top of page
দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু- মুক্ত গদ্য

কবিতা ও আত্মবিধ্বংসী কবিতা
 
একজন্মে মানুষ কবিতা লিখতে পারে না, মানুষ কবিতা লেখে মৃত্যুর পরে। অন্তরাত্মার এই অসহায়ত্ব ধারণ করে মানুষ কবিতা লেখা আয়ত্ব করেছে- এ এক আশ্চর্য বিষয়। আর সবচেয়ে অত্যাশ্চর্য বিষয়- মানুষ নির্মাণ করছে আত্মবিধ্বংসী কবিতা, আত্মা ও আত্ম-উন্মোচনের তীব্রতা থেকে। এ যেনো অলৌকিক কবিতা, লৌকিকতা অস্বীকার করে নয়; ত্রিশ দশকের আধুনিক বাংলা কবিতার অত্যুজ্জ্বল প্রতিনিধিত্বই নয়, বরং পৃথক আত্মা নিয়ে পৃথক অনুভূতিতে, যুগ-চেতনায়, ঐতিহ্যে, পান্ডিত্যে সনাক্তযোগ্য ও সয়ম্ভূ। আত্মবিধ্বংসী কবিতা লঘু-চেতা কোনো সন্ন্যাসীতত্ত্ব নয়, আবার চূড়ান্ত বাউলীয়ানা অস্বীকার করে নয়; পান্ডিত্যপূর্ণ অথচ পান্ডিত্যে ন্যুব্জ নয়। কবি যেনো মহাসমুদ্রে এঁকে দিচ্ছেন চিহ্ন-রেখা, বাতাসে দস্তখত দিয়ে পাখিদের দেহ হতে মধ্যাকর্ষণ চিরে দিচ্ছেন। এ কোনো সুখী-সমৃদ্ধশালী একাডেমি শিক্ষিত মিস্ত্রিবিদ্যকের কবিতা নয়। যারা আত্মবিধ্বংসী তারা আত্মজিজ্ঞাসু। শুধু তত্ত্ব আর যুক্তি দাঁড় করিয়ে গৌণ কবিদের মত পরিতৃপ্ত নন, বরং জিজ্ঞাসা আরো তীব্র, আরো দৃঢ়মূল হয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, অনুভবের কেন্দ্রীয় উৎস হতে। অতৃপ্ত কবি মহাশূন্যে ছুঁড়ে দেন প্রশ্নবিদ্ধ সত্তার শলাকা। নিকটতম সূর্যকে হত্যা করতে চান অথবা নিজেই দৃশ্যমান হতে চান বিন্দু বিন্দু হয়ে নিজের কাছে। ঈশ্বর, নদীনালা, পুষ্প, প্রজাপতি হত্যার মাধ্যমে বোধ করি কবি একসময় আত্মবিধ্বংসী হয়ে ওঠেন তার রচনায়, কখনো কখনো নৈমিত্তিক জীবন যাপনেও। কবি যখন চূড়ান্ত সমর্পিত- একটা লাল বন-পিঁপড়াকে হত্যার মাধ্যমেই যেনো হত্যা করা হল সারাটা প্রাণীমন্ডলী। কবির বিরোধ তৈরি হয় যাপিত জীবন, রাষ্ট্র, ধর্ম, প্রথা, রাজনীতি, অর্থনীতি, অকবি, গৌণ কবির সঙ্গে। সর্বকালে, সর্বভাষায়ই গৌণ কবির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এখনতো এমনই যে, কবিতা লেখার মত সহজ আর মরীরী কাজটুকু যেন দ্বিতীয়টি নেই... 
550505_3929831863765_932176974_n.jpg
কবির  স্মরণে কবিদের কবিতা

মৃত কেদার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার

মানুষ মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে, এ-এক বিস্ময়কর ঘটনা। পশু সম্প্রদায়ের ভেতর কেউ কারো সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে বলে আমার জানা নেই। মৃত মানুষের সঙ্গে সওয়াল-জওয়াব করতেন চর-কাশিমপুর গ্রামের ছোটমিয়া। আমি ছোটমিয়াকে নিয়ে দুচার লাইন গল্প লিখতে পারি কিন্তু ছোটমিয়া হতে পারি না; বিধায় শরণাপন্ন হয়েছি কবি মলয় রায় চৌধুরীর। যে প্রযত্নেই হোক, আপনার সঙ্গে কথা যে বলতেই হবে কেদার ভাদুড়ী।

আমার শহরে রোদ উঠেছে, দাউ-দাউ সূর্যের পাশে আধখানা চাঁদও উঠেছে। আমি হাঁটছি স্মলহিথে, কভেন্ট্রি রোড ধরে। আজ রাস্তায় নেমে এসেছে অজস্র নারী ও কমলালেবু। চোখের সামনে এতো এতো স্তনের প্রবাহ… এখন কী হবে কেদার ভাদুড়ী?

—নারীর রক্তে রোদ লাগবে। ধীরে তা দুধ হয়ে যাবে।

আমার ডানদিকে অসংখ্য সিলভারবার্জ, বাঁদিকে বুলেবার; মাথার উপরে উদগ্র জানালাগুলো রাস্তার দুইধারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে যেনো! জানালায় দেখি শিশুদের মুখ। ঐ মুখগুলোর মধ্যে কেদার ভাদুড়ীকে চিনে নিতে কষ্ট হচ্ছে না আমার। ঠোঁট নেই, দাঁত নেই, মাড়ি নেই অথচ শূন্যস্থানে উজ্জ্বল হাসি ঝুলে আছে। আমি কি মাথার ভেতরে এরকম ক’টি লাইন লিখে রাখবো—

ঝাঁপিয়ে-পড়া
উদগ্র জানালায় ছিলো শিশুদের মুখ
তারা কুসুম শিকারি…

গলিত কাচের বাঁশি গলিত ভোরের বাগানে
বাঁকানো সুতোয় কারা যেনো বেঁধে রাখে দিবসের ঘুড়ি

মহামাতৃগর্ভে
উড়ন্ত শালিকের লাশ স্থির হয়ে আছে

পথে
পাথর কুড়াতে যাই
শ্রীমঙ্গলে মানুষ মাতৃভাষায় কথা বলে…
পথে পড়ে আছে হরিণের নাভী

সে এক উড়ন্ত চোখের স্মৃতি
স্থিরতম আয়নাখণ্ডে…

বড় একা লাগছে কবি। উড়ন্ত শালিকের লাশের সঙ্গে আমিও যে স্থির হয়ে আছি নীলবর্ণ ঘুঘু।

‘পাঁঠাকে ধরে আড়াই পোচে যখন বধ করে কসাই তার ছটফটানি লক্ষ্য করেছো কখনো? শালা শুয়োরের জগতে আমি এক পাঁঠা। কলজে থেকে বেরিয়ে আসে এক নিখাদ যকৃত। রঙ তার সেই নারীটির মতো, আমি ছটফট করি, কাতরাই, কেউ কিছু খবর রাখে না। কেননা ঘরে থেকে আমি একা এবং একাই।’

কেনো যে এই একাকীত্বর কথা বারংবার লিখে যেতে চাই। কেনো লিখে যাবো তবে? মৃত্যুর পরে ছেলে ছোকরাদের গালি খেতে?

‘কবি মণীন্দ্র গুপ্ত বললেন, বছর বছর কবিতার বই ছাপিয়ে যান। লাইব্রেরীতে লাইব্রেরীতে দিয়ে যান। তাছাড়া আমাদের আর করণীয় কিছুই নