলো এখানকার শব্দগুলোর অর্থ জানার জন্য পাঠককে ঘর্মাক্ত হতে হবে। তাতে আমার প্রভূত প্রসাদ লাভ হবে। আর এ ‘অসাধারণ’ কবিতা লিখতে আমি যে স্বাধীনতা ভোগ করেছি, তা খর্ব করার দুঃসাহস কারো নেই। তবে কেউ যদি এটা পাঠ করে খিক করে হেসে ফেলেন, তাহলে আমার সেই হাসির অর্থ হজম করার শক্তি থাকতে হবে। আর যদি সেই হাসির অর্থ না-ই ধরতে পারি, তাহলে মৃত্যু-অবধি অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেও সাহিত্যে কিছু কবিতা দান করে যেতে পারবো বলে মনে হয় না।
অধিকন্তু, এখানকার অনেকগুলো শব্দের অর্থ জানার জন্য সাধারণ পাঠককে অভিধানের সাহায্য নিতে হবে। যাঁরা অভিধান না ঘেঁটেই একঝলক লাইনগুলোর দিকে তাকাবেন, বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যাবেন। শব্দের জাদুকর! অসাধারণ মেধাবী এ কবি! তিনি জীবন্ত শব্দকোষ! তবে এ কবিতা যদি কোনো ‘কবির’ হাতে পড়ে, তিনি স্মিত হেসে মনে মনে শুধু এটুকুই বলবেন- ‘বেকুব!’ এরকম ভাবার কারণ হলো কবি এখানে শব্দগুলো অভিধান থেকে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে সার্থক বা সঠিক পঙ্ক্তি গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনও হতে পারে যে, কবি হয়তো নিজেই শব্দগুলোর অর্থ জানেন না। আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু অনেক ভালো কবিতা লিখেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই তাঁকে এরকম করতে দেখা যায়। এরকম করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দেন, ডিকশনারি দেখতে পারি নাই, কিন্তু শব্দগুলো খুব ভালো লাগছে বলে কবিতায় দিয়ে দিলাম। J
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি; বেলা দ্বিপ্রহর;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম —
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম।
গিয়েছে আশ্বিন—পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে। ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে।
ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে; যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা। আমি বলি, ‘এ কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে যাই
কিছু লই সাথে।’
... ... ...
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের। এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার। এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন। শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল। কহিনু যখন
‘মা গো, আসি’ সে কহিল বিষণ্ন-নয়ন
ম্লান মুখে, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়।’
কালোত্তীর্ণ এ কবিতায় ‘কঠিন’ শব্দের কোনো ঝনঝনানি নেই। আছে প্রাঞ্জলতা, সাবলীলতা। আর এর ভিতরে আছে গভীর ভাবাবেগ।
……
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
ভাবপ্রবাহের দিকে যাচ্ছি না, শুধু খেয়াল করে দেখেন কী চমৎকার আর সাবলীল শব্দবন্ধন!
………
মাকে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে
ছায়াবৃতা আপন সংসারে। তাকে চিনে
নিতে পারি সহজেই যখন নিভৃত অনুভবে বার বার
একটি ভাস্বর নদী, ফুলের বাগান, মাঠ আর
শস্যক্ষেত, দূরের পাহাড়
গলে গিয়ে একই স্রোতে বয়ে যায়, সীমা
মুছে যায় চরাচরে : স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা
অনন্য উপমা তার। কে যেন চকিতে চেনা স্বরে
বলে শুনি, ‘পাল্কি চড়ে, বেনারসী পরে
যেদিন এলেন তিনি আমাদের ঘরে
চেরাগের মতো কল্যাণের হাত ধরে-
তারই স্মৃতি আছে লেগে অদৃশ্য চাঁপার উন্মীলনে,
সোনার কলসে আর সাঁঝ-নামা দিঘির গহনে।’
মার চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চ দ্বীপ ভাসে?
চোখে বেনেবউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি
শঙ্কিত আভাসে আঁকা- ভাবি
রান্না আর কান্না গাঁথা রুক্ষ এই মরুর আকাশে
এখনো কি স্বপ্ন বোনে ঊর্ণনাভ চাঁদ
নাকি স্বপ্নের জরির পাড়ে সবি জাদুকরী ফাঁদ।
চেয়েছে বুকের সূক্ষ্ম সোনালি সুতোয় চিরদিন
সমস্ত জীবন হোক নক্সীকাঁথা : সে ইচ্ছার ঋণ
শুধে দিতে বুঝি হতে হয়
গাছের মতোই এই রৌদ্রজলে মৃন্ময়, তন্ময়।
মাকে দেখি। আজো দেখি কী এক মায়ায়
পাখি তার হাত থেকে স্নেহের খাবার খেয়ে যায়
দু’বেলা আবেগ ভরে। দেখি তসবী গুণে
সন্ধ্যার মিনারে
সত্তার কিনারে
ঐ দূরায়নী আজানের ধ্বনি শুনে
আর সুবে-সাদেকের তীব্র শুভ্রতায় নির্মেঘ আনন্দ শোকে
আজীবন সমর্পিতা কোরানের শ্লোকে।
আমার দুর্ভাগ্য সেই বিশ্বাসের অনড় জমিনে
দেখি না প্রোথিত কোনো অলীক পর্বত- যাকে চিনে
দ্বন্দ্বহীন জীবনের কাছে আত্মবিসর্জনের পাবো স্বর্গসুখ।
মাঝে মাঝে সংশয়ের গলিতে বিমুখ
প্রশ্ন তুলে ধরে ফণা :
আমি কি সঠিক জানি ভদ্রমহিলাকে
- আমি যার একান্ত বিস্তার অনন্ত শুভ্র লোকে-
চিনি তাকে?
ব্যথা হয়ে বাজে
মাঝে-মাঝে তারও চোখ
আমার অস্তিত্ব-পটে : ‘কে এই অচেনা ভদ্রলোক?’
- ‘আমার মাকে’, শামসুর রাহমান
………
“অশ্বখুরের নীচে অমানবিক চাবুক
কালো জ্বীভ-দাঁত চাপা পড়ে, থেতলে যায়
ফিনকি ছোটায় কালো রক্তের,
কচুকাটা সব কচুকাটা-
ভুল দেখেছ এটা চোখের জল নয় মানবিক অশ্রু ধারা,
এটা শরীর নয় ক্ষোভ টানটান শিরা-উপশিরায় যোদ্ধা।।“
- বাকী অরিন্দম (ব্লগার অদৃশ্য)
শামসুর রাহমান বা বাকী অরিন্দমের কবিতা দুটোতেও ঐরকম ‘শব্দের বাহাদুরি’ নেই। মনের ভিতরে যে ভাব বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো কূল ছাপিয়ে ভেসে যাচ্ছিল, তার প্রকাশের জন্যই যেন শব্দগুলো অদৃশ্য অমরাবতী থেকে ছুটে এসে পঙ্ক্তির সঠিক জায়গাটাতে বসে পড়েছে। খোদ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান – এঁদের যে ক’টা কবিতা উপরে উদ্ধৃত করা হলো, সবগুলো কবিতায়ই স্বচ্ছন্দে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শব্দপ্রয়োগ ঘটেছে। এঁদের সকলেই কবিতাকে প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপনে ব্রতী ছিলেন। আমাদের নবীন কবিদের ধারণা এর উলটো বলেই মূলত এ পোস্টের অবতারণা।
কবিতাকে যদি নববধূর সাথে তুলনা করা যায় তাহলে শব্দ ও উপমার প্রয়োগ হলো তার অলঙ্কার। তবে এখানে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন অলঙ্কারের ভারে নববধূর হাঁসফাঁস অবস্থা না হয়ে যায়। অলঙ্কার ছাড়া যেমন একজন নববধূ কল্পনা করা যায় না, তেমনি অসামঞ্জস্য অলঙ্কারে নববধূর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। উপমা প্রয়োগ ও বিশেষণের বাহুল্যও অনেক সময় কবিতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অলঙ্কারের মার্জিত ও যথোপযুক্ত ব্যবহারে সৌন্দর্য বৃদ্ধি ঘটে; বাহুল্যে রূপ ঢাকা পড়ে যায়, তখন কেবল অলঙ্কারের চাকচিক্যই দৃশ্যমান হয়।
কেউ কেউ মনে করেন যে, আমরা অলঙ্কার বা উপমা ব্যবহারের বেলায় অনেক গ্রামার মানার চেষ্টা করি। কবিতা লেখার জন্য এ গ্রামার মানার প্রয়োজনীয়তা আছে কী নেই তা নিয়েও তাঁদের প্রশ্ন অনেক। আমার অবশ্য এরকম মনে হয় না। অলঙ্কার ব্যবহারের জন্য ধরাবাঁধা কোনো গ্রামার যে আছে, বা থাকতে পারে তাও মনে করি না। তবে, কোন্ বস্তুটি উপমা বা অলঙ্কার, এটা জানার কি কোনো উপায় আছে? ফর দ্যট ম্যাটার, কোন্টা গদ্য, আর কোন্টা কবিতা, এটা কে ডিফাইন করেছে? – আমাদের পূর্বসূরিরাই বলে গেছেন- এটা হলো কবিতা, কবিতা এরকম হয়, বা এরকম হতে হয়; আর এটা হলো গল্প বা প্রবন্ধ- যার গড়ন, অবয়ব এরকম। তা যদি না হতো তাহলে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ- ইত্যাদি আলাদা আলাদা শাখা আমরা সাহিত্যে পেতাম না। হয়তো সবগুলো মিলিয়ে মাত্র একটি ক্যাটাগরিই প্রকাশ করতো- এর নাম সাহিত্য। এমনও তো হতে পারতো- আমরা যাকে কবিতা বা পোয়েট্রি বলি এটা হলো উপন্যাস! আর যাকে উপন্যাস বা নভেল বলে চিনি তাঁর নাম পুঁথি! - কালের বিবর্তনে গদ্যের যেমন একটা ধারা বা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে গেছে, পদ্য বা সাহিত্যের অন্যান্য শাখারও একটা নির্দিষ্ট অবয়ব সৃষ্টি হয়েছে।
এবার তাহলে উপমা বা অলঙ্কারের কথায় আসা যাক। কবিতায় যে উপমা বা অলঙ্কার ব্যবহার করতে হবে, আমাদেরকে এ আদেশ কে শুনিয়েছে? কবিতায় উপমা ব্যবহার করলাম না, তাহলে কি সেটা কবিতা হবে না? যদি না হয়, তাহলে কেন হবে না? আর যদি উপমা ছাড়াও কবিতা লেখা যায়, সেটাই বা আমাদেরকে কে শেখালো? এজন্য আমার মনে হয়, এসবের জন্য যেমন ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই, কবি সম্পূর্ণ স্বাধীন এসব ব্যবহার করা বা না-করার জন্য, অন্যদিকে যদি ব্যবহার করিই তাহলে সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তা জানার জন্য আমাদের পূর্বসূরিদের লেখা পড়তে হবে। কালক্রমে সেগুলো থেকে মোটামুটি একটা প্যাটার্ন বের হয়ে আসে যে, উপমা বা অলঙ্কার এরকম- এ প্যাটার্নটাই হয়তো একটা প্রচলিত ধারায় পরিণত হয়েছে, যা কেবলই আপডেটেড হতে থাকে।
নজরুল-রবীন্দ্র যেসব উপমা ব্যবহার করেছেন, আপনি-আমিও যদি সেগুলো অবিকল একইভাবে ব্যবহার করি, তাহলে আমাদের স্বকীয়তা বলে কিছু থাকবে না। প্রতিটা কবিই স্বকীয় প্রতিভায় সমুজ্জ্বল। উপমা বা অলঙ্কার প্রয়োগে ভিন্নতাই তাঁদেরকে অনন্যতা দান করে। একজন সচেতন ও ক্রিয়েটিভ কবি শব্দ, বিশেষণ, উপমা, ইত্যাদি ব্যবহারে সর্বদা নতুনত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করেন। ‘চন্দ্রভুক অমাবস্যা’ একমাত্র সুনীলই লিখতে পারেন, আমি লিখতে পারি ‘অগ্নিভূক পোকা’। আমি আমার ‘সিঁথি’ কবিতায় ‘অগ্নিভূক পোকা’ শব্দটা ব্যবহার করেছি- এখানে নজরুলের ‘অগ্নিভুক পতঙ্গ’ (আমি সৈনিক) আর সুনীলের ‘চন্দ্রভূক অমবস্যা’র সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। কিন্তু আমি বলে না দিলে এটা কোনো পাঠকের পক্ষেই উদ্ধার করা সম্ভব হতো বলে মনে হয় না- উত্তরসূরিদের কাছে আমাদের ঋণ এরকমই।
নবীন কবিদের এই যে ‘কঠিন’ শব্দের প্রতি এতো মোহ, প্রথমত সেই মোহ তাঁদেরকে কাটিয়ে উঠতে হবে। কবি মনে মনে যা ভাবেন, তা-ই কবিতায় লিখবেন। যা তিনি লিখলেন, তা তিনি নিজে বুঝলেন কিনা তা বারংবার পরীক্ষা করতে হবে। আগেই বলেছি, আপনার ভাবনা পরিষ্কার বা পরিচ্ছন্ন না হলে আপনি কবিতায় কী বলতে চাইছেন তা ফুটে উঠবে না। লিখতে হবে খুব সরল করে। সরল করে লিখতে লিখতে একদিন দেখা যাবে, তিনি ঠিক ঠিক কবিতার আরাধ্য ‘মহারানি’র সান্নিধ্যে পৌঁছে গেছেন।
লিখতে লিখতেই হাত পাকে। তবে, লিখতে লিখতেই যে আমার হাতযশ রবিঠাকুরের পর্যায়ে চলে যাবে, এরূপ ভাবলে সেটা হবে আমার আকাশকুসুম কল্পনা। লিখতে লিখতে হাত সচল হয়। হাত পাকা হতে পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন। কালেভদ্রে এমন লেখক বা কবি পাওয়া যায়, শুরু থেকেই যাদের কলমে অগ্নিবর্ষণ হয়।
আমরা অহরহই এমন কবির দেখা পেয়ে থাকি, যারা অনেক বছর ধরে লিখছেন, কিন্তু যেভাবে শুরু করেছিলেন, আজও তেমনি আছেন, সেখানে উন্নতির লেশমাত্র নেই। একেবারে নিস্তেজ, একঘেয়ে, ঘ্যানর ঘ্যানর প্যানপ্যানারির মতো একই টোনে অবিরাম লিখে যাচ্ছেন। একই শব্দ, একই ভাষা, একই ভাব। তেমন ছন্দজ্ঞানও নেই।
কিছু কিছু হাত থাকে যা ধীরে ধীরে ধারালো হতে থাকে। কিছু কিছু হাত থাকে যা আজীবন কাঁচাই থেকে যায়। একজন কবির হাত পাকা হয় না কেন? বা কোন কবির হাত কখনো পরিণত হয় না?
আপনার হাত পরিণত করার জন্য প্রথমত আপনার মনের মধ্যে প্রবল স্পৃহা থাকতে হবে। লেখার চেয়ে পড়ার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ভূরি ভূরি কাঁচা কবিতা লিখে ঘর ভর্তি করে ফেলার কোনো অর্থ নেই; পরিণামে এগুলো আপনার ঘরের জায়গাই খেয়ে ফেলবে, কিন্তু আপনার জন্য কোনো মূল্য বয়ে আনবে না। আপনার একটি ভালো মানের কবিতা একটা হীরক খণ্ডের সমান।
প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কবির কবিতা পড়তে হবে। তাঁদের কবিতার নির্মাণশৈলী, উপমা প্রয়োগ, বাক্যগঠন, শব্দচয়ন, ইত্যাদি নিবিড়ভাবে খেয়াল করতে হবে। অপরিচিত শব্দগুলো নোট করে অভিধান দেখে সেগুলোর অর্থ জেনে নিতে হবে।
নিজের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে হবে। যত পড়বেন, শব্দভাণ্ডার তত সমৃদ্ধ হবে। একটা কাজ করতে পারেন। মাঝে মাঝে অভিধান পড়ুন। যেসব অভিধানে শব্দের অর্থই না শুধু, শব্দের বাক্যগঠন, শব্দের ব্যুৎপত্তি, ইত্যাদি দেয়া আছে, তেমন অভিধান পড়ুন। ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ তেমন একটা অভিধান। অভিধান খুলে শব্দ মুখস্থ করতে যাবেন না যেন। ২০টা শব্দ পড়লে দিনশেষে আপনার মনের ভিতর হয়তো গোটা পাঁচেক শব্দ গেঁথে যাবে। ঐ শব্দগুলো তখনই কবিতায় বসাতে গেলে কবিতা ‘আরোপিত’ বা ‘আর্টিফিশিয়াল’ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবে। প্রতিদিন কিছু কিছু শব্দ মনের গহিনে জড়ো হলে একদিন অটোম্যাটিক্যালি শব্দগুলো আপনার লেখায় এসে যথাস্থানে বসে পড়বে।
যখন মনের মধ্যে একটা প্লট উঁকি দিবে, খপ করে ওটাকে ধরে ফেলুন। লিখতে গিয়ে দেখলেন এগোতে পারছেন না। ছটফট করার দরকার নেই। ওটা ও অবস্থায় রেখে দিন। এরপর কাজে যান, বা পড়ায় মন দিন। কয়েক দিন, বা কয়েক সপ্তাহ পরে ঐ হাফ-ডান লেখাটিতে হাত দিন। ওটাকে এবার ঘষামাজা করুন। লেখাটা সম্পন্ন করে আবার ফেলে রাখুন কিছুদিন। এরপর ওটাতে আবার হাত দিন। আবারো ঘষামাজা করুন। এবার লেখাটি কাউকে পড়তে দিন। আপনার একজন একনিষ্ঠ পাঠক থাকা চাই, যিনি আপনার লেখা পড়ে ভূয়সী প্রশংসা করবেন। তিনি অত্যধিক উচ্ছ্বসিত হলে বুঝবেন লেখাটি অসাধারণ হয়েছে, কম উচ্ছ্বসিত হলে ধরে নিতে হবে ওটা একটা কাঁচা লেখা। এই পাঠকটি এমন হতে হবে যিনি আপনার লেখার কোনো সমালোচনা করবেন না, শুধু প্রশংসাই করবেন। কারণ, সমালোচনা আপনার মনোবলে আঘাত হানবে, আপনি দুর্বল হয়ে যাবেন, লিখবার ইচ্ছা মরে যাবে।
আপনার কবিতাটি কেমন হয়েছে, ফেইসবুক বা ব্লগের কমেন্ট থেকে এর প্রকৃত চিত্র না-ও পেতে পারেন। কারণ, ব্লগ বা ফেইসবুকে আমরা কোনো লেখা কদাচিৎ বিশ্লেষণ করি; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালো লাগা/ মন্দ লাগা কথাটা এক শব্দে বা এক বাক্যে লিখে শেষ করে দিই। আপনার লেখাটি বিশ্লেষণ করা গেলে আপনার দুর্বল বা শক্তিশালী দিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারতেন।
ব্লগ বা ফেইসবুকে ভালো লিখেন, এমন কাউকে ফ্রেন্ডলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করুন। তাকে অনুরোধ করুন আপনার লেখাগুলো পড়ে মন্তব্য করার জন্য- একটু বিশ্লেষণ করে দুর্বলতাটুকু চিহ্নিত করে দিতে বলুন। এরকম কয়েকজনকেই অনুরোধ করতে পারেন। অতঃপর, তাঁদের দিকনির্দেশনাগুলো অনুসরণ করুন।
আপনার প্রতিটি লেখাই কবিতা হয়ে উঠবে না। অগণিত লাইক বা কমেন্টের বাহার দেখে বেশি উৎফুল্ল হয়ে উঠবার কারণ নেই। সারাজীবনে একটি কবিতা যদি কবিতা হয়ে ওঠে, আপনি ধন্য হয়ে যাবেন।
আপনাদের কাঁচা হাত সোনার হাত হয়ে উঠুক, রাশি রাশি সোনা ফলুক সেই হাতে, এই কামনা করি।
বাংলা কবিতায় বিপ্লবের ধারা
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বিপ্লব বিষয়টির ব্যাপকতা যেমন বিশাল তেমনি গভীরতাও অতল। বিপ্লব কেবল ক্ষমতার পালাবদলে শক্তি প্রয়োগ বা রক্ত বিসর্জনের গা শিউরানো কোনো প্রক্রিয়া মাত্র নয়। বিপ্লব হচ্ছে চেতনার নির্মাণ এবং নির্মিত চেতনার সফল বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, যা স্বল্প সময়ে অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারে কিংবা অতি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। নির্বাচিত শব্দমালায় বলতে হয়, স্বল্প সময়ে আলোড়নকারী ঋদ্ধ পরিবর্তনই হচ্ছে বিপ্লব, যা দ্বারা তুলনামূলক খারাপ অবস্থান থেকে অধিকতর ভালো ও কল্যাণকর অবস্থানে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। বিপ্লবের সংশ্লিষ্টতা রাজনীতি বা সমাজ সংস্কারের সাথে অধিকতর যুৎসই হলেও মনোবৃত্তিক কর্মকা- ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রেও বিপ্লব ততোটাই কার্যকর এবং জীবন্ত। বিপ্লব ঘটেছে বলেই বাংলা সাহিত্য তার আদি যুগ ছেড়ে ক্রমান্বয়ে ক্রমঃউৎকর্ষে উত্তরাধুনিক ও পরাবাস্তবতায় এসে পেঁৗছেছে। বিপ্লবের বেহারারা যদি কাঁধ না দিতো তবে সাহিত্যের পালকি আজ এতো রোশনাই নিয়ে আপনাসন তৈরি করতে পারতো না।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ নিয়ে ত্রি-বিশ্লিষ্ট সাহিত্য-রথ আজ গড়গড়িয়ে চলে এই উচ্চাসনে সমাসীন হয়েছে সে কেবল বিপ্লবের জোরে। বিপ্লব ছিলো বলেই বাংলা সাহিত্য অন্ধকার যুগ কাটিয়ে আধুনিক যুগের আলো দেখেছে। বাংলা সাহিত্যের আদিতম ও কঠিনতম ধারা হচ্ছে কবিতা। শোক হতে তৈরি শ্লোকের রস মন্থনে জন্ম দেওয়া কবিতা এক সময় হারিয়ে গিয়েছিল শৈশবে। সেই হারিয়ে যাওয়া কবিতার শৈশব পুনঃ ফিরে পাওয়াটাই বাংলা কবিতার জন্যে এক বড় বিপ্লব। ১৯০৭ সালে নেপাল রাজদরবারের সংগ্রহশালা হতে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কারই বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বড় বিপ্লব। তারই বদৌলতে বাংলা কবিতার শৈশবের সময় সূচিত হয়েছে আনুমানিক ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ। চর্যাপদ প্রাপ্তিতেই বাংলা কবিতার সূচনার সুনির্দিষ্ট কাল ও ধরণ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেল।
চর্যাপদের আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় সূচিত বিপ্লবই পরবর্তীতে কবিতার বিকাশে এক অনন্য ভিত্তিভূমি হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রাচীন যুগ হতে উত্তরাধুনিক যুগ অব্দি কবিতার পঠন-পাঠনে বাংলা কবিতার বিপ্লবের ধারাকে নিম্নোক্ত ছয়টি ধারায় অধ্যয়ন করা যায়। যেমন :
ক. সামাজিক বিপ্লব
খ. শিল্প ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব
গ. রাজনৈতিক বিপ্লব
ঘ. ধর্মীয় চেতনার বিপ্লব
ঙ. দার্শনিক বিপ্লব
চ. কবিতার প্রকৌশল বিপ্লব
যুগের চলমানতায় কবিতা যেমন সময় ও পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তেমনি কবিতা নিজেও পরিবর্তিত হয়েছে বৈপ্লবিকভাবে।
ক) বাংলা কবিতায় সামাজিক বিপ্লব :
চর্যাপদে কাহ্নপা'র ১১নং চর্যাটি হতে আমরা পাই-
মারি সাসু ননন্দ ঘরে সালী
মাঅ মারি কাহ্ন ভইঅ কবালী
চর্যাটি তৎকালীন পারিবারিক বলয় ও সামাজিক বলয়ের নেতিবাচক শক্তির কথা দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলে। একজন পুরুষকে পারিবারিক জীবনে অনেক আপোষ করতে হয়। অনেক অন্দর মহলের কলহকে উপেক্ষা করে জীবন কাটাতে হয়। আজ হতে হাজার বছর আগেও সামাজিক ও পারিবারিক পরিস্থিতি এমনই কলহময় ছিলো। একদিকে শাশুড়ি ও শালী আর অন্যদিকে মা এবং বোন। পারিবারিক এই টানাপোড়নে যখন পত্নী অসহযোগিতা করে এবং বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব যখন প্রকট হয় তখন পুরুষ কর্তা চোখে সর্ষে ফুল দেখে। সমাধানের পথ তার অজানা। শেষমেষ দিশ্কূল না পেয়ে পুরুষটি সংসার বিবাগী হয়, পেছনে ফেলে যায় মা-বউ, বোন-শালী-শাশুড়ি প্রমুখকে। কাহ্নপা-এর চর্যায় গার্হস্থ্য নারী কলহের করুণ দিকটি খুব সুন্দরভাবেই ফুটে উঠেছে।
যে নারীর জন্য কাহ্নপা ঘর ছেড়ে বিবাগী হতে মনস্থ করেন সেই নারীকেই চণ্ডীদাস মধ্যযুগে এসে বলেন-'ঘর হৈতে আঙ্গিনা বিদেশ'। অর্থাৎ নারী অন্তঃপুরবাসিনী। তার বহির্জগৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অবহিতি নেই। কিন্তু পরবর্তীতে সেই নারীই পনেরশ' পঞ্চাশ সালের দিকে এসে স্বয়ং পদকর্তা বা কবি বা কাব্য রচয়িতা হিসেবে অগ্রণী হয়। এই সময়কালে আবির্ভূত হন কবি চন্দ্রাবতী, যিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহিলা কবি। কিশোরগঞ্জের নিকটে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে পাতুয়ারি গ্রামে বাবা দ্বিজবংশী দাসের কন্যারূপে জন্ম নিয়ে কবি চন্দ্রাবতী তার বাবার পদ রচনায় সহায়তা করতেন শৈশবে। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের পরবর্তীতে তিনি আবির্ভূত হন রামায়ণ, মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা, দেওয়ান ভাবনা ইত্যাদি পালা সমূহের রচয়িতা হিসেবে। চন্দ্রাবতীর ভণিতাতেই আমরা পাই-
চন্দ্রাবতী কয় শুনগো অপুত্রার ঘরে।
সুন্দর ছাওয়াল হইল মনসার বরে
তারও আগে খনা নাম্নী বিদুষী মহিলা তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীর শ্লোকে বলে যান-
তিন পুত হয় ঝি।
হাঁড়ি ভেঙ্গে পড়ে ঘি
অর্থাৎ এখানেও নারীর জয়-জয়কার। তিন পুত্র সন্তানের পরে কন্যা সন্তান যে ঘরে জন্মে সে ঘরে ঐশ্বর্য বেয়ে বেয়ে পড়ে। তার মানে নারী পরিবারের ঐশ্বর্যের কারণ। অর্থাৎ যে নারীকে অসূর্যস্পর্শা করে রাখা হতো সে নারীই কবিরূপে এবং কবিতায় হয়ে উঠে নায়িকা বা প্রধান চরিত্র।
কবি চন্দ্রাবতীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই পরবর্তীতে প্রথম মুসলিম বাঙালি কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার আবির্ভাব হয়। আবির্ভাব হয় জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের। আজকের উত্তরাধুনিক পরাবাস্তববাদী মহিলা কবির উত্থানও সেই ফুলেশ্বরী নদীর তীরে জন্মগ্রহণকারী কবি চন্দ্রাবতীর পথ ধরেই। নারী যখন কেবল অন্তঃপুরবাসিনী তখন কবি হিসেবে নারীর আবির্ভাব কিংবা কবিতায় নারীকে প্রাধান্য দেওয়া একটি বড় বিপ্লবই বটে।
কবিতায় সামাজিক বিপ্লবের ধারায় নারীকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'নারী' কবিতাতেই তিনি বলেছেন-
