কবি সাদিয়া নাজিব
কবিতাকে মন ও মননে পুষে রেখে কবিতায় পূর্ণতা ও কাব্যযোগানের এক অসীম শক্তি রাখেন কবি সাদিয়া নাজিব । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক সহ সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। লেখালেখি, কবিতা আবৃত্তি এবং রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম আভাস (২০১৯) শিখা প্রকাশনী, হয়তো তাকে (২০২০ বইমেলা) দ্বিপজ পাবলিকেশন, ভাঙি অচলায়তন (২০২০ বইমেলা) মূর্ধন্য প্রকাশনী, পিতার খোঁজে (২০২০ বইমেলা) চিরদিন প্রকাশনী। কবির জন্ম ভোলা জেলায়। পড়ালেখা ও বেড়েওঠা ঢাকায়।
কবিতা
নিভৃত
সে জানে ছুঁয়েছে আমার মন
নিয়েছে কেড়ে সকল নিরালা
মধ্যদুপুরের একলা উদাস।
সে জানে মন কুঠুরিতে
প্রদীপ জ্বেলেছে আড়ালে।
রাতের একলায় যুগল কথনে
রয়ে যায় তবুও পলাতক।
সে জানে সকল ফাল্গুন তার
সকল রঙ তার
তবুও নিশ্চুপ বর্ষা চোখের পাতায়
কিছু মেঘ নিয়ে ঘনঘোর।
সে জানে ভালোবাসা কারে কয়
কান্নাভেজা পাতায় শুধু প্রেম জেগে রয়...।
কবি
ক্যাপুচিনোর মগে লেপ্টে থাকা
টিস্যুটির মতো চুপিচুপি ঘামছি
স্নিগ্ধ ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছে কবিতার শব্দ, ছন্দ
অবনত চোখ তুলে দেখো না একবার
এ দু' চোখের প্রেম!
ছাইদানিতে জমছে কবিতার পাহাড়
উঠবে কি তুমি সেই পাহাড় চূড়ায়?
তোমাকে বাঁধবো আমার কাব্যে,সুরে
বাঁধবো প্রচণ্ড
রেখাবে নিখাদে
সকল কোমলতায়।
ঐ চারুমুখে মেখো না মেঘের ছায়া
রংধনু মেয়ে একবার চোখে রাখো চোখ
পুড়ে যাচ্ছি নিঃশব্দে।
একবার এই ঠোঁটে রাখো ঠোঁট!
পাড়ি
যাচ্ছি নিঃশব্দে এগিয়ে ক্রমশ
ঝরে যাওয়ার ক্ষণে। ধীরলয়ে।
নিয়ে যাচ্ছি বুকে করে
মাটির সোঁদা গন্ধ,জল তরঙ্গ,বীজের আর্তনাদ।
নিয়ে যাচ্ছি ক্লান্ত পাখির পালকের রোদ ভেজা ঘ্রাণ।
এইখানে এই ভূমে আবার হবে কোলাহল
উদ্ভিদের মাথা উঁচু করা তেজী অঙ্কুরোদগম
সেই প্রবল গর্জনে মিশে যাবে আমার দীর্ঘশ্বাস!
কত্তো ঘাট ছিলো ঐশ্বর্যে প্রাচুর্যে ভরা
কত্তো আহবান ছিলো তা দিয়ে দেবার।নিঃশর্ত।উজাড়।
একলা নৌকায়!
আমার শূন্য সোনার তরী তবু ভেসে গেছে জলে
সবকিছু পিছনে ফেলে।
নোঙর ফেলিনি কোনো বন্দরে।
জীবনের বিকিকিনি,হাটবাজার
তুলো দণ্ডের মাপজোখ
কেতাদুরস্ত ঠাটবাটের অন্তরের দীনতা,নীচতা
সবই পথে পথে হারিয়েছে ধূসরতায়।
শেকড় ছেড়া এক টুকরো খড়কুটোর
ভেসে ভেসে অগত্যা
পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি অজানায়...
শাম্মা জ্বালায়ে রাখনা
সুরমা গলে গলে পড়ছে
অশ্রুর ফোঁটায় ফোঁটায়
ক্ষীণ হয়ে আসছে শাম্মাদানির রোশনি
দোহাই,শেষ শিখাটুকু বাঁচিয়ে রাখো!
তোমার আঙরাখায় জারদৌসির প্রতিটি বুনটে
এখনো লেগে আছে পার্সিপোলিসের ঘ্রাণ
কত্তো,কতোদিন আগে দুজনে
জ্যোৎস্না রাতে ঘোড়া ছুটিয়েছি
ভূমধ্যসাগর তীরে
আমরা কখনো পার্থে,কখনো মেসিডোনিয়ায়
আবার কখনো সরযুর কোল ঘেঁষে
স্বপ্ন বুনেছি ঢেউয়ে ; মিশেছি ফেনিলে।
তোমার কেশরাশিতে উতলা ছিলো বসরাই আতর
মেহেন্দি হাতে ফুটে থাকতো
পৃথিবীর সবটুকু গোলাপ বাগান।
মনে আছে সব
তুমি তো 'লিডিয়া', তুমি 'নার্গিস'
তুমি 'লাইলি',তুমি 'বিলকিস'
তুমি আমার যুগযুগান্তরের প্রেম।
অশ্রু বিসর্জন দিয়ো না প্রিয়তমা
তোমাকে ভুলিনি আজো
নেকাবের আড়ালে তাম্বূল রাগে
যে ওষ্ঠ কেঁপেকেঁপে উঠেছিলো ভালোবাসায়
ভীত মোমশিখাটির মতো
সে হৃদয়ের কম্পন এখনো বুকে বাজে।
তোমার জরির ওড়নায় বাঁধা পড়ে আছি
আমি 'মজনু', বাঁধা পড়ে আছি 'সেলিম', 'ফরহাদ'
তুমি সে ফাঁস অবমুক্ত করো না।
শাম্মার শেষ আলোটুকু
অশ্রুজলে নিভিয়ে দিয়ো না..।
নিঃশব্দ কথা
জানি তুমি আমাকেই দেখতে আসো
নানা ছলে, নানা ছুতোয়
রেখে যাও স্পর্শ ঘাসে, মাটিতে।
যেখানে যে পথে আমি চলি
চিহ্ন ফেলে যাও তুমি সেই পথে পথে।
তোমার সংকেত, গোপন দীর্ঘশ্বাস
কিছুই গোপন নয় আমার কাছে।
আমি জানি অনেকের ভিড়ে হাজার কথামালার মাঝে
কোন কথাটি শুধু আমার জন্য তোলা।
হৃদপিণ্ড আমার ধক ধক করে লাফিয়ে ওঠে
তোমার গোপন আহ্বানে।
ভীরুর মতো বাতাসেই বার্তা পাঠিয়ে
একলা হও নিজস্ব কথোপকথনে।
এর নাম কি দেবো জানি না
যে অনুভূতি কোন চাওয়া পাওয়া হীন
লেনা দেনার ভাষা যার নেই
শুধুই গোপন,শুধুই দীর্ঘশ্বাস!
মনের তারে ঝংকার ফেলে
স্বপ্নের লাগাম ছিঁড়ে
বৃত্তের বাইরে সাহসী হয়েই দেখো না!
কথা দিলাম বিপদে ফেলবো না
তোমার ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে
ভালোবাসার ঝর্ণাধারা হবো।
এই নির্জনে
এই নির্জন
যেনো জীবনের বাহুল্য বিসর্জন
ধ্যানস্থ নিজ খেয়ালে।
নিজ অন্তঃপুরে গহীন ডুব
একাকীর প্রগাঢ়তায় নিশ্চুপ
খেলা ভাঙার খেলায়,
দীর্ঘ বিজন।
অনেক কোলাহল সাতরে
পাড় ভাঙনের বেদনা আঁকড়ে
যে অথৈ নিঃশব্দ নিমজ্জনে
তার বুকে কান পেতে রই।
একা একটি রোদ তবু পিছু তাড়া করে
আবার ছায়া ফেলবে কার!
এই নির্জনে কোন দূরাগত শব্দ
ভাঙবে ক্রমশ পাতার মর্মর..
আল্টিমেটাম
রঙ-তুলিতে অপেক্ষা, ইজেলে অপেক্ষা
মনে মনে অপেক্ষা
শুধু অপেক্ষা!
আঙুলের ডগায় ডগায় স্পর্শ করার অপেক্ষা
কফির পেয়ালা ভরে উঠবার অপেক্ষা
কফির পেয়ালা খালি হয়ে যাবার অপেক্ষা
তীব্র উত্তেজনায় বুকের ঘাস বিন্দু বিন্দু জলে
ভিজে যাবার অপেক্ষা।
সিগারেট পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সময়।
অপেক্ষা,শুধু অপেক্ষা!
আরেক জোড়া ঠোঁটের
তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের অপেক্ষারত মন,
অপেক্ষারত শরীর
শুকনো,শাদা,ধবধবে শাদা
তারাহীন কালোরাতের মত শাদা!
তুমি জানলে না
কেউই জানলো না
অপেক্ষায় চৌচির হয়ে আছি বহুদিন
তোমার জন্য,শুধু তোমার জন্য
আর নয়--
খোদার কসম করে বলছি
অপেক্ষার ঘর আগুনে পুড়িয়ে
তার লেলিহানে নিজের আত্মাকে রাঙিয়ে
তছনছ ভাঙবো আমি সব
তোমার জন্য,শুধু তোমার জন্য!