কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুকে স্মরণ
আমাদের যৌথ বাড়ি খোঁজার গল্প
টি এম আহমেদ কায়সার
উই যে বেলা ডোবে।
রূপ নারায়ণের কূলে নয়, বরং এই বিফল জীবনের সয়াণহে এক রক্ত-কপোতাক্ষের কূলে জেগে উঠি মাঝে মাঝে আর ভাবি -
স্নেহের
প্রেমের
প্রণয়ের
ঘুমের
জাগরণের
অথবা জীবনের পিপাসা কি মিটেছে, বাহে?
সুরমা থেকে
টেমস
ওয়ার্ফ,
রাইন -
সলবিলো'র ইউজিন হেন্ডার্সনের মতই তো ঘুরে বেড়িয়েছি জলে জলে - তবু এই যে ছলকে ছলকে উঠে বুক সাঁঝে ও নিশিথে - এ কিসের ঢেউ? এ কিসের পিপাসা ঘূর্ণি তোলে গো?
ঐ যে দূর ইলামের মাঠে ডাক পাড়ে কেউ !সানন্দে বাড়ি ফিরছো, কালু রাখাল?
আর দেখো, আমিও তো বাড়ি ফিরতেই চেয়েছি, সারাটি কাল হন্য হয়ে বাড়ি খোঁজে চলেছি, আর বার বার অন্য মানুষের ঘরে ঢুকে পড়েছি নিজের বাড়ি ভেবে।
বন্ধু দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে, রাত্রি গভীর হয়ে এলে, যখন বিশ্বচরাচরে শুধু ঘোড়াখানি দেওয়ের ঘুঙুরের শব্দ, এশিরিয়ায় মিশরে বিলুপ্ত রূপসীদের পাজরের মর্মর আর কারাকোরাম পাহাড়ে এক বুক-ভাঙ্গা ডাইনোসরের মর্মভেদী কাশির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না, আমরা তখন এই বাড়ি ফেরা নিয়েই গল্প করেছি! এ দালান ও দালান টপকে আগে বাড়ি খুঁজতে শুরু করেছিলাম, না কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, নাকি লিখতে লিখতে সহসা একদিন বাড়ির সন্ধান পেয়ে যেতে পারি বলেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম - দুজনের কেউই স্মৃতি হাতড়েও ঠিক স্মরণ করতে পারিনি। শুনেছি, কবিতায় বাড়ির সন্ধান থাকে, এমনকি না থাকলেও, বাড়ি খুঁজে না পাবার বেদনা বা গ্লানি নাকি ভুলে থাকা যায়! দেখি, মঞ্জু বিশ্বনাথ শ্রীহট্র মস্কো বার্মিংহামে তন্ন তন্ন করে নিজের একখানা বাড়িই খুঁজে ফিরছিলেন - যদি আকাশ থেকে তার এই অনুসন্ধিৎসু যাত্রাপথের ধূলির দিকে তাকাই !
রাত দুটোয় ফোন দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করতেন, কবি, রাধার সন্ধান কি আপনি পেলেন? ঠিক জানতাম, আসলে তিনি জিজ্ঞেস করছেন আমি বাড়ি খুঁজে পেয়েছি কিনা! রাধার আরেক নাম দক্ষিণ, তাকে বলেছিলাম একদিন একথা ওকথায়। ফলে তার কাব্য মানসীর নাম তিনি দিয়েছিলেন দেবী দক্ষিণ। মারা যাবার কিছুদিন আগে দক্ষিণামৃত বলে একটা বইও বেরিয়েছিল বলে শুনেছি ।
কৈশোরে এক মর্মন্তুদ দুপুরে ভোলা ফকিরের খেয়া পার হয়ে সহসা ক্ষুধায়, পিপাসায় অথবা এমনও হতে পারে কোনো দৈব দুর্বিপাকে ভুলে কারো রহস্যময় স্নান ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। ঐ যে তখন সম্বিৎ হারিয়ে চিৎকার পেড়েছিলাম ভয়ে ও মোহে, সে-ই ছিল প্রথম কবিতা; কবিতার প্রথম হাতেখড়ি । ... ঐ স্নান ঘরেই মোহবন্দী হয়ে পড়ে আছি ...সেই ঘোর কেন যে কাটেনি আজও, হায়! তাহলে এই যে বলছি বাড়ি খুঁজি ... কোথায় খুঁজি, কার কাছে খুঁজি? খানাখন্দে ঘুরে ঘুরে আমিই কি সেই বুলবুলি, উর্দু সাহিত্যের কোনো এক কবির কবিতায় যেমন পড়েছিলাম, মনে পড়ে, গাছের মগডালে বসে আর্ত-সন্তাপে যে ভেঙ্গে পড়েছে এক ক্রর সূর্যাস্ত বেলায়, হায়, সারাদিন তো পার করেছি হেলায় ফেলায় যৌবনের পাষাণ গুমানে । এখন এই যে আধার নেমেছে চারদিকে, কেমনে বাড়ি যাই!