সেইদিন দূরে নয়
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর জয়।
সত্যিই, এই চলার পথে বাংলা সাহিত্যে নারীর ক্ষমতায়নের যে বিপ্লব সূচিত হয়েছে তার জের এখন দিন দিন আলোকিত হচ্ছে।
কবিতায় কেবল সামাজিক বিপ্লবের ধারায় নারী এসেছে বিপ্লবের বিষয়বস্তু হয়ে তা নয়। কবিতায় সামাজিক ধনী-নির্ধন কিংবা উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ ও শোষণ ফুটে উঠেছে ভীষণ জীবন্ত হয়ে। কবিগুরু স্বয়ং সামন্ত ভূ-স্বামীর জমিদারিত্বে দরিদ্র উপেনের দুই বিঘা জমি সংরক্ষণের জন্যে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তেমনটি উদ্বিগ্ন ছিলেন কাজী নজরুল রেল হতে ঠেলে ফেলে দেওয়া কুলির করুণ দুর্দশায়। শোষক গোষ্ঠী সর্বদা শোষিতকে শোষণের যাঁতাকলে রেখেছে পিষে; কবিতা সেই শোষণের বিরুদ্ধে সমাজে রুখে দাঁড়িয়েছে। তাই আমরা কবির কণ্ঠেই শুনি-
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।
খ. কবিতায় শিল্প ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব :
কবিতা নিজেই একটি নান্দনিক শিল্প। তবুও কবিতা প্রাচীন যুগ হতেই শিল্প ও সংস্কৃতির বিপ্লবের ধারাকে বহন করে এসেছে। আদিকাল হতেই কবিতার শ্লোকে শ্লোকে ধাঁধার প্রচলন ছিলো। তার সাথে যোগ হয়েছিল মধ্যযুগের কবিদের হেঁয়ালি। তাঁরা কবিতার মধ্যেই সময় গণনাকে ধরে রাখতেন। এ রকম একটা উদাহরণে আমরা দেখি, কবি বলেছেন-
সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ।
নৃপতি হুসেন সাহা গৌড়ের প্রধান
এখানে ৭ সিন্ধু, ১ ইন্দু, ৪ বেদ এবং ১ মহীর কথা জানা যায়। গণিতের ক্ষেত্রে সংস্কৃত নিয়মে বাম থেকে গণনা শুরু হয় বিধায় উক্ত কাব্য রচনার কাল বা কবির জন্মসাল ১৪১৭ শকাব্দ বলে জ্ঞাত হওয়া যায়। এ রকম আরেকটি উদাহরণ ধরা যায়-
কৃষ্ণ রাম বিরচিল রায়ের মঙ্গল
বসু শূন্য ঋতু চন্দ্র শকের বৎসর।
এখানে ১ বসুধা, শূন্য (০), ৬ ঋতু এবং ১ চন্দ্র বিধায় কাব্য রচনার সময়কাল ছিলো ১৬০১ শকাব্দ। এভাবেই মধ্যযুগের কবিতায় হেঁয়ালির মাধ্যমে শিল্পের সুপ্তি সংশ্লিষ্ট হতো।
আগে সুর করে কবিতা বা রামায়ণ-মহাভারত পাঠ করা হতো। অর্থাৎ মহাকাব্যগুলোতে ছন্দ ও অন্তঃমিল থাকার কারণে সুরে সুরে পাঠ করে তার রসাস্বাদন করা হতো। একজন পাঠ করতো আর অনেকেই ভক্তিভরে তা শ্রবণ করতো। পরবর্তীতে পুঁথিপাঠ তার জায়গা দখল করে। অর্থাৎ বাংলা কবিতায় যে সময় বিরহ বা বিচ্ছেদ কিংবা শোকের কোনো কাহিনী অন্তর্ভুক্ত হলো তখন থেকেই পুঁথিপাঠ স্থান করে নিলো। করুণ সুরে পুঁথির পাঠে শ্রোতার মনে করুণাঘন আবেগের সঞ্চার হতো। ফলে সবার মধ্যে করুণ কাব্যরসের স্রোত বইয়ে যেতো, যা পূর্ণতা পেতো অশ্রু-জলধারায়। কিন্তু যতই বাংলা কবিতা সাবালক হতে শুরু করে ততই কবিতার দেহে একটা শক্ত পৌরুষ তৈরি হতে থাকে। কবিতা তখন আর সুর করে পাঠের স্থানে স্থির থাকে না। কবিতা হয়ে যায় আবৃত্তির উপযোগী। কাহিনীর ঘনঘটা কিংবা দ্রোহ-প্রতিবাদ যখন কবিতার দেহে কঙ্কাল তৈরি করে তখন আবৃত্তি শিল্পটি ধীরে ধীরে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে যায়। এরই ফাঁকে কবিতায় আগমন ঘটে কাব্যনাট্যের। রবীন্দ্রনাথের আমলে যেমন কাব্যনাট্য ছিলো তেমনি আধুনিক আমলে কবি জয় গোস্বামী কিংবা কবি সৈয়দ শামসুল হকের হাতেও কাব্যনাট্যের অনন্ত ফল্গুধারা তৈরি হয়। কবিতা তখন আর কেবলমাত্র পাঠ বা শ্রবণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কবিতা তখন মঞ্চে পাত্র-পাত্রীর মাধ্যমে অভিনয়ের যোগ্যতা ও ঋদ্ধতা অর্জন করে। সে যে কেবল নাটক হয়েই সন্তুষ্ট থাকে তা-ও নয়। কবিতা ধীরে ধীরে হয়ে যায় শ্রুতি আলেখ্য বা শ্রুতিনাট্য। এক সময় কবিতা চলচ্চিত্রেও রূপায়িত হয় উপহমহাদেশের প্রখ্যাত কীর্তিমান এবং বিশ্বমঞ্চে অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের হাতে। 'হীরক রাজার দেশে' শীর্ষক চমৎকার বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্রে কবিতা-ই প্রধান হয়ে উঠেছে সংলাপে। কবিতার বিপ্লব এতেও স্তব্ধ হয়নি। কবিতা আজকাল উপন্যাসের দিকেও হাত বাড়িয়েছে। কবি জয় গোস্বামীর 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কিংবা কবি আনিসুল হকের 'নক্ষত্রের পানে চেয়ে বেদনার পানে' শীর্ষক উপন্যাস দু'টি আগাগোড়া পদ্য বা কবিতাতেই লিখিত। অর্থাৎ কাব্য চলচ্চিত্রের পর আমরা কাব্যোপন্যাসও পেয়েছি। কাজেই কবিতার বিপ্লবের ধারা কেবল সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ক্রমাগত শিল্প ও সংস্কৃতিকেও জয় করে চলেছে। কাব্যোপন্যাসই বড় পর্দায় দীর্ঘ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হয়ে কোনো একদিন বিজয় করবে অস্কার-এ' হয়তো অসম্ভব কিছু নয় বরং সেই প্রতীক্ষা দীর্ঘদিন বজায় থাকবে বলেই মনে হয় না।
সাহিত্যের যেমন প্রধান উপাদান ভাষা তেমনি শিল্প-সংস্কৃতিরও প্রধান উপাদান তা-ই। কবিতার মাধ্যমে ভাষার ঋদ্ধতা এসেছে ক্রমশঃ এবং অনবরত। প্রাচীন যুগের সাহিত্যের নিদর্শন 'চর্যাপদ'-এর ভাষা ছিলো হেঁয়ালিপূর্ণ, যাকে সন্ধ্যাভাষা বলাটাই গবেষকদের মতে সমীচীন। সেই ভাষা ধীরে ধীরে ক্রমাগত পরিশীলিত হয়ে কবিতার মাধ্যমেই আজকের আধুনিক ভাষায় রূপ লাভ করেছে। আগেকার কবিতার ভাষায় আবেগের বাহুল্য ছিলো, ছিলো উপমার ছড়াছড়ি। যে কোনো মূল প্রস্তাবনায় ছিলো বিপুল গৌরচন্দ্রিকার বহর। অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীতের মতো। আজকাল কবিতার বক্তব্য হয়েছে যথাযথ। কবিতার দেহ হয়েছে নির্মেদ। ভাষাও আগের চেয়ে প্রাঞ্জল এবং গতিশীল হয়েছে।
কবিতার বাংলা ভাষা মধ্যযুগে মুসলমানদের হাতে কিছুটা হুমকির সামনে পড়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ বাংলাকে সনাতনী ভাষা আখ্যা দিয়ে আরবী চর্চার একটা হুমকি জারি হয়েছিল উগ্র ধার্মিকদের হাতে। কিন্তু কবি ও কবিতা-ই সেই হুমকি মোকাবেলা করে বাংলা ভাষার সংস্কৃতিকে সাহিত্যে টিকিয়ে রেখেছে। আমরা মধ্যযুগের কবি মুত্তালিবকে দেখি বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চায় কিছুটা দ্বিধান্বিত হতে। তিনি দ্বিধাচিত্তে লিখেন-
আরবীতে সকলে না বুঝে ভালোমন্দ।
তে কারণে দেশী ভাষে রচিলুঁ প্রবন্ধ।।
মুসলমানি শাস্ত্র কথা বাঙ্গালা করিলুঁ।
বহু পাপ হইল মোর নিশ্চয় জানিলুঁ।।
কিন্তু কবি আব্দুল হাকিম দ্বিধান্বিত নন। তিনি বাংলা ভাষাকেই মনে-প্রাণে ধারণ ও লালন করেন। তিনি কবি আব্দুল মুত্তালিব-এর দ্বিধাক্রান্ত প্রগতিকে জয় করেন দ্বিধাহীন পৌরুষে। তিনি বলেন-
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়াএ।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যাএ
কবি আব্দুল হাকিমের এই বক্তব্যের পর মুসলমান কবিদের মধ্যে ভাষা নিয়ে আর কোন দ্বিধা রইল না। তারা এরপর নির্দ্বিধায় বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করে গেছেন। কবি মুজাম্মিল মধ্যযুগে এই রকম পৌরুষ নিয়েই পদ্য রচনায় ব্রতী হয়ে বলেছেন-
আরবী ভাষার লোকেঁ ন বুঝে কারণ।
সভানে বুঝিবে কৈলুঁ পয়ার বচন।।
যে বলে বলৌক লোকেঁ করিলুঁং লিখন।
ভালে ভাল মন্দে মন্দ ন খএ খ-ন।।
যে ভাষা সূচনায় কবিতায় সন্ধ্যা ভাষা হিসেবে অবগুণ্ঠন রেখে গেছে, সে ভাষাকেই সনাতনী ভাষা বলে সাম্প্রদায়িক কোপানলে পড়তে হয়েছে। আবার সেই ভাষাই পাক-স্বৈরাচারীর হাতে এসে মান হারাতে বসেছিল। কিন্তু এইবারও কবিতা গর্জে উঠে। গর্জে উঠে গীত, গর্জে উঠে কবি ও কবির কণ্ঠ। 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়' বলে কবি ও কবিতা একজোট হয়ে উঠে। সবার বুকে কবিতা দৃঢ় কণ্ঠে বলে যায়-
মোদের গরব মোদের আশা
আ-মরি বাঙলা ভাষা।
তোমার কোলে,
তোমার বোলে,
কতই শান্তি ভালোবাসা।
কবি অতুল প্রসাদ সেনের বীজমন্ত্রেই বাংলা ভাষা আজও বাংলা কবিতার অনন্ত স্তন্যধারা, অফুরান সুধারস। বাংলা ভাষাকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠার জন্যে কবিতায় এমনতরো বিপ্লব ঘটে গেছে কালে কালে। বাংলা মায়ের বিরহী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও তাঁর দুর্ভাগা প্রবাস জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন বাংলা ভাষার টান। তাই আক্ষেপ তার ঝরে পড়েছিল বড় করুণ হয়ে-
হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কিন্তু দেশে ফিরে এসে, ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় কাব্য রচনায় মনোনিবেশ করে মাইকেল পেয়েছিলেন যশ-শান্তি। তাই তাঁর উপলব্ধি তিনি সবাইকে জানিয়ে গেছেন-পংক্তিতে,
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপে খনি, পূর্ণমায়াজালে।
(ঘ) কবিতায় ধর্মীয় চেতনার বিপ্লব :
প্রাচীন যুগে যদিও ধর্মীয় চেতনা হতে কবিতার জন্ম হয়নি, কবিতার জন্ম হয়েছিল সামাজিক ও দার্শনিক চেতনা হতে, তবুও কালের পরম্পরায় কবিতার মধ্যে ঢুকে গেছে ধর্মীয় চেতনা। বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া সম্প্রদায় ও নাথপন্থী সম্প্রদায় কর্তৃক চর্যাপদের চর্চা হলেও তাতে ধর্ম বিষয়ক কোনো প্রচারণা ছিলো না, যদিও পরবর্তীতে কবিতা ধর্মীয় চেতনা ধারণ করে। মধ্যযুগে এসে কবিতায় 'রামায়ণ', 'মহাভারত'-এর মতো ধর্মীয় সাহিত্যের চেতনা পরিলক্ষিত হয়। মঙ্গল কাব্যে চণ্ডী ও মনসার স্তুতি লিখিত হয় এবং শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার পাশাপাশি ধর্মীয় চেতনার স্ফূরণ ঘটে। মধ্যযুগের কবিগণ চণ্ডীর কাছে মনসার দুর্ভাগ্য বর্ণনা করেন এইভাবে-
জনম দুঃখিনী আমি দুঃখে গেলো কাল।
যেই ডাল ধরি আমি, ভাঙ্গে সেই ডাল।।
চণ্ডীমঙ্গল-এর কবি মুক্তারাম সেন দেবী চণ্ডীর মহিমা বর্ণনায় বলেন-
সুখমনে পশুগণে যাও নিজালয়
তার ঠাঁই আমি যাই না করিয় ভয়
তদন্তরে নারায়ণী গোধিক্য হইলা
অরণ্যের পন্থমুখে আগুছি রহিলা
এইভাবে ধর্মীয় চেতনার প্রবহমানতা পৌঁছাতে পৌঁছাতে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে এসে নবতর রূপ লাভ করে। ছন্দ প্রয়োগের কুশলতায় ধর্মীয় চেতনার সাথে মিশে যায় মানবিক বোধ। ফলে তা শিল্প হয়ে যায়-
