বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে শিকড়ের কবিদের কবিতায়
স্মরণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুটো কবিতা
পরিচয়
খাতুনে জান্নাত
কারো ঔদার্য যখন আকাশ স্পর্শ করে,
কারো স্নেহের হাত হৃদয় মুঠোবন্দি করে,
উদ্দীপিত সংগ্রামী প্রাণ কোটি প্রাণের তোরণে ধ্বনি তোলে
জীবনের সকল গান শুধু তার জন্যে...
নিঃশ্বাসে যে বাতাস দেহকে প্রাণ দেয়
চেতনায় যে জীবন স্বপ্নদ্রষ্টা হয়
ভালোবাসায় যে মন সমর্পিত
মুঠো মুঠো প্রার্থনা শুধু তার জন্যে
সে যখন বাদল হ'য়ে আগলে রাখে মৃত্তিকা
ছায়াতরু হ'য়ে ধরে রাখে দুপুরের নির্জনতা
পিতা হ'য়ে এক জাতির সামনে তুলে ধরে পতাকা
তখন বেদনায়ও রাঙা হয় মন
হৃদয় আরশি থেকে তাকে মোছে
এমন সাহস কারো নেই...
বঙ্গবন্ধু
একটি আঙুল ছিল আলোর
একটি আঙুল ছিল বিদ্যুতের
একটি কণ্ঠ ছিল আজানের
একটি কণ্ঠ ছিল মুক্তির
একটি হৃদয় ছিল ভালোবাসার
মুক্ত পথের পথে ছুটেছিল মানুষ
আঙুলের পথে ছুটেছিল মানুষ
হৃদয়ের গান গেয়েছিল মানুষ
আসলে কী গেয়েছিল?
মানুষের মধ্যে ভাগ ছিল
মানুষের মধ্যে বাঘ ছিল
মাটিকে কি ভাগ করা যায়?
বিগলিত সীসার মতো গলে যেতে থাকে সময়
মাটিতে কঙ্কর ছিল
কঙ্করে আগুন ছিল
ভস্মীভূত হচ্ছে আজও অগণিত মানুষ...
হৃদয় ঝাঁঝরা হলো বুলেটে
খসে খসে পড়ছে একটি জাতির পলেস্তারা
চোখেমুখে
কবি খাতুনে জান্নাত
কবি ও সাহিত্যিক খাতুনে জান্নাত ভালোবাসেন মানুষ ও প্রকৃতি; দুর্বলের প্রতি সহিংসতা ও অভিন্নতার মুক্তি চান তিনি। তাঁর কবিতা নস্টালজিক অনুভূতি, নারী মুক্তি, প্রকৃতি, বোধ ও বিভেদ আবহ, ও উজ্জীবন মূলক। তাঁর জন্ম ১৯৬৯ সালের ১২ জুলাই। কবিতাগ্রন্থ: দিনান্তে দেখা হলে (২০০৯) জীবনের কাছে ফিরে (২০১০), নিরন্তর রোদের মিছিলে (২০১২), মুঠো খুলে দেখি (২০১৬),উপন্যাস :শিউলির কথা (২০১৯)। নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ‘ দ্য রে অফ লাইফ এন্ড নেচার‘ প্রকাশিত হয় ২০১৩, অনুবাদ ব্রজেন চৌধুরী। পুরোপুরি লেখা শুরু ২০০৮ থেকে। লিটলম্যাগ ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখছেন। বাংলাদেশ ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় বাংলা কবিতা ও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে। কবিতার বই নিয়ে আলোচনা করেছেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী, কেতকী কুশারি ডাইসন, মহাদেব সাহা, সালেহা চৌধুরীসহ আরও বিভিন্ন গুণীজন। সখ: ছবি আঁকা।৫০টির অধিক তৈলচিত্র রয়েছে। এ পর্যন্ত ১০০ এর উপরে গান, শিশুতোষ ছড়া, সাহিত্য ও নারী বিষয়ক প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখছেন, করছেন অনুবাদ কবিতা।
