জাগ্রত বাঙালির চির অহংকার অমর একুশে ফেব্রুয়ারি
শিকড় পরিবারের পক্ষ থেকে
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
মাশরুরা লাকী
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
মাশরুরা লাকী
বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ের এ মাস। পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাবাবেগ প্রকাশের সবচেয়ে বড় নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হচ্ছে মাতৃভাষা। সেদিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউররা। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়ার প্রথম নজির এটি। সেদিন তাদের রক্তের বিনিময়ে শৃঙখলযুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা ও মায়ের ভাষা। আর এর মাধ্যমে বাঙালি
জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ভাষা শহীদদের স্মরণ করে হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে সবার কণ্ঠে বাজে একুশের অমর শোক সঙ্গীত - আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি.....
ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের হাত ধরে। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল " পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু? এই পুস্তিকার লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মুনসুর আহমেদ এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম। বাংলা ভাষাকে ভাব বিনিময়, অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো দাবি তুলে ধরেন।
২১ শে মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেন যে "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা"। সমাবেশস্থলে ছাত্র-জনতা এক সঙ্গে প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হয় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের সমগ্র পূর্ব বাংলায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের কর্মসূচি প্রদান করলে ছাত্র জনতার মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে।
মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র জনতা অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে। মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্র জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এতে সারা বাংলায় প্রতিবাদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সমগ্র জাতি সম্মিলিতভাবে গর্জে ওঠে সিংহের মতো। পরিশেষে, শাসকগোষ্ঠী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ৭টি দেশের ১০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত সংগঠন। কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম ছিলেন এ সংগঠনের উদ্যোক্তা। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষার জন্য আত্মত্যাগকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি " আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি এ বিশেষ দিবসটিকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে।
ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ৫ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ স্বীকৃতি দেয়া হয়।পররাষ্ট্র দফতর "শান্তির জন্য সংস্কৃতি " শীর্ষক একটি রেজুলেশনে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তুলে ধরে। ভারত, জাপান, সৌদি আরব, কাতার সহ বিশ্বের ১২৪টি দেশ এ রেজুলেশনটি সমর্থন করেন।
প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পরিচয়ের মূল নিয়ামক মাতৃভাষা। মাতৃভাষা হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের এক মৌলিক সম্পদ। এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ নিজস্ব ভাব আদান প্রদানের জন্য তার মাতৃভাষা পায় তার জন্মগত আশীর্বাদ স্বরূপ।