দিনের সুরুজ পোড়া অাঁ মারে রাতিহো এ দুখ চান্দে।
কেমনে সহিব পরাণে বড়ায়ি চখুত নাইসে নিন্দে
শীতল চন্দন অঙ্গ বুলাওঁ তভোঁ বিরহ না টুটে।
মেদনী বিদার দেউগো বড়ায়ি লুকাও তাহার পেটে
বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে প্রভাবিত হয়ে মুসলিম কবিরা পদাবলি রচনায় এগিয়ে আসেন। এর মধ্যে সৈয়দ মুর্তজা অন্যতম। 'পদকল্পতরু' শীর্ষক সংকলন গ্রন্থে আমরা পাই-
সৈয়দ মুর্তজা ভনে কানুর চরণে
নিবেদন শুন হরি।
সকল ছাড়িয়া রৈনু তুয়া পায়ে
জীবনমরণ ভরি।।
এ রকম আরো অসংখ্য পদাবলী মুসলমান কবিদের হাতে রচিত হয়, যার দ্বারা বুঝা যায়, মধ্যযুগে আসলে খুব চমৎকারভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় ছিলো। ধর্ম এই সময় সামাজিক সাধারণ মানুষের মনে আজকের মতো গোঁড়া হয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেনি। ধীরে ধীরে পরবর্তীতে মুসলমান কবিদের মনে ধর্মীয় চেতনা প্রগাঢ় হতে থাকে। তারা নিজস্ব ধারা তৈরির প্রয়াসে লিপ্ত হয়। এ' থেকেই পুঁথি কিংবা গাজীর গানের উৎপত্তি ঘটে। মহাশ্মশানের মহাকবি কায়কোবাদ মুসলিম জাগরণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন-
ধর বজ্রমুঠে ভীষণ কৃপাণ,
এ ধর্ম সমরে দেও বলি প্রাণ
শত-বজ্র শব্দে গর্জুক কামান,
গাও ভীমরবে ইসলামের জয়।
অনল প্রবাহের কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী কায়কোবাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলেন-
কিবা ছিলে, কি হইলে, যদি বুঝিবারে দাও,
অতীত গৌরব-পানে মোসলেম! ফিরিয়া চাও।
মুসলিম জাগরণের লক্ষে কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী কেবল এতেই সন্তুষ্ট নন। তিনি নিরন্তর কবিতায় বলে যান-
আবার উত্থান লক্ষে
বহাও জগৎ বক্ষে
নবজীবনের খর প্রবাহ-প্লাবন।
আবার জাতীয় কেতু
উড়াও মুক্তির হেতু,
উঠুক গগনে পুনঃ রক্তিম তপন।
আধুনিক কালে কবিতায় এই জাগরণের ডাক দিয়েছেন কবি কাজী নজরুল তাঁর 'কা-ারী হুঁশিয়ার' কবিতায়-
আবু বকর ওসমান ওমর আলী হায়দর
দাঁড়ী যে এ' তরণীর নাই ওরে নাই ডর
কা-ারী এ' তরীর পাকা মাঝি-মাল্লা
দাঁড়ী মুখে সারি গান লা-শরিক আল্লা।
যদিও কবিতায় কাজী নজরুল একদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি এবং সাম্যবাদের কবি, তবুও তার কবিতার এক বিপুল অংশে ইসলামী জাগরণের চেতনা পরিস্ফুটিত হয়েছে। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পরিষদের সংবর্ধনার জবাবে দেয়া অভিভাষণে কবির এই চেতনা বিকশিত হয় পূর্ণ দল মেলে। মধ্যযুগের কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখনীতে উপ্ত ধর্মীয় চেতনার বীজ এসে পূর্ণ অবয়বে বৃক্ষ হয়ে পরিস্ফুটিত হয় 'সাত সাগরের মাঝি'র কবি ফর্রুখ আহমদের 'পাঞ্জেরী' কবিতায়। 'রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী' বলে তিনি ইসলামী রেনেসাঁর অগ্রদূত, কল্পিত বাহন পাঞ্জেরীকে সাত সাগর পেরিয়ে জাগরণের ভোরকে তাড়াতাড়ি উদয়নের জন্যে উদ্দীপিত করেছেন।
অন্যদিকে মঙ্গলকাব্য ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন-এর মাধ্যমে স্তুতি ও ভক্তি নিবেদনের দিন শেষে কবিতায় বাউল কণ্ঠে ফুটে ওঠে অভিন্নতার মানবিক বাণী-
নানা বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ
জগৎভর মিয়া দেখি সবাই একই মায়ের পুত।
পাশাপাশি শ্রী চৈতন্যের কণ্ঠেও বেজে উঠে মানবতার কালজয়ী মৈত্রী-'সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই'।
নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলা কবিতায় শুরুতে হিন্দু কবিদের হাতে ধর্মীয় চেতনা প্রধান হলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মানবিক চেতনা মুখ্য হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর অন্যদিকে মুসলিম কবিদের হাতে প্রথম দিকে পদাবলী কীর্তন রচিত হলেও পরবর্তীতে ধর্মীয় জাগরণের আহ্বান কবিতায় প্রগাঢ় হতে থাকে। এক পর্যায়ে তা আধুনিক কালে এসে ইসলামী রেনেসাঁর বাণীতে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে।
(ঙ) বাংলা কবিতায় দার্শনিক বিপ্লব :
বাঙালি কখনো দর্শনবিহীন ছিলো না। সবসময় বাঙালি তার নিজস্ব দর্শনে সমৃদ্ধ ছিলো। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ে তুষ্ট বাঙালি তার গভীর আত্মদর্শনে নিমগ্ন ছিলো জাতিসত্তার নির্মাণের সূচনাকাল থেকেই। বৌদ্ধধর্মের অভিধর্ম-দর্শন ধারণ করেই চর্যাপদ সমৃদ্ধ হয়েছে বৌদ্ধ সহজিয়া গুরু ও নাথপন্থীদের হাতে। উচ্চচিন্তা আর সরল জীবনযাপনকারী বাঙালি কবিতায় তার আত্মদর্শনকে ফুটিয়ে তুলেছে গভীর চেতনায়। কাহ্নপা রচিত একটি চর্যায় আমরা পাই-
রাগ দেশ মোহ লইআ ছাড়।
পরম মোখ লভই মুক্তি হার
অর্থাৎ যে ব্যক্তি রাগ, দ্বেষ, মোহ, লোভ এই সমুদয় ত্যাগ করতে পারে, পরম মোক্ষ বা নির্বাণ-মুক্তি তার গলাতেই হারের মতো শোভা পায়। এই চর্যার মূল বক্তব্যই হলো অনিত্য সংসারে তৃষ্ণা ক্ষয় করা এবং আসব-মুক্ত হওয়া। ষড়রিপুর তৃষ্ণা কেউ ছিন্ন করতে পারলে পরম মুক্তি তারই কপালে জোটে।
কাহ্নপা রচিত আরেকটি চর্যায় আমরা পাই-
এবংকার দিঢ় বাখোড় মোড়িউ।
বিবিহ বিআপক কান্দন তোড়িউ
এই দুই চরণের মধ্যেই নিহিত আছে মুক্তির সূত্র। সকল প্রকার বাধা-বিঘ্ন দলে বা মর্দন করে, বিবিধ ব্যাপক বন্ধন ছিন্ন করলেই সংসার হতে মুক্তি সম্ভব। অর্থাৎ নির্বাণের পথে সংসার বৈরাগ্যে দৃঢ় মনোবলে সকল বন্ধন ছিন্ন করা আবশ্যক।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে চর্যাপদে যে গভীর দর্শন প্রোথিত ছিল তা মধ্যযুগে এসে নবতর রূপ লাভ করে। এ সময় তা' জীবনবেদ-এর মতো কবিতায় রূপায়িত হয়। মধ্যযুগের কবি গোবিন্দ দাসের কড়্চায় আমরা পাই-
রমণীর প্রেম হয় গরল সমান।
অমৃত বলিয়া তাহা মূর্খ করে পান।।
মৃত্যুকালে পুত্র কন্যা নিকটে আসিয়া।
বলে বাবা মোর তরে গেলা কি করিয়া।।
এই কড়্চা হতে নরনারীর অন্তঃদর্শন-এর পরিচয় পাওয়া যায়। নারী মাত্রেই কুশলী এবং তাদের সকল নান্দনিক মানবিকতার মধ্যেও বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে। কাজেই নারীর প্রেম সর্বদা অমৃতের মতো নয় বরং তার উল্টো। তার প্রেমে স্বার্থচিন্তা বরাবর বলবৎ থাকে। কবি ভারত চন্দ্র রায় গুণাকর তার 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে বেশ কয়েকটি দার্শনিক বচন সৃষ্টি করে গেছেন। এর মধ্যে 'মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন' উল্লেখযোগ্য। যে কোন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে হলে চাই দৃঢ়তা। এই দৃঢ়তা পেতে হলে যে কোনো মূল্যে আপন শপথে স্থির থাকতে হয়। তেমনিভাবে একই কবির কাব্যে 'নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়' কিংবা 'জন্মভূমি জননী স্বর্গের গরিয়সী' ইত্যাদি দার্শনিক বচন পাওয়া যায় যা আজো বাঙালির মননে-মানসে জাগ্রত হয়ে আছে।
কোন একসময় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ আর নবীন তরুণ কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে 'রক্ত' আর 'খুন' এর ব্যবহার নিয়ে অনেক দূর জল গড়ায় যাতে ঘি ঢালেন প্রমথ চৌধুরী এবং আরো কেউ কেউ। নজরুল তখন আক্ষেপে লিখেছিলেন, 'বড়'র পিরীতি বালির বাঁধ'। নজরুলের এই আক্ষেপের শিরোনামই সৃষ্টি করে গেছেন মধ্যযুগের কবিরা। তাদের কাছেই আমরা পাই-
বড়'র পিরীতি বালির বাঁধ
ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ।
এই হলো বাস্তবতার দর্শন। ক্ষমতায় বড় কারও প্রেম মানেই যখন তখন তার স্বার্থে ব্যবহার। যাকে এক সময় হাতে চাঁদ পাইয়ে দেয় তাকেই আবার প্রয়োজনে হাতে দড়ি দিয়ে হাজত খাটায়, চোর সাজায়।
মধ্যযুগ পার হয়ে আমরা যখন আধুনিক যুগের দিকে আসি কাব্যে দর্শনের তখন ভিন্নমাত্রা মেলে। তখন আর ইহলোক-পরলোক, নিত্য-অনিত্য কিছুই বাদ থাকে না। স্বভাবতই নশ্বর মানুষ মৃত্যুর পর পরকালের কথা চিন্তা করে এবং তার কর্মানুযায়ী পরকালে শাস্তি বা পুরস্কারের ভাবনায় মশগুল থাকে। কিন্তু কবি শেখ ফজলল করিম সেই রকম কিছু ভাবেন না। তাঁর দর্শনে পৃথিবীতেই স্বর্গ-নরক। তাই 'স্বর্গ-নরক' কবিতায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন-
কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক
কে বলে তা বহুদূর
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ-নরক
মানুষেতে সুরাসুর।
মানবতার কবি কাজী নজরুল শেখ ফজলুল করিমের এই দর্শনকেই আরেকটু এগিয়ে এনে তাঁর মানবতার দর্শন প্রকাশ করেন :
মিথ্যে শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কা'বা নাই।
নজরুল কিংবা শেখ ফজলল করিম যখন পরকালের দর্শনকে ইহকালে আনয়ন করেন, রবীন্দ্রনাথ তখন তার মনের গভীরে অন্তরতর নাথের কাছে আশ্রয় খোঁজেন। 'অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে' বলে তিনি যে নাথের নিকট প্রার্থনা করেন, সেই একই নাথের নিকটই তিনি পার্থিব জীবনে শক্তি আর ধৈর্য্য কামনা করে বলেন-
'দাও সহ্য দাও ধৈর্য হে উদার নাথ।'
রবীন্দ্রনাথের এই অন্তরের নাথ কেবল উদার তা-ই নয়। এই নাথ রবীন্দ্রমননের অরূপকর্মা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় যাঁর প্রভাবে দর্শনগ্রস্ত হন, যাঁর প্রভাবে তিনি বাউল রবীন্দ্রনাথরূপে পরিচিত হন তিনি আর কেউ নন-বাঙলার বাউল সম্রাট লালন সাঁইজি। লালন সাঁইজির গীতিকবিতা সে যেনো গীত বা গান নয়, দর্শনের অতল ভা-ার। বাউল দর্শনের মানবিকতত্ত্বের সাধক লালন সাঁইজি নিজেই মানুষের প্রশ্ন আউড়ে যান- 'সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?' লালনের জাত যে কেবল মনুষ্যত্ব এটা যারা জানে না তাদের জন্যেই লালন সাঁইজি অমর গীত রচনা করে বলেছেন-
'ব্রাহ্মণ চ-াল চামার মুচি
এক জলেতে সকল শুচি।'
কাজেই জাত গেল জাত গেল বলে মিছে হায়-হুতাশ, মিছে ভয় পাওয়া। যার জাতই মানুষ তার জাত আবার যায় কিভাবে?
লালনের গীতি কবিতায় যে দর্শন ফুটে উঠে তা মূলত হাওয়ার দর্শন। হাওয়ার দর্শনের চর্চা করতে করতেই এক সময় লালনকে বলতে শুনি-
ধর চোরা হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে
সেকি সামান্য চোরা ধরবি কোণা কাঞ্চিতে?