'ওড়ে ধূলি ওড়ে বালি গগনে গর্জন করে কালো মেঘ, হায়!'
আমার কোনো এক লেখায়, ঠিক মনে পড়ছে না কেন বা কোন প্রেক্ষিতে, এই রকম কিছু লাইন লিখেছিলাম। দিলোয়ার হোসেন মঞ্জু এই লাইনগুলি সুযোগ পেলেই মুখস্থ আওড়াতেন। আমাদের অন্তরের সন্তাপ কি তাহলে কোনো সূত্রে এক হয়ে গিয়েছিল কোথাও? বিফল জনমের ভার কি তাকেও কাঁদাত? রাত্রি গভীরে কতবার ফোনে কথা বলতে গিয়ে গুনগুন করে রা্মপ্রসাদী গেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছি; মঞ্জুর গলায় সুর ছিল না, তবু আমার সাথেই আবেগ গদগদ হয়ে গলা ধরতেন, এমন মানব জনম রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা …
মঞ্জু প্রায় রাতেই ফোনে নিজের কবিতা শোনাতেন; পাঠ করতেন বুঁদ হয়ে। একটা বিশেষ শৈলী ছিল তার পাঠে। শুরুর দিকে আমি খুব মনোযোগ দেইনি; কানে লাগতো মাঝে মাঝে কিছু উল্লম্ফন কিছু উচ্ছৃঙ্খলাও। পরে বুঝেছি, তিনি তো আসলে উচ্ছৃঙ্খলার কবিই হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। তার অসামান্য কল্পনাশক্তি কবিতায় ধীরে ধীরে যোগ করেছে এক বিশেষ পরিণতি। জীবন নিয়ে প্রেম নিয়ে মৃত্যু নিয়ে কি অনায়াসে কৌতুক করতে পারতেন, কি অদ্ভুত তার একেকটা শ্লেষ, কি শক্তিশালী তার আপাত বিসৃশ সব শব্দ-বন্ধ, উৎপ্রেক্ষা আর কী মর্মভেদী সব মেটাফর। নিজের কবিতা পাঠ শেষ হলে জিজ্ঞেস করতেন, আমি কিছু নতুন লিখেছি কিনা। কী বলব সেটা জানতেন বলেই বোধ করি কোনো উত্তর দেবার আগেই শুরু করতেন সশ্লেষ ক্ষিপ্র সব বাক্যবাণ। মঞ্জু একবার যদি আপনার উপর ক্ষেপে যান, স্বয়ং ঈশ্বর আপনার পক্ষে দাঁড়িয়েও কতটা সুরক্ষা দিতে পারবেন এ নিয়ে সন্দেহ আছে। মাঝে মাঝে তার সম্পাদিত ধীশ্বর বলে একটা লিটল ্মাগাজিনের জন্যে লেখা চাইতেন, আরো হাবিজাবি সংকলনের জন্যেও কবিতা পাঠাতে জোরাজোরি করতেন। কিন্তু আমার ধারণা, তখনো তিনি তার লেখালেখির আসল গন্তব্য স্থির করতে পারেননি। নানা রকম রাজনীতি মাথায় রেখে অমুকের একটা ইঁচড়ে পাকা লেখা, তমুকের এক খানা হাফ বেকড কবিতা ইত্যাদিও ছাপতেন ঐ সব সংকলনে; সেখানে সবে ধন নীলমণির মত জ্বলজ্বল করে ফুটতো মঞ্জুর নিজের কোনো লেখা। ফলে লোকচক্ষুর আড়ালে এক আধটু কাব্য ক্বাসিদা লিখে যেতে পারলেও ওসব সংকলনে লেখার আগ্রহ পাইনি কখনো। তাতেই মঞ্জু শুরু করতেন একেবারে সাড়শি আক্রমণ, তীব্র তীব্র সব বাক্যবাণ। বলতেন, এত পণ্ডিতি করেও তো বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবেন না। আপনি তো কবি নন; নারী আর ভাঁড়ামোতেই শেষ হবেন। আপনি আসলে একজন পাইকারি বিক্রেতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু সত্যি সত্যি আমি তো কবিই হতে চেয়েছি, একটু আধটু প্রেমিক, একটু আধটু ঈশ্বর,এমনকি এক আধটু পাইকারি বিক্রেতাও। এই যে আজই এক রূপসীকে দেখে তার চিবুকে সাপ আর ভ্রমর খেলতে খুব ইচ্ছে হল, কবি হতে গেলে কি এইসব আশনা-বাসনায় সংযম টানতে হয় গো? তবে এ আমি ঠিক জেনে গেছি, পাইকারি অথবা খুচরা যেমন বিক্রেতাই আমি হই, আমার পুঞ্জি পাট্টা সবই গেছে এই ভবের বাজারে। বাড়ি ফেরার অর্থকড়িও হারিয়েছি এই নিষ্ঠুর হাটে এসে। এখন হায়, 'মহাজন বুঝাব কী করিয়া রে'!
