একজন দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু
আসমা অধরা
কবি, কালেশ্বর
জলের আক্রোশে
কবি, কালেশ্বর দূরতম যায়…
চুম্বন শেষে রণাঙ্গণে অশ্বারোহী পিতার প্রবাহ।
নিরন্তর পরাজিত, পৃথিবীর পথ
আত্মভোলা কবি অস্ত্রগুলো রেখে আসে মাতৃজরায়নে।
হায়!
দুই পায়ে জড়িয়েছে ছায়ার পর্বত।
(কাব্যগন্থঃ মৌলিক ময়ূর)
-দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু
বিষণ্ন হাইড্রার এপিডার্মিস চিরে যিনি সমস্ত বেদনা খুঁড়ে তুলে আনতেন, তিনি হৃদয়ের কাছাকাছি মানুষ। আমরা কত কত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি, যার অস্তিত্ব থাকে কিন্তু সবসময় নাম থাকে না। অথচ এই হাইড্রার এক নাম ছিলো, কন্যা। আর সেই যাদুকর তার পিতার জায়গায় অবলীলায় বসে ছিলেন রাজার মতোই। এক এক দিন কথা শুরু হতো কবিতা দিয়ে, একদিন গল্প, কখনো থিওরি। কখনো তীব্র শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গ আর সামান্য হাসি। অথচ কখনোই তাকে স্বচক্ষে দেখা হয়নি। এই যে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই যার সাথে কথা হতো দীর্ঘক্ষণ, তাকে কখনোই নিজের কোন যন্ত্রণার কথা বলতেই শুনিনি। তবে আক্ষেপ ছিলো অনেক।
এইসব সূক্ষ্ণ কথার ফাঁকেই কখনো তাঁর হাত ধরে পাহাড়ে, সমতলে, সমুদ্রের পারে হেঁটে হেঁটে কতশত কবিতা শুনেছি। একটা দরাজ কণ্ঠে হাঁক ছেড়ে যিনি কবিতা উচ্চারণ করতেন, মৃদু থেকে শুরু হয়ে একই লয়ে চলতেই থাকতো, কখনো টানা তিন চার ঘণ্টা কবিতাই পড়তেন। এই মানুষের সাথে কথা বলেই জুরিখের রাস্তায় কত হেঁটেছি বলে মনে হয়েছে। মনে হয়েছে পাহাড়ের চূড়োয় বাবরি উড়িয়ে কেউ কবিতা গায়, কবিতা মাখে, কবিতা পড়ে, কবিতা উড়োয়, কবিতা জড়ায়, কবিতা হাসে, কবিতা কাঁদেও। সবচাইতে যা আশ্চর্যের কথা, কবিতা ছাড়া কথাই ছিলো না কোন। প্রতিটা কিছুতেই যে ধ্যানের মতো এক বিন্দুতেই সমাপ্তি।
কয়েক মাস আগে একদিন তাঁকে বললাম, আপনি দেশে এসে ঘুরে গেলেন, একবার বললেনও না! উনি সামান্য হাসলেন বলে মনে হলো। বললেন যারা আমার হৃদয়ের কাছাকাছি, যারা মঞ্জুকে জানে তাদের তো মঞ্জুকে দেখার কথা না। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে একটা পাহাড় কেনার মনস্থ করলেন, বললেন সব হয়ে গেলে আপনি গিয়ে ঘুরে আসবেন। দেখে আসবেন কী ঐশ্বর্য ছড়ানো ধুলোয়। একটা ব্যপারে আমার খুব কষ্ট হয়, আমাদের দেশে সিনিয়র কবিরা কখনোই যেচে পড়ে শেখাতে বা বোঝাতে আসেন দেখিনি। অথচ এই কবিতা নিয়েই কী নির্মম কথা, কাটাছেড়া, কটুক্তি, এমনকি সরাসরি আক্রমণ তিনি করতেন। এই জায়গায় তিনি কঠোর আবার নমনীয়, আক্রমণাত্মক কিন্তু গঠনমূলক, শ্লেষ দিয়েও বদলে দিতে চেয়েছেন কবিতার আমূল ভাষা।
হঠাৎ ফোন করেই বলতেন, ‘আসমা, কন্যা, মঙ্গল ভাবতে হবে, মঙ্গলময় থাকতে হবে। শান্ত হতে হবে। এতোটা অস্থির হওয়া যাবে না, যে এটা নিজের ক্ষতি করে ফেলে’। অথচ প্রতিক্ষণে নিজেকে ক্ষয় করে গেছেন তিনি।
প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন এখন কার কার কবিতা ভালো লাগছে, কেন লাগছে। যেমন নিজের, দেশের, তেমনি বাইরের মানে বিদেশি কবিতায়ও তাঁর দখল ছিলো সমানভাবেই। আবার নতুনদের কবিতা সম্পর্কেও জানতে চাইতেন। যদিও বার্মিংহামে থাকতেন, কিন্তু দেশের মাটিতে পুঁতে রাখা নাড়ির এমন দুর্বোধ্য টান প্রতি কথাতেই বোঝা যেত। একসময় বুঝলাম খুব তীব্রভাবে দেশেই ফিরতে চাচ্ছিলেন। এই মানুষটা কীভাবে, কোন অলৌকিক উপায়ে মন খারাপের কথা জেনে যেতেন। হঠাৎ ফোন করেই বলতেন, ‘আসমা, কন্যা, মঙ্গল ভাবতে হবে, মঙ্গলময় থাকতে হবে। শান্ত হতে হবে। এতোটা অস্থির হওয়া যাবে না, যে এটা নিজের ক্ষতি করে ফেলে’। অথচ প্রতিক্ষণে নিজেকে ক্ষয় করে গেছেন তিনি।
একদিন বলেছিলেন, বলুন তো আপনি কে, আপনি কী! আমি কেবল বলেছিলাম, এক বিষন্ন হাইড্রা। যার এপিডার্মিস জুড়ে গরল আর গরল। শেষ পর্যন্ত মনে রেখেছিলেন, বলতেন, হাইড্রার কী অবস্থা? মৃত্যুর মাস চারেক আগে বললেন, কত কত কিছু বাকী রেখেই চলে যেতে হয় মানুষের। অথচ কত কাজ করার ছিলো। শুনে ভালো লাগেনি, কথাটা বলার মধ্যেই কেমন শিউরানো একটা ভাব ছিলো। খুব করে চেপে ধরতেই বললেন, কর্কট! ক্যান্সারের অবস্থা খুবই খারাপ। আমি খুব অবাক হলাম- কার? তিনি বললেন, ‘আমার’। কবে থেকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, কাউকে বলছি না। কাউকেই জানানোর দরকার নেই। হাসপাতালে যাচ্ছি। ফিরে কথা হবে। এই কথা তিন চারদিন নিজের মধ্যে রেখে মনে হলো কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যকে জানানো প্রয়োজন। আমি ওনাকে ফোন করে বললাম। নির্ঝরদা শুনে বললেন, কী বলেন, এমন কিছু তো জানি না। এরপরে নির্ঝরদা আবার নিজেই ফোন করে বললেন, শোনেন আসমা অধরা, মঞ্জু ভাইর ক্যান্সার হয় নাই, উনি ওইটা এমনেই বলছেন। কিন্তু এর পরে নির্ঝরদা নিজেও জানলেন ব্যাপারটা। এমন অসুস্থ অবস্থায় তিনি বারবার হাসপাতালে গেছেন, আবার বাসায় ফিরেছেন। ফিরেই কথা বলেছেন। শেষের দিকে ওনার কথা কেমন অন্য জগতের হয়ে গেল। ছাড়া ছাড়া। একই তালে না, যেন সব বিষয়েই একটু একটু ছুঁয়ে যেতে চাচ্ছেন। একদিন কথা বলতে বলতেই প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, সাথে কাশি। আমি বললাম মঞ্জু ভাই প্লিজ আগে রেস্ট করেন, কথা বলার অনেক সময় আছে। তিনি বললেন আর বেশি না, চার মাস। মানুষ যে বলে হাত-পা অবশ হয়ে আসে, তা কেমন নিজে বুঝলাম যেন। যতটা সম্ভব সেটা বুঝতে না দিয়ে বলেছি ক্যান্সার কোন বিষয় না। এই হাইড্রা নিজেই তো ক্যান্সার জয় করে এলো তা আপনি নিজেও জানেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠের মতো বললেন, আমি তাহলে একটু রেস্ট নেই। কমলে কথা হবে।
এর ঠিক তিনদিন পরেই ফোন, বললেন মেইল চেক করেন। আমি একটা উপন্যাস পাঠিয়েছি। এটা পড়ে বলবেন যে ছাপা হবার যোগ্য কিনা। আমাকে এই কথা বলায় আমি খুবই অবাক হলাম যে, ছাপা হবার যোগ্য কিনা তা আমার কাছে জানতে চাইলেন বলে। আমি সাথে সাথে সেটা নামালাম। আমাকে বললেন এটা পড়ে আমাকে জানাবেন। হ্যাঁ, যদিও উপন্যাসটা ব্যতিক্রম, তবু এমন কিছু আসতেই পারে। তবে সেটা নিয়ে কথা বলার পরেই একটা কবিতার পাণ্ডুলিপিও পাঠালেন কথা বলতে বলতেই। তারপর বললেন, উপন্যাসটা আমার নামে না দিয়ে, আসমা আফ্রোদিতির নামে ছাপলে কেমন হয়? আমি বললাম অসম্ভব, এটা আপনার। আপনার নামেই যাবে। উনি আমাকে দ্রুত দুটো পাণ্ডুলিপির কাজ সারতে বললেন। সেভাবেই শুরু হলো এর কাজ।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, মঞ্জু ভাই এত প্রকাশক থাকতে আমাকে কেন? নিখাদ এই সম্পর্কটাই থাক। এর মধ্যে প্রকাশক ব্যাপারটা না আসুক, এইগুলো তো নির্ঝরদা নিজেও করতে পারেন। উনি বললেন এই দুটো আপনাকেই দিয়ে গেলাম। আপনি করবেন। উপন্যাসটির নাম, ‘অনবদ্য ইতর’ এবং কবিতার বইয়ের নাম, ‘পাপ ও পল্লিবিদ্যুতের চর্বি’। প্রচ্ছদের ছবিও নিজেই দিলেন, নির্ঝরদা’র করা। আর যে সময় নেই তা উনি নিজে ঠিকই বুঝেছিলেন। তাই এই তাড়া ছিলো। অথচ আমরা জনতাম কমপক্ষে আরো তিন/চার মাস সময় আছে হাতে আমাদের। বই চলে আসবে সহজেই।
শেষ ফোনটা অদ্ভুত ছিলো। খুব ধীরে কথা, আস্তে আস্তে বললেন হাসপাতালে যাচ্ছি হাইড্রা। যদি ফিরে আসি, এসেই কথা হবে। ভালো লাগেনি। একটুও ভালো লাগেনি। আমি বেশ রাগ করেও কথা বলতাম। বললাম, এসব কথা বলার সময় এখনও হয়নি। পাহাড় কিনে বলবেন, আমি গিয়ে ঘুরে আসবো, থেকে আসবো তারপর আপনাকে বলবো পাহাড়টা কেমন। খানিক হয়তো মলিন হাসি হাসতেও চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বললেন, ঠিক আছে। এর মধ্যে আর কিছু কথার দরকার হলে মেসেজ দিয়ে রাখবেন। মৃত্যুর দুই দিন আগে আমি শেষ মেসেজ করেছি, উনি সিন করেছেন। কিন্তু কোন উত্তর আসেনি। বুঝিনি এই উত্তর আর আসবে না।
আসলে ওনাকে নিয়ে লেখার মতো সাহস নেই আমার। আমি কেবল অসংলগ্ন এইসব ভাবি। ওনার মৃত্যুর পর থেকেই প্রায় প্রতিদিন একটাই স্বপ্ন দেখি, বিশাল এক পাহাড় একপাশে রেখে খাদের উপরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। পেছন থেকে দেখা যাচ্ছে তাঁর লম্বা ওভারকোটের প্রান্ত বাতাসে উড়ছে, উড়ছে কাউবয় হ্যাটের নিচে লম্বা সিল্কি চুল। দাঁতে কামড়ে রেখেছেন চুরুট। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন হাতের ইশারায় ডাকলেন। দেখি আমাকেই। আমি এগিয়ে গেলাম। তখনি সামনে দেখলাম হলুদ পাতায় ছাওয়া এক রাস্তা। দুই ধারেই উঁচু উঁচু গাছের সব পাতাই হলুদ। যেন শীতের শেষে ঝরে যাবার জন্য আকুল। সেই রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে পিতৃতুল্য এক মানুষ, কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু, আর তাঁর পাশে কন্যাসম আমি, বিষন্ন হাইড্রা। যিনি প্রচণ্ড স্নেহেও কবিতার জন্য তীব্র আক্রমাণাত্মক, শ্লেষাত্মক কথা ছুঁড়ে মারতেন। যিনি এতগুলো বছরে কবিতার বাইরে কোন কথাই বলেননি। যিনি হাসপাতাল থেকে ফিরতে পারলে কথা বলতে চেয়েছিলেন। যিনি বুঝেছিলেন, তাঁর আর ফেরা হবে না।
আমার মায়ের মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই তৈরি ছিলাম আমার বাবার মৃত্যুর জন্য। কারণ গড় আয়ু তিনি পার হয়েছেন বেশ আগে, অথচ চলে গেছেন আমার মা। সেই আঘাত সামলে ওঠার সাধ্য নেই, অথচ তারপরেই ঠিক বাবার মতোই একই জায়গা দখল করে থাকা মানুষটি চলে গিয়ে এতোটাই ভেঙ্গে দিয়ে গেছেন, যা হয়তো কখনোই আর সামলে ওঠা যাবে না।
যেখানেই আছেন তিনি, মনে হয় খুব ক্লান্ত। যেন কফিনের ভেতর তাঁর হাঁপিয়ে ওঠা দেখতে পাই। মনে হয় একটু পরেই সব ঝেড়ে উঠে এসে কবিতা লিখতে বসবেন, ফিরে আসবেন আবার সে আক্রমণের জন্য। ভালো থাকুক তাঁর সমস্ত কিছু, মঙ্গলে থাকুক ফিরে আসার জন্য। ক্যান্সারাক্রান্ত আরো কিছু কবিতার জন্যও না হয়, না হয় তাঁর দেবী দক্ষিণের জন্যই।