চিরজীবন মনের মানুষের সন্ধানে লালনের কেটেছে কাল। লালনের গীতি কবিতায় সেই আক্ষেপের কথাই বিধৃত আছে। বাড়ির কাছের আরশী নগরের যে পড়শীর কথা লালনের গীতি কবিতায় উঠে আসে সে পড়শী আসলে এক পরমসত্তা। প্রগাঢ় সাধনায় সেই সত্তার পথ মেলে। না হলে সেই পরমসত্তার অচিন পাখিটি দেহের খাঁচা ছেড়ে উড়ে যায়। ধর্মের ভেদাভেদকে দূরে রেখে ধর্মের তত্ত্ব কথাকে ধারণ করে লালন চর্চা করে গেছে মুর্শিদতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, গৌড়তত্ত্ব প্রভৃতির দর্শন। লালনের এই গভীর দর্শনই বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক অনন্য সম্পদ।
বাংলা কাব্যের সূচনা যুগে বৌদ্ধধর্মের নির্বাণের যে দর্শন ধারণ করে কাব্যের জন্ম সেই কাব্য দিনশেষে পরিণতি পেয়েছে অন্তরতর নাথের দর্শনে, পরিণতি পেয়েছে লালন সাঁইজির মানবতাবাদী দর্শনে। গৌতমবুদ্ধের মানবতাবাদী দর্শন দিয়ে শুরু হয়ে কবিতায় যে দার্শনিক বিপ্লবের যাত্রা শুরু তা মধ্যযুগে ভক্তিবাদ পার হয়ে আধুনিক যুগে পুনরায় মার্গবাদী ধারার মাধ্যমে শক্তপোক্ত হয়ে যুক্তিবাদ ও যোগবাদে পরিণত হয়েছে। তারই বদৌলতে বাংলা কবিতা আজ অবলীলায় বলতে পেরেছে-
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
(চ) বাংলা কবিতায় প্রকৌশল বিপ্লব :
আধুনিক স্থাপত্যবিপ্লবের অন্যতম রূপকার তার নান্দনিক প্রকৌশল। অনন্য প্রকৌশলের গুণেই বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকা কিংবা দালানগুলো দাঁড়িয়ে থাকে নয়নভোলানো রূপ নিয়ে। ঠিক তেমনি করেই কবিতার নিটোল প্রকৌশলের গুণে কবিতার দেহ পায় টেকসই কাঠামো। বাংলা সাহিত্যের আদি বা প্রাচীন যুগ হতে বর্তমান যুগ অব্দি কবিতার প্রকৌশলে নান্দনিকতার প্রয়োজনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনকে দেহে ধারণ করে কবিতা তার শৈশব অতিক্রম করে উত্তীর্ণ হয়েছে টগবগে যৌবনে এবং তারপর লাভ করেছে আজকের ঋদ্ধ পরিণতি।
বাংলা কবিতার (এবং সাহিত্যেরও) আদি নিদর্শন চর্যাপদে চর্যার ছন্দে সংস্কৃত 'পজ্ঝটিকা' ছন্দের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। পজ্ঝটিকা ছন্দে প্রতি চরণে ষোল মাত্রা এবং চারটি পূর্ণ পর্ব থাকে যখন সকল পর্বই চারমাত্রিক। যেমন :
সসুরা / নিদ গেল/ বহুড়ী/ জাগই।
কানেট চোরে নিল/ কাগই / মাগই
এ'ক্ষেত্রে হ্রস্বস্বরকে টেনে দীর্ঘস্বর করে দ্বিমাত্রিক করে নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই চর্যার ছন্দে বিশুদ্ধ পয়ারের দেখা মিলে যেমন :
কমল কুলিশ ঘান্টি/ করহু বিআলী
কিংবা,
অবণাগবনে কাহ্ন/ বিমণা ভইলা।
পাশাপাশি চর্যাপদের চরণসমূহ অন্তঃমিল সমৃদ্ধ। এই মিল কোথাও একক ধ্বনির, কোথাও বা একাধিক ধ্বনির মধ্যে নিষ্পন্ন।
মধ্যযুগে এসে বাংলা কবিতার দেহে পয়ার ছন্দ পুরোপুরি মাত্রায় নিবিষ্ট হয় এবং সমিল চরণে কাব্যপ্রয়াস অব্যাহত থাকে। যেমন :
মেঘে এতো নাইকো পানি সীতার চক্ষে জল।
কান্দিয়া ভিজাইগো আমি অশোকের তল।।
লক্ষ্যণীয় যে প্রতি চরণের শেষে এক দাঁড়ি এবং অন্তঃমিল সমাপনে দুই দাঁড়ির প্রচলন অব্যাহত থাকে।
চরণ বিন্যাসে ধীরে ধীরে দ্বিপদী, ত্রিপদী প্রভৃতির প্রচলন শুরু হয় মধ্যযুগে যা আধুনিক যুগ শুরু অব্দি প্রচলিত ছিলো। যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরগুপ্ত 'নীলকর' কবিতায় ত্রিপদীতে লিখেন-
তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষাগরু
শিখিনি শিং বাঁকানো
কেবল খাবে খোল বিচালী ঘাস।
বাংলা কবিতার মঞ্চে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আবির্ভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত কবিতা সমিল পয়ার ছন্দে এক দাঁড়ি, দুই দাঁড়ি নিয়েই চলেছে। কবি মাইকেল এসে কবিতার প্রকৌশলে এক গভীর বিপ্লব সাধন করলেন। বহুদিনের পুরানো সমিল পয়ার ছন্দকে বিদায় করে তিনি নিয়ে আসলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। তার পাশাপাশি ইংরেজী সনেটের বাংলা সংস্করণ চতুর্দশপদী কবিতাবলি সৃজন করেন। ফলে বাংলা কবিতা বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হতে শুরু করলো। অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনের পাশাপাশি তিনি মধ্যযতির প্রবর্তন করেন এবং কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি যতিচিহ্নের ব্যবহার নিশ্চিত করেন। যদিও প্রথমে হঠাৎ করে অমিত্রাক্ষরে হোঁচট খেতে হয়, কিন্তু পরবর্তীতে অভ্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে এই ছন্দের মাধুর্য ও ওজস্বিতা এবং প্রবহমানতা ধরা পড়ে। এই রকম একটি অমিত্রাক্ষর চতুর্দশপদীতে আমরা পাই-
সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমারি কথা ভাবি এ' বিরলে।
মাইকেল এসে বাংলা কবিতায় প্রথম সার্থক মহাকাব্য রচনা করেন এবং 'মেঘনাদবধ কাব্য' তার বিখ্যাত মহাকাব্য, যেখানে দেব নয় রাক্ষসই বীররসে সিক্ত। উল্লেখ্য যে, মধুসূদনের পর পর নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র অভিনয়ের প্রয়োজনে 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর অমিত্রাক্ষর ভেঙ্গে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে এক প্রকার ছন্দের অবতারণা করেন। যদিও একে গৈরিশ ছন্দ বলে, তবুও এটি পয়ারের একটি রকমফের হিসেবে পরিগণিত বিধায় আলাদা করে আর তার পরিচিতি গড়ে উঠেনি।
বাংলা কাব্যের প্রকৌশল বিপ্লবে মাইকেলের অতুল অবদানের পর তাকে ব্যতীত আর কাউকেই আধুনিক বাংলা কাব্যের জনক আখ্যা দেওয়া যায় না। মাইকেলী যুগাবসানে বাংলা কাব্যে সূচনা হয় রবীন্দ্রযুগের। রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে বাংলা কবিতা ও বাংলা ছন্দ পায় পূর্ণতা। তিনিই প্রথম বলেন- 'অনুভবের ভাষা ছন্দোবদ্ধ'। আর এ' জন্যই 'কবিতা কিছু বলে না, বেজে উঠে'। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যে আবির্ভূত হয়ে প্রথমেই গান ও কবিতার ব্যবধান ঘুচিয়ে আনেন। এই কাজে অবশ্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন তাঁদের অমর সৃষ্টির মাধ্যমে। নিজের ছান্দসিক জীবনের সূচনা রবীন্দ্রনাথ মনে করেন 'সন্ধ্যা সংগীত' কাব্যগ্রন্থটিকে। যদিও এই কাব্যগ্রন্থটি ছন্দের দিক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক নয় তবু এতে মুক্তক অক্ষরবৃত্তের শৈশব লুক্বায়িত আছে। পরবর্তীতে 'মানসী' কাব্যগ্রন্থে এসে রবীন্দ্রনাথ মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে পূর্ণপ্রতাপে অধিকার করেন এবং কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ছন্দের নববিধানও সেখান থেকে শুরু বলে মনে করেন। রবীন্দ্রনাথ 'ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থে এসে পুরানো লৌকিক ছড়ার ছন্দকে স্বরবৃত্ত ছন্দে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদান করেন এবং এতে প্রতি পর্বে চারমাত্রা নিশ্চিত করে একটি অপূর্ণ পর্ব থাকার কথা ব্যক্ত করেন। 'পলাতকা' কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ মুক্তক স্বরবৃত্ত প্রয়োগ করেন। অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্তকে করতলগত করে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক গদ্যছন্দকে আয়ত্ত করতে 'লিপিকা'য় অবতীর্ণ হন। রবীন্দ্র গদ্য কবিতা দুর্বল হলেও 'পৃথিবী', 'শিশুতীর্থ' এ'রকম কয়েকটি অসাধারণ গদ্যকবিতা তাঁর হাতেই জন্ম নেয়। কবিতার প্রকৌশলে রবীন্দ্রনাথের ছন্দ বিপ্লবের কতিপয় উদাহরণ যেমন :
শোনো বধূ, শোনো আমি করুণারে ভালোবাসি
সে যদি না থাকে তবে ধূলিময় রূপরাশি। (পাষাণী =৮+৮=১৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত)
যুক্তবর্ণ সমন্বিত পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত যেমন :
বধূরা দেখো আইল ঘাটে,
এল না ছায়া তবু
কলস-ঘায়ে ঊর্মি টুটে,
রশ্মিরাশি চূর্ণি উঠে,
শ্রান্ত বায়ু প্রান্তনীর
চুম্বি যায় কভু।
এমন সময়েই রবীন্দ্র-দীপ্যমানতায় বড় হয়েও স্বতন্ত্র কবি কাজী নজরুল 'বিদ্রোহী' কবিতায় এসে মুক্তক মাত্রাবৃত্ত রচনা করেন, যা রবীন্দ্রনাথের হাতে অসম্পূর্ণ ছিলো। সমসাময়িক জীবনানন্দ কবিতায় যে ছন্দবিদ্যুতের কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন যুগের নাড়ি নির্দেশের কথা, কবি কাজী নজরুল এসে বাংলা কবিতার প্রকৌশলে সেই কৌশলও প্রয়োগ করেন। এ' কারণেই আমরা পাই দ্রোহ আর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান এক দুরন্ত কবিতা-
আমি হোমশিখা,
আমি সাগ্নিক জামদাগ্নি
আমি যজ্ঞ,
আমি পুরোহিত
আমি অগ্নি। ('বিদ্রোহী'- কাজী নজরুল ইসলাম)
রবীন্দ্র-নজরুলের পরে যদিও বিপ্লব আনেননি তবু ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ছন্দ নবদীপায়ন লাভ করে। একই সাথে বাংলা কবিতা যখন তুমুল রবীন্দ্র বিপ্লবে আক্রান্ত তখনই রবীন্দ্রবলয় ছাড়িয়ে, রোম্যান্টিক গীতলতা হতে কবিতাকে মুক্তি দিয়ে আধুনিক পঞ্চপাণ্ডব কবির আবির্ভাব বাংলা কবিতার প্রকৌশলে এবং ইতিহাসে এক অনন্য বিপ্লব সাধন করে। কবিতায় প্রাচীন ভাষারীতির ব্যবহার বর্জন, গদ্য কবিতার উন্মেষ এবং কবিতায় মিথের ব্যবহার ও উত্তর আধুনিকতা আনয়নে তিরিশের দশকের পাঁচ কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও অমিয় চক্রবর্তীর ভূমিকা অসামান্য।
আধুনিক এই পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশের ভূমিকা ভিন্নতর। বিশেষতঃ বাংলা কবিতার নির্মাণ-প্রকৌশলে তিনি এনেছেন নূতন বিপ্লব। কবিতার ছন্দে একটু দীর্ঘায়িত আলস্য এনে তিনি কাব্যরসকে নূতনতর স্বাদে পরিবেশন করেছেন। তাঁর কাব্যে নিজস্ব ভাষার নির্মিতি আছে, আছে ক্রিয়াপদ এবং সর্বনামে ভিন্নতা। যদিও আপাত দর্শনে প্রমাদ মনে হয় কিন্তু নিবিড় পর্যবেক্ষণে এটাই তার বিপ্লব। কবি জীবনানন্দ দাশই বাংলা কবিতায় প্রথম পরাবাস্তববাদী কবি। তাঁর হাত ধরেই বাংলা কবিতা প্রবেশ করেছে উত্তরাধুনিক পরাবাস্তবের যুগে। আর এই কারণেই তিনি বলতে পেরেছেন-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু'দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
তিরিশের কবিদের পরে পঞ্চাশের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতায় নিয়ে আসেন কনফেশনাল যুগ। অ্যালেন গীন্সবার্গের ভাবশিষ্য এই দুই কবির হাত ধরে বাংলা কবিতার দেহে নূতন সজ্জার আবরণ পড়ে। এতে কবিতায় একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় এবং নিষিদ্ধ বিষয়গুলো স্থান পায়। কবি শামসুর রাহমানের 'দুঃসময়ের মুখোমুখি', 'ক্ষমাপ্রার্থী', আবুল হাসানের 'রাজা যায় রাজা আসে', 'পৃথক পালঙ্ক', 'যে তুমি হরণ করো', নির্মলেন্দু গুণের 'সর্বগ্রাসী হে নাগিনী', 'কবিতা, অমীমাংসিত রমণী' ইত্যাদি কবিতাগুলো কনফেশনাল কাব্যের চমৎকার উদাহরণ।
উপসংহার :
যতই সময় চলেছে ততই কবিতার সাথে গদ্যের ব্যবধান ঘুচিয়ে এসেছে ক্রমশঃ। ছন্দ হতে মুক্ত হয়ে ফ্রি ভার্সের যুগে গদ্য আর কবিতাতে যা তফাৎ নিদ্রা আর তন্দ্রাতে সেই তফাৎ। অনুচ্ছেদ গদ্য-কবিতার মতো আজকাল ফ্রিভার্সের চর্চায় কবিতা পরে নিয়েছে এক আটপৌরে আভরণ। রবীন্দ্রনাথও এই গদ্য-পদ্যের সঙ্কীর্ণ ব্যবধান অনুমোদন করেছিলেন। সময়ের চাহিদার সঙ্গতি রেখে ছন্দোবদ্ধ কবিতায় প্রকাশভঙ্গি কোমল হয়ে যায় বিধায় সুকান্ত স্বয়ং বলে গেছেন-
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি।
অর্থাৎ কোমল কবিতার পরিবর্তে কঠিন গদ্য কবিতাতেই যুগের বাণীকে ধরে রাখা, তার আবেগকে প্রস্ফুটিত করা অধিকতর নান্দনিক। তাই উত্তরাধুনিক পরাবাস্তব যুগে ছন্দোবদ্ধ অনুভবের ভাষার পরিবর্তে অনুভূতিগুলো গদ্যের মধ্যে তাদের পৌরুষ খুঁজে পেয়েছে।
বিপ্লব মানেই পরিবর্তন। বিপ্লবের ধারা বলতে মূলতঃ পরিবর্তনের প্রবাহকেই বুঝায়। বাংলা কবিতার চলন সে এক স্রোতস্বিনীর মতো। বহতা এই নদীর স্রোতে এক এক সময় এক এক পরিবর্তন বা পরিমার্জন যোগ হয়েছে। তারই ফলস্বরূপ বাংলা কবিতা পেয়েছে এক ঋদ্ধিময় জগৎ। সামাজিক মানুষের সুখ-দুঃখের দর্শন ও ভাষ্যকার হয়ে যে কবিতার জন্ম সে কবিতাই আজ বিপ্লবের ঋদ্ধ ধারা স্নাত হয়ে বরণ করেছে মায়া-বাস্তবতা। কবিতা আজ কেবল শিল্প নয়, কবিতা আজ চিকিৎসা-উপাদানেরও নাম বটে। কবিতা-থেরাপীর মাধ্যমে আজ অনেকের মনস্তাত্তি্বক জগতের বিকারকে সারিয়ে তোলার কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। প্রত্যয়হীন মানুষকে প্রত্যয়দীপ্ত করার ক্ষেত্রে, দেশপ্রেমহীন মানুষকে দেশপ্রেমী করতে কবিতাই আজ পালন করে যাচ্ছে সংস্কারকের ভূমিকা। বাংলা কবিতার বিপ্লবের ধারায় কবিতা আজ সত্যিকার অর্থেই হয়ে উঠেছে পথ্য-ঔষধ এবং পদ্ধতির এক সমন্বিত বিকীর্ণ প্রজ্ঞা।
তথ্য সহায়তা :
• চর্যাগীতিকা : মুহাম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা সম্পাদিত
• বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : মাহবুবুল আলম
• বাংলা কবিতার ছন্দ : আব্দুল মান্নান সৈয়দ
• লালনগীতি সমগ্র : ওয়াকিল আহমদ
• ইন্টারনেট উইকিপিডিয়া
লেখক পরিচিতি :
বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লেখক একজন কবি, সমালোচক, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক। উপস্থিত রচনা লিখন বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত, দুই হাজার নয় সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত 'সেলিব্রেটিং লাইফ' শীর্ষক প্রতিযোগিতায় গীতিকবিতা বিভাগে পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং ২০১২ সালে চতুরঙ্গ আয়োজিত 'ইলিশ উৎসবে' সাহিত্যিক হিসেবে সম্মাননাপ্রাপ্ত।
সাম্প্রতিক কবিতা: অহমিকার ধূর্তরূপ
বীরেন মুখার্জী
এক.