ওড়ে ধূলি, ওড়ে বালি, গগনে গর্জন করে কালো মেঘ!
কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বলাটা ছিল ভারি আনন্দের। সাত/আট বছর আগে বাংলাদেশ থেকে ফিরে এক নারীকে নিয়ে কথা বলেছিলাম। দূর থেকে শাড়ির ফাঁক গলিয়ে ঝলমল মিহি শাদা পেট আর আগুনভর্তি নাভি দেখেছিলাম একটু আর তাতে সৌন্দর্যের যে ঝলক চোখ ধাধিয়ে গিয়েছিল এ নিয়ে আমার সমুগ্ধ বর্ণনা শেষ হতে না হতেই, মঞ্জু এতেই পেয়ে যান তার উপন্যাসের এক চরিত্র। আমাকে অবাক করে দিয়ে ঐ মুহূর্তের আরো ডিটেল আরও বিস্তর বিবরণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন সহসা। তারপর প্রায় একমাস এ নিয়ে এক চমকপ্রদ উপন্যাস লেখা অব্যাহত চলতে থাকে। প্রায় প্রতিরাতেই আমাকে পাঠ করে শোনাতেন। শিউরে উঠতাম তার বর্ণনার কবিত্ব আর কল্পনার অসামান্য শক্তি আবিষ্কার করে। বাংলা ভাষায় এসব বিষয় আশয় নিয়ে খুব একটা লেখা হয়নি, এটাও তাকে বলেছি কথায় কথায়। এমন কবিত্বপূর্ণ নারী বর্ণনার মাঝে কী সূক্ষ্ম আত্ম-শ্লেষ; আর এসবের সঙ্গে মূর্ত হয়ে উঠেছে আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষের হাহাকার। মঞ্জু বলতেন, এই উপন্যাস আমি আপনাকে উৎসর্গ করে যাব, উৎসর্গ পত্রে বলব যে আপনিই আমাকে উসকে দিয়েছেন, প্ররোচিত করেছেন এটি লিখতে। যদি জুতো নিয়ে কেউ মারতে আসে, বলব যেন আপনাকেও ছেড়ে না দেয়।
তারপর তার উপন্যাসের সেই নারী চরিত্র, সারা উপন্যাসে যার কোনো নাম থাকে না, শুধু ধীমানের বউ নামে সম্বোধিত হতে দেখি, কোনো না কোনোভাবে, বেশিরভাগই কৌতুকচ্ছলে যদিও, আমাদের আলোচনায় উঠে এসেছে। হাসতে হাসতে তিনি উপন্যাসেরই একটা লাইন উদ্ধৃত করতেন বারবার, 'ধীমানের বউ, তুমি তোমার নিতম্ব সংবরণ করো!' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে কিনা জানি না, আমি জানি এটা কিছুতেই কৌতুকের নয়, বরং হয়ে উঠেছিল মানুষের বিমানবায়নের এক মর্মস্পর্শী ট্রাজেডি।
এই যে এত মানুষেরা ধুম করে একদিন হারিয়ে যায়, কোথায় যায় গো তারা? আমার তিন/চার মাস বয়েসি এক বোন বেতবনে হারিয়ে গিয়েছিল, তারপরে যে ভাইটা জন্মালো, সে বড় হল, বিদেশে বসে একদিন শুনলাম, তাকেও নাকি কারা পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের বাড়ির পাশের বেতবনে। একবার ওখানে যারা যায়, আর ফিরে আসে না কখনো। কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও আমাকে বলেছেন, তারা আসে! তারা নাকি লিখতে শুরু করে জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি ফলত মৃত্যুর পর। তারা শুধু কবিতা লিখতেই ফিরে আসে আবার। খুক খুক গলায় কাশতে কাশতে কথাগুলি বলেছিলেন। ফুসফুস প্রদাহে অনবরত কাশতেন শেষ দিনগুলোয়।
মঞ্জু বাড়ি খুঁজে বেড়াতেন।
বাড়ির সন্ধান কি খুঁজে পেয়েছেন, কবি?
এই লেখাটি যখন লিখছি, খুক খুক কাশি আমাকেও কাবু করে ফেলেছে। আমার ধারণা বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে মানুষেরা একদিন ঈশ্বরের বাগানে এসে উপনীত হয়। বাগানে পা রাখতেই শেষ হয় তার শ্বসন রেচন, চর্বণ চোষণ আর লেহনের নশ্বর জীবন।
শুরু হয় ঈশ্বরের অবিনশ্বর জীবন তারপর! জগতের সব মানুষেরাই পায় এক সত্যিকার কবি জীবনের স্বাদ!