পুরস্কার:কৃত্তিবাস স্মারক সম্মান, লক্ষীপুর জিলা সাহিত্য সংসদ পুরস্কার ২০১৫, কবিবরণ সম্মাননা ২০১৬, বিশ্ব শান্তি পদক ২০১৮ ও ভাসানী গোল্ড মেডেল ২০১৮ ।
কবিতা
তিথি আফরোজ
দৈনন্দিনতা
পরোটা বেলতে বেলতেই বেলা হল হেলা। পোড়ামাটির গনগনে ঝাপ-তেলে ভাজি ম্যাড়ম্যাড়ে অলস বিকেল। অনীহার কাঁকর গুঁড়ো অদম্য পাটাপুতায়। সন্ধ্যার বেলকনিতে কোলে নেমে আসে ভারমুক্ত আকাশ। বৃষ্টির উদাসী বার্তা সূঁচে গাঁথি। বেদনার কাঁচে ঝমঝমঝম কালিদাস বর্ষার মেঘমালার দেশ ধর্ষিতার শাড়ির মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়েও দেখায় নকশিকাঁথা রাত। হারায় সাওতাল কন্যার ধোঁয়াশা যাদু। কচুরিবনে জমে থাকে বেগুনি আফিম। মুকুলফোটা বেলা চায়ের টেবিলে আসর বসায়। নির্যাতিত দিনগুলো রক্তের ঢেউয়ে। আজকাল ভোর যেন প্রেমিক সকাল। বালিশে গোঁজে জীবন মাড়ানো অশ্রুর স্ফটিক। শিশুর চকলেট হাসিতে ক্ষয়ে যায় ক্ষয় রোগের প্রাতঃকাল... পাথরকুচি বন থেকে ভেসে উঠে বেহুলার দৃশ্যকাব্য। করুণা দাসীর বেদনাস্নাত নদীর ধারের বেতসী ঝোপেঝাড়ে আতঙ্কিত পাখিদের কলকাকলি হারানো ছন্দের মিড়-তাল। আজকাল দুশ্চিন্তার বলিরেখায় মাধবীকুঞ্জ। বাসন মাজতে মাজতে ধুয়ে ফেলি বিকলন। ছুরতা কাটে কট কট কট ভাবনার খণ্ড-ভার, লিখতে না পারার অনাহূত ছেদ পরিহৃত হয় মেঝের মোছনে। আজকাল বার বার হাত ধুতে ধুতে দৌড়াতে থাকি দুঃখ।
রাতদিনের নীতিকাব্য
চুলায় জ্বলছে মৃন্ময়ী শরীর, রিংটোনে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে সন্ধ্যা; সন্ধ্যা ছুটছে রাত্রির দিকে। রাত্রির বেলবটমে টমটম নৃত্য। প্রাগৈতিহাসিক শহরের ইতিবৃত্ত। ডাস্টবিনের খাবারে যার দিনরাত্রি তাকে শেখায় স্বাস্থ্যবিধি নিঃস্বার্থ মন্ত্রণালয়। বুড়িগঙ্গা পারের টেনারিগুলো উপড়ানো শহররক্ষা কারিক্যুলাম। তবুও নর্দমায় পড়ে থাকে অনাহূত মাতৃত্ব। পিতৃত্বের স্নেহ অনাগত সুখপাখিগান। রাত্রি আর্তনাদ করে তৈলাক্ত থামে। এই জ্বরজ্বর শহরের কার্নিশে কাক পাখিরা চিৎকারে লাঘব করে বিরহের আসমুদ্রহিমাচল। আর্তনাদ-ক্রন্দন পিঠাপিঠি ভাইবোন। মায়ের সমান্তরাল কোল থেকে ধর্মীয় রোষাগারে। কোষাগারে জমা বিভেদের কালো টিপসই। সাজিয়ে যাচ্ছে কারা উন্নয়ন সিডিউল? মডিউলের ফাঁকটুকু নজর এড়িয়ে গেছে কোঅর্ডিনেটরের বাজেটের নীতিমালা।
বাতিহীন পারাবার
আলো নিভে গেছে বহু আগে
বাতি জ্বালাবার কথা ভুলে গিয়ে সন্তানদের শোনাচ্ছি আঁধারের গল্প
গল্পগুলো সুমিষ্ট ফল আর নহরের স্রোতে প্রবাহিত
পথ চলতে চলতে পৃথিবীর মতো কাঁদে পথও
আমাদের পাথরের চোখেও কান্না থাকে
সে কান্না মায়াবী হলেও তার রেষ পৌঁছায় না কারও মনে
আসলে মন তো বহু আগেই পাথর বনের ঘোরে
আমরা আমাদের সন্তান জন্ম দিতে দিতে কখনো পাথর প্রসব করি
পাথর মাতাকে চেনে না, চেনে না বোনও
শুধু গড়িয়ে পড়তে জানে
দেশের বুকে পাথর পেরেক হতে জানে...
স্পর্শ-৩
তুমি ছুঁয়ে দিলে স্নিগ্ধতা
আমি ছুঁয়ে দিলে অমরতা
অথচ স্পর্শের গ্লানি
অথচ স্পর্শের কাটাল
তুমি ছুঁয়ে দিলে নীহারিকা্
আমি ছুঁয়ে দিলে পললতা
অথচ ছোড়াছুড়ি কাদা
অথচ স্পর্শের পায়ে বাধা
তুমি ছুঁয়ে ছিলে ফুল
আমি ছুঁই আবিষ্ঠতা
ছুঁলেই হলকা
ঠাণ্ডা নীল আগুন,
ছাইচাপা আগুন
ছুঁলেই তাণ্ডব
তবুও আমরা ছুঁই জন্মাবধি
ছোঁয়াছুঁয়ি চলে মৃত্যু পর্যন্ত
কবিতা ও আমি ছুঁয়ে ফেলি মৃত্যুকেই...
পথের ভেতর পথ
তুমি-আমি অনন্তের ছায়াছবি। লাল-নীল রাত্রির কথোপকথন । ভৈরবীর বহমান সুরসাগর। ঢেঁকীর তালে তাল রেখে নৃত্যরত ফাগুন সকাল। শহীদের মাল্য অর্পণ শেষে ওরা কারা ছোটে ভিন ভাষার গান! আমরা সে মরীচিকা পথ পেরিয়ে এসেছি। প্রভাতফেরির ছায়ায় দেশ ও মাটির লিখন; কৃষ্ণচূড়া সরগম। কিছু কিছু ভুলরাত্রির মতো কথকতা মিশে থাকে পথের আলনায়। ইরেজারে মুছি ত্রিভুজ ভুলের সম্পাদ্য। সাহারার তৃষ্ণায় ফোটে প্রেমফুল; ঢেউ ভাঙে, ভাঙে কূল। গড়ে চর ও বসতি। চোখাচোখি চখা-চখি, মরাল-মরালী, । চলন্ত পায়ের মুদ্রার ছাপ স্রোতে। স্রোত পৃথিবীর প্রান্ত ছোঁয়া মায়াবতী শিল্পের আঙুল; পারাপারে পাথর ভেঙে ভাসে সাম্পান। আরশিতে দেখা টেমসের জলে পুবদেশের ভেলা; কচুবনের কীর্তন। কে তুমি কৃষ্ণজন ভাঙতে চাও অভিযোগের বুকে দাঁড়িয়ে কষ্টের ছাউনি। কষ্টের রঙ এঁকেছে আকাশের মায়া, পল্লবিত হিল্লোল ভেঙে চলছে বিভেদের পাটাতন। মেদবহুল পথ থেকে ছেঁকে নিই শোভা। ধুলোর পলেস্তারায় ডুবে ছিল বহুকাল। বহুকাল কৃতদাসের ঘায়ে উরু ও আঙুল। বহু চেষ্টা করেও মায়েরা ভাঙতে পারেনি পরজীবি জীবন। সাপের মতো পেঁচিয়ে যাওয়া, বেতবনের মতো আকর্ষীর আঁশ; বহু সাধনার পানসী পথহারা। এসব ক্ষয়ের দৃশ্য ভুলে আঙুলে জড়িয়ে রাখি রোদের কিন্নর। বলের গতির কাছে বেঁধে দি নিয়ন্ত্রণের সমাপিকা সূত্র।
পাঠ
তোমাকে পড়তে পড়তে খুলে যায় চোখ। ঠোঁটের মুদ্রায় ডালিমের হাসি। অলঙ্কারিক বিভাসে উর্ণনাভ বুননে পথের রূপরেখা। পিচ্ছিল কালক্রম। তোমাকে লিখতে লিখতে আয়ুর্বেদ সৃজন। নিরবধি বৈঠার শব্দ কত পূণিমার দোল খাওয়া অনাদি রাতের স্নেহ মায়ের কোল হতে ঝাপিয়ে পড়ে সংগ্রামে; বিজয়গাথার অশ্রু মোছে মোহের আগুন। আমরা পুড়েছি অনিচ্ছার হোমে। ইচ্ছার আলোর গুড়ো প্রতিজ্ঞ আজ শব্দের বন্যায় ভেসে যাবে কালোরাত্রির জৈব সমাচার ; ইরেজারে মুছে মুছে ফিরিয়ে আনি অভিমান ও কল্পদিনের রাগ-অনুরাগ। যদি শেয়ার বাজার ধ্বস থেকে এভাবেই উঠে যেত পতনের দাগ...