হাজার বছরের বাংলা কবিতায় দেখা মেলে নানান তত্ত্বের। আমদানিকৃত এসব তত্ত্বের প্রয়োগে বাংলা ভাষাভাষী কবিরা কতটুকু সফল, সে প্রশ্নের পাশাপাশি আধুনিক যুগরুচির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, জাগতিক অন্তর্বেদনা কবিতায় কতটুকু প্রতিভাত, সাম্প্রতিক কবিরা সমষ্টিকে নৈর্ব্যক্তিক সত্তায় বিবেচনা করতেও বা কতটুকু সক্ষম—প্রশ্ন আছে এমন। এরপরও থাকে কবিতায় অলঙ্কারাদি ও নিজস্ব ভাষারীতির প্রয়োগের বিষয়টিও। অস্বীকারের সুযোগ নেই—সব কালের কবিতারই একটা নিজস্ব ভাষারীতি থাকে। কেননা, ভাষার চলমানতা সময়ের মতোই দ্রুতগামী। তবু পূর্বজ কবিদের অভিজ্ঞতালোক, শব্দচেতনা ও ভাষারীতি নতুন কালের কবিরা অতিক্রম করতে পারেন না। ‘মানুষকে যেমন শেকড়ের কাছে যেতে হয়, অস্তিত্বের প্রয়োজনে—কবিতাকেও তেমনি মিথ-উৎস কিংবা ঐতিহ্যলোকের মতো অগ্রজের অভিজ্ঞতালোকেও কখনো কখনো পরিভ্রমণ করতে হয়। নতুন কালের কবিতার বিস্তৃত মূল্যায়নের জন্যে, একটা পূর্ণবৃত্ত কাব্যবস্তু, ভাবলোক ও ভাষারূপ সন্ধানের লক্ষ্যে, হয়তো, কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে।’ বাংলাদেশের কবিতার চেতনাজগত ‘জীবনের বৈচিত্র্য, তার সংঘর্ষ ও গতি, প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতা, সংক্ষোভ ও যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি সংগ্রাম ও আত্মসন্ধানের সমন্বিত পরিচর্যায় নির্মিত’ উল্লেখ করে ‘কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে’ এমন আশাবাদের কথা শুনিয়েছেন রফিকউল্লাহ খান, তার ‘বাংলাদেশের কবিতা: ভাবরূপের পালাবদল’ শীর্ষক প্রবন্ধে। কিন্তু সাম্প্রতিক কবিতার পটভূমে ‘বাঙালি-মনের রূপ ও রূপান্তরের ইতিহাস কবিতার শিল্পশরীরে’ কতটুকু লক্ষ্যযোগ্য তা নিয়ে প্রায়ই দ্বিধায় পড়তে হয়। কেননা, প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি; পাল্টে যাচ্ছে অর্থনীতি, বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ হয়ে উঠছে অসহায়, একা। পারিপার্শ্বিক এসব অভিঘাতে কবি হয়ে উঠছেন বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন মনের অধিকারী। ফলে সাম্প্রতিক কবিতার শরীরে আলোকসম্পাতে মনে হতেই পারে, কবিদের কেউ কেউ মনে করছেন কেন্দ্রচ্যুত বিচ্ছিন্ন অভিব্যক্তিই কবিতা। কিন্তু খেই হারানো আপাত এই উপলব্ধি কবিতাকে সর্বজনীন চিন্তাভাষ্যে সংগঠিত করতে পারছে কিনা, এমন প্রশ্ন উঠে আসা অমূলক নয়। পাঠক হিসেবে এরকম বহু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সাম্প্রতিক কবিতার পাঠ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তেই এ নিবন্ধের অবতারণা।
দুই.
‘কবিতার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন’—কাব্যবিশেষজ্ঞরা এমন উক্তি করেছেন। উক্তিটি আপ্তবাক্য হিসেবে নিয়েও বলা যায়, জীবনলগ্ন হতে ব্যর্থ কবিমানস ‘প্রগতিপরায়ণ’ হলেও তার শিল্পিত আত্মপ্রকাশের পথ সর্বৈব সুপ্রশস্ত হতে পারে না। জীবনের পরতে পরতে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের রসায়ন তা আত্মস্থ করে, নিবিড় তপস্যার মাধ্যমে একজন কবি শিল্পশক্তি অর্জন করেন। কবিচেতনার বিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে কবিতার ভাবরূপ, শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কার ও চিত্রকল্পের প্রকৃতিতেও স্বাভাবিক রূপান্তর ঘটে। আবার এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা জরুরি যে, অসংখ্য গৌণ কবির দেখা মেলে যুগে যুগে। যারা হয়তো যৌথ সময়ের সূচনা ঘটাতে চান, কিন্তু কবিতায় মৌল-গভীরতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে আবেগী বাক্যবিন্যাসকেই কবিতা হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। কবিতার আধার-আধেয়, ছন্দরূপ, রূপময়তা ইত্যাদি প্রপঞ্চকে মান্য করেন না। একুশ শতকে (দীর্ঘ সময়ে প্রকৃত কবিরা নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভাঙা-গড়ার মধ্যদিয়ে কবিতাকে আধুনিক করে তুলেছেন) দাঁড়িয়েও কবিযশোপ্রার্থী একদল গৌণ কবি ‘সামাজিক নির্দেশনা দান’কেই কবিতার অন্যতম শর্ত বিবেচনা করেন। চর্যাপদকে ভিত্তি ধরে হাজার বছরেরও বেশিদিনের বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত প্রচল শব্দসমষ্টিকে অগ্রাহ্য করে বিদেশি শব্দ (ইংরেজি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি) প্রয়োগের সফলতাকে কবিতার মানদণ্ড হিসেবেও বিবেচনা করেন কেউ কেউ। শব্দ প্রয়োগের মানদণ্ড কিসের মাপকাঠিতে নির্ণিত হবে—এমন প্রশ্নেও তারা নিরুত্তর। মানদণ্ডের সুনির্দিষ্ট কোনও ব্যাখ্যাও তারা উপস্থাপনে ব্যর্থ। সাম্প্রতিক কবিতার পাঠসাপেক্ষে পাশাপাশি এটাও উল্লেখ করা যেতে পারে, তরুণ কবিরা নিয়মতান্ত্রিক ছন্দ প্রক্রিয়া থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন। অথচ এখনপর্যন্ত যে কবি সাম্প্রতিক কবিদের ঘোরগ্রস্ত করে রেখেছেন, সেই জীবনানন্দ দাশ ছন্দবদ্ধ কবিতা রচনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। হতে পারে, ছন্দ-অন্বেষণ শ্রমসাধ্য, যে কারণে সাম্প্রতিক তরুণ কবিরা সেদিকে যাচ্ছেন না, বরং স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দের দোহাই দিয়ে সহজ উপায়ে কবিখ্যাতি লাভে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। সমকালীন কবি ও কবিতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য হতে পারে—‘আজ সাধনাও নাই, সিদ্ধিও নাই; আজ বিদ্যার স্থলে বাচালতা, বীর্যের স্থলে অহঙ্কার এবং তপস্যার স্থলে চাতুরী বিরাজ করিতেছে।’
তিন.