ব্যবচ্ছেদ
মানুষ শব্দটি মর্মার্থ হারিয়ে মাকাল মাকাল
ধূর্তেরা খেলছে মানবতা-মুক্ত গুঁটিবল
কতকাল কাঁটাফ্রেমে লটকানো
ব্যবচ্ছেদিত নিয়ম আর স্তূপিকৃত পাপের পাহাড়
বন্য শুকরের আস্ফালনে বারুদের রাত্রি জেগে ওঠে না
মুখপোড়া ডাহুকের দল লুকিয়ে থাকে
মাঝখানে খোলস ও ডিম...
অপারেশন টেবিলে সারি সারি অস্ত্র,
মস্তক, কঙ্কাল, পেশী, জঙ্ঘা, উরু
লউয়ের ধারা
বহমান ক্রোধ, ফনায়মান বিবমিষা
ব্যবচ্ছেদ কেবল ব্যবচ্ছেদ..
দৈরথ
ব্যথাদায়ক শব্দ ভেঙে তৈরি হোক মায়া
তারপর ছড়িয়ে যাক আকাশগঙ্গায়
চোখের নদী বেয়ে ফসলের হাসি
জোড়া হোক ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের গুন
ভেঙে যাওয়া পাতিহাঁস প্রহর
জোড়া দিতে দিতে তালি বাড়ে
সম্পর্ক থেকে টুটে যায় নূপুর
ভাঙা নূপুরের ক্রন্দন এধারে ওধারে...
চকমকে পোশাক পরে কারা হেঁটে যায়!
তুই কী শুনতে পাস প্রথম নগর লিরিক
তুই কী পড়তে পারিস ভাঙা বাক্সের গান!
অবহেলিত পথের কুকুর ভয় পেয়ে দৌড়ে
পিষ্ট হয় পৌরাণিক দানবের ঘায়ে
চারপাশে দম্ভ ভরে যারা পা ফেলে
পায়ের তলায় পড়ে থাকে নরম মানুষ...
তুই হাসির ইমুজি দিয়ে দিয়ে প্রাণ কেড়ে নিস!!
তুই কী এখনো প্রেম মানে পত্রমিতালী বুঝিস?
গতিহীন নারীরা আঁকড়ে ধরে পুরুষ
বিগলিত হতে হতে পাত্রস্থ হয়
বাজতে বাজতে নুড়ির মতো
বাজতে বাজতে শিশুর হাতের ঝুমঝুমি
'ফুলন ফুলন দোলন
একটি দোলন তেলন
তেলন জাম'...
বৈঠক খানার কথা বেজে বেজে শব্দ বড় হয়
প্রতিবাদের কণ্ঠ ক্ষীণ হতে থাকে
বসে যেতে থাকে খনখনে কাশির গলায়...
রুচিহীন নাগরিকেরা ঢুকে গেছে বিশ্বাস প্রাসাদে..
আরবদৈত্যের মতো ক্ষয় করে সামাজিক শাঁস
অধিবিদ্যার আশ্রয়ে ধৌত হোক বীভৎসতা
যোগবিদ্যার আলোকে হোক মোক্ষ লাভ
বৈদিক সুরের সঙ্গমে স্নাত হোক প্রেম
তুলশী তরলে সেরে যাক জমাটবদ্ধতা
নাড়ার আগুনে পুড়ে খাক হোক ভীতি ও বাগাড়ম্বরতা
সেঁজুতি জ্বালাতে গিয়ে কাকে ভেবে পুড়িয়ে ফেলিস সহ্য-কাল?
শেষ বেলার পদ্য
বন্ধুর বিদায়ে লিখে রাখি নীরবতা। চৌচির শব্দে উড়ে যায় চিল। পথের উপর খসে পড়া পালকের বিলাপে আমরা লিখেছি প্রাচীন বনের উপপাদ্য। হিমালয়ের পাদদেশের প্রেম ইতিহাস। ত্রিভূজ কালের খেয়ায় ভাসা তালপাতা হাসি। বাতাসের ফ্রেমে মায়েদের সোনামুখের রোদছায়া। হাতের আলুনি ভাত। লেবুপাতা দিনের নক্সা। একই ডায়েরিতে লিখেছি শ্রাবণ, নারিকেল পাতার শিস, পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা হাসি। লুকোচুরির বেতবন পেরিয়ে হারিয়ে যাবার না জানা কথা। এক কবিতায় দুজনের অভিমান। এখন তো উড়ে যাবার সাহস নেই। জীবনের রূপকথাকে গুছিয়ে এনেছি প্রায়...