সাম্প্রতিক কবিতাকর্মীদের মুখে ‘উত্তরাধুনিক’ শব্দটি বহুল উচ্চারিত। এছাড়া উচ্চারিত হয়ে থাকে নানান ধরনের ইজম। ‘একশ বছরের বেশি আগে উচ্চারিত এবং সাম্প্রতিককালে অনেকটা অবসিত উত্তরাধুনিকতার ধারণাটিকে আধুনিক কবিতার প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন’ এক শ্রেণির কবিরা। এরাই ছোট ছোট গোষ্ঠীভিত্তিক কবিতা তৎপরতায় লিপ্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কবিযশোপ্রার্থীদের এই প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে বহুলাংশে। এরা বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতের সন্ধান (যদিও বিষয়টি দক্ষতা-যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল) না চালিয়ে, কবিতার মর্মার্থ, গূঢ়ত্ব উপেক্ষা করে অজানা এক উন্মাদনার আবর্তে নিজেদের সমর্পিত করে নিজেরাই নিজেদের বাহ্বা দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। আধুনিকতার মর্ম আত্মস্থ ব্যতিরেকে ‘উত্তরাধুনিকতার’ চর্চা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা সাম্প্রতিক কবিতার শরীরে চোখ দিলেই স্পষ্ট হতে পারে। সাহিত্যের ইতিহাসের তত্ত্বতালাশে জানা যায়, ‘১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধের পর সি. রাইট মিল, অসওয়াল্ড স্পেংলার কিংবা মিশেল ফুকো প্রমুখ আধুনিকতাকে সম্পূর্ণরূপে হটিয়ে দিয়ে উত্তরাধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তা বাস্তবে চূড়ান্তভাবে সম্ভব হয়নি আধুনিকতার প্রতিষ্ঠিত ভিত্তির কারণে।’ ‘গোটা পৃথিবীতে উত্তরাধুনিকতার তত্ত্ব নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে বটে, কিন্তু আলোচনা-সমালোচনা, এমনকি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা দিয়েও প্রমাণিত হয় না, সে ধারাটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার ভিত্তি দৃঢ়তা লাভ করেছে।’ এছাড়া বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সাহিত্য-আন্দোলন সামনে এসেছে তার পেছনে ‘সামাজিক প্রবাহ’ গতিশীল ছিল বলেই কবি, শিল্পী, ঔপন্যাসিক প্রমুখ সৃষ্টিশীল মানুষ নতুন পরম্পরা সৃষ্টি করে একটি সাহিত্যের আধারের ওপর আর একটি সাহিত্যিক আধারকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। যাদের হাত ধরে আধুনিকতা কবিতার একটি মৌলিক আধার হয়ে উঠেছে, সেই জয়েস, মালার্মে, র্যাবোঁ, ইয়েটস, এলিয়ট, পাউন্ড, লরেন্স প্রমুখ কবি আধুনিক কবিতাকে সারা পৃথিবীর সামনে এক অনিবার্য নিয়তির মতো দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এসব কবির মেধা, মনন, আত্মমগ্নতা, নানামুখী সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আধুনিকতা একটি সময়-অতিক্রমী প্রপঞ্চ হিসেবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। অথচ কবিযশোপ্রার্থীদের বিশ্বকবিতা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার পরিসর বিস্তৃত না হওয়ার কারণে সেই ‘অবসিত’ উত্তরাধুনিকতার ধুয়া তুলছেন, যা সাম্প্রতিক কবিতায় এক ধরনের সংকট তৈরি করছে। যদিও কেউ কেউ মনে করেন বাংলা ভাষার কবিদের (সাম্প্রতিক) ‘সংকট’ মূলত অতিমাত্রায় পাশ্চাত্যমুখীনতা। বাংলায় বিশ্বকবিতার যোগসূত্র বলতে কবিতার আঙ্গিক প্রাধান্য পেতে পারে, অর্থাৎ কবিতার উপস্থাপনা। যেটা করেছিলেন তিরিশের কবিরা। বস্তুত যেদেশের পটভূমে কবিতা নির্মাণ হবে, সেই দেশের সংস্কৃতি-অনুসংস্কৃতি-ঐতিহ্য অনুসারেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে কাব্যভাষা স্বতন্ত্র হওয়ার দাবি রাখে। কবিতায় নিজ দেশের ঐতিহ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি কবিদের অভিনিবেশ হওয়া দরকার সেই ভাষাটাই কবিতায় তুলে আনা যা আগে কেউ আনেনি। পক্ষান্তরে সাম্প্রতিক কবিদের কবিতা পাঠে এমনটি মনে হওয়া অসঙ্গত নয় যে, শত শত কবিযশোপ্রার্থীরা সবাই মিলে যেন একটি কবিতাই রচনা করে চলেছেন! কবিতা (!) থেকে লেখকের নাম উহ্য রাখলে বোঝার উপায় নেই, কোনটি কে লিখেছেন। সাম্প্রতিক কবিতায় এ বিষয়টিকেও বড় সংকট হিসেবে দেখা যেতে পারে।
কবিতায় ইঙ্গিত প্রদানের ওপর সব যুগেই জোর দেওয়া হয়েছে। বলার ভেতর দিয়ে কবিতা যতটা বিকশিত; না বলে তার চেয়েও অধিক প্রস্ফুটিত। তবে কবিতা শুধু শব্দের ঝঙ্কারে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। ‘কবিতার ভেতর থাকে কবির একান্ত অনুভব ও সাধনা। কবিতার বিষয়বস্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় শেষ হবে তা আগে থেকে ভাবা যায় না। তবে সচেতনভাবে খেয়াল রাখতে হয় শব্দ, ছন্দ কিংবা বাক্যবুননের দিকটা। কবি কবিতাকে জাগিয়ে তুলতে চান শব্দের বন্ধনে। যা পাঠকের অনুভব অনুভূতিতে দাগ কাটে, পাঠককে বিস্ময়াভিভূত করে। শেষপর্যন্ত পাঠকের মননে রস সৃষ্টিকারী কবিতাই প্রকৃত কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কবিতার মৌলদায়ও তাই। অথচ সাম্প্রতিক কবিরা ইনিয়ে-বিনিয়ে, শব্দচাতুর্য তৈরির মাধ্যমে নিজেকে চেনাতে ‘উঠেপড়ে’ লেগেছেন; বিষয়টিকে এক ধরনের ‘অপচেষ্টা’ বললেও অসমীচীন হয় না। হতে পারে, বর্ণাঢ্য ও কাব্যিক জীবন যাপনের পূর্বেই কবিখ্যাতির মোহ অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে সাম্প্রতিক কবিসত্তাকে। এতে আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে যে সম্ভাবনা কিংবা আশাবাদের কথা উচ্চারণ করেন কবিতাবোদ্ধারা, এই ‘মোহ’ সর্বগ্রাসী হয়ে সব সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু ঘটাতে উদ্যত; এমন আশঙ্কা স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে।
মানুষমাত্রই আত্মজিজ্ঞাসাপীড়িত। সমাজের নানান অসঙ্গতি দেখে মর্মাহত হন বিবেকবান মানুষ। একজন কবিও মানুষ। সুতরাং তিনিও মননে দ্রোহ লালন করেন। ফলে কবিতায় কবির পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও অমূলক নয়। কবিতা যেহেতু শিল্পিত প্রকাশমাধ্যম, সেখানে ক্ষোভ-রাগ-অভিমানের প্রকাশও সঙ্গত কারণে শৈল্পিক। একজন প্রকৃত কবি তখনই কবিতা সৃষ্টিতে সার্থক হন, যখন কবি শুধু বিষয়বস্তুর সন্ধানে ব্রতী না হয়ে নিজের মতো করে দৃশ্য সৃষ্টিতে নিমগ্ন থাকেন। এতে কবিতা হয়ে ওঠে পরাবাস্তব জগতের এক ভিন্ন কোলাজ। অথচ সাম্প্রতিক কবিতার গভীর এবং দীক্ষিত পাঠেও ‘কবির নিমগ্নতা’ আবিষ্কার করা কঠিন। কবিতার শরীরে সস্তা দেহজ কাঙ্ক্ষা, শব্দ-চাতুরতা ও আবেগের ফল্গুস্রোত ‘ভাদ্রের নদী’র মতোই প্রবহমান। কখনো কখনো কারও কবিতায় সর্বজনীন চিন্তার গূঢ়ত্বের আভাস মিললেও কবিতা স্রষ্টার গভীর অভিনিবেশের ঘাটতিজনিত শূন্যতায় সার্বিক রচনাটি কবিতা পদবাচ্যে গৃহিত হওয়ার পথে সংশয় তৈরি করছে।
চার.
বিশ্বকবিতায় ফরাসি সিম্বলিজম, একজিস্টেন-শিয়ালিজম, ফিউচারিজম, ইম্প্রেশনিজম কিংবা স্যুরিয়ালিজমের মতো আন্দোলনগুলো ছিল সময় ও কালকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক দৃঢ় অঙ্গীকার। এসব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, কবিগোষ্ঠীর হাতে ‘নতুন প্রপঞ্চ বিনির্মাণের আগে পূর্ববর্তী সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখেই কবিদের এগোতে হয়। একটি নতুন সাহিত্য-আন্দোলন দানা বাঁধে তখনই, যখন তার সম্পূর্ণ উপাদান সমাজদেহের অভ্যন্তরে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকে।’ বাংলায়ও কয়েকটি কবিতা আন্দোলনের তথ্য মেলে। ষাটের দশকে পশ্চিম বাংলার ‘হাংরি জেনারেশন’ বা ‘শ্রুতি আন্দোলন’ কিংবা বাংলাদেশের ‘স্যাড জেনারেশন’ তাদের মেনিফেস্টোয় যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে, সেই আধুনিকতার মধ্যে উত্তরাধুনিকতার চেয়েও ভয়াবহ আত্মঘাতী প্রবণতা লক্ষ্যযোগ্য। ‘হাংরি আন্দোলন’ বাংলা কবিতায় বাঁক পরিবর্তনের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেও শেষপর্যন্ত পুরোপুরি সফলতা পায়নি। তবে এ আন্দোলনের পর আলোকপ্রাপ্তির যুক্তিবোধ, যৌন স্বাধীনতা, শৃঙ্খলমুক্তির ঔদার্য ইত্যাদি প্রপঞ্চ হিসেবে পরবর্তী কবিতায় স্থান করে নেয়। বলাই বাহুল্য, বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্য, নিঃসঙ্গতা, সংস্কৃতির পচন, অবক্ষয় সমাজেরই একটি প্রপঞ্চ। সাম্প্রতিক কবিরা বিশৃঙ্খলাকে প্রাধান্য দিয়ে ভাঙনে আস্থা রেখেছেন, এমনটি লক্ষ করা যায়। তাই সাম্প্রতিক কবিতা হয়ে উঠছে সংশয় ও সংকটের প্রতিনিধি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কবিতা হয়ে উঠছে জনবিমুখ। কখনো ‘ভাষা হয়ে পড়ছে সংকেতের দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা, ভাব পেয়ে যাচ্ছে ব্যঞ্জনা, কবিতা আসছে এগিয়ে এবং সে কবিতার সবটা শরীর সংকেতের এই সূক্ষ্ম অশরীরী উপস্থিতির দ্বারা এমনভাবে আক্রান্ত যে, কবিতার মূল কাব্যগুণ থেকে তাকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। আবার রহস্যময়তা ও জীবনজটিলতার প্রতীকী ব্যঞ্জনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কবিতাকে নির্মেদ গতিময়তা এনে দিলেও সাম্প্রতিক কবিদের সংশয়বাদী মানসিকতা সমষ্টিগত সৌন্দর্যচেতনার ধারা কবিতায় তুলে আনতে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, এমনটি অনুমান করা যায়।
পাঁচ.
আধুনিক বাংলা কবিতা ত্রিশের কবিদের হাত ধরে ব্যাপক পরিবর্তিত হলেও, কবিতা রচনায় কোনো একটা বিশেষ সংজ্ঞার একচেটিয়া প্রভূত্ব কেউ কোনো দিন মেনে নেননি। মেনে না নেওয়ার আসল কারণটা বোধ হয় কবিতার সংজ্ঞার চেয়ে, কবিতার বোধকে অনেক গভীরে বিবেচনা করা। জীবনানন্দ দাশ সজ্ঞানেই বলেছেন ‘কবিতা অনেক রকম’। হতে পারে, এ কারণে প্রচল-অপ্রচল শব্দের জটাজাল সৃষ্টি করে কেউ কেউ কবিতাকে ‘রহস্যময়’ আখ্যা দিচ্ছেন। এ শ্রেণির কবি ‘বাহুল্য শব্দের ঝঙ্কার’কে কবিতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ‘কোনো নতুন প্রপঞ্চ বিনির্মাণের আগে তার পূর্ববর্তী সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখেই কবিদের এগোতে হয়।’ কিন্তু পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক কবিরা কবিতার নতুন পরম্পরা সৃষ্টিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হচ্ছেন, ফলে পাঠকসমাজে সাম্প্রতিক কবিতার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, যাদের হাত ধরে ‘আধুনিকতা’ কবিতার একটি মৌলিক আধার হয়ে উঠেছিল, সেই জয়েস, মালার্মে, র্যাঁবো, ইয়েটস, এলিয়ট প্রমুখ কবি আধুনিক কবিতাকে বিশ্বময় অনিবার্য এক নিয়তির মতো দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কবিরা কবিতায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা জানালেও ‘আধুনিকতা’কে একটি সময়-অতিক্রমী প্রপঞ্চ হিসেবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে সাম্প্রতিক কবিতা সামগ্রিকভাবেই একশ্রেণীর কবিযশোপ্রার্থী, গৌণ কবিদের আত্মঅহমিকা প্রকাশের ধূর্তরূপ বৈ অন্য কিছু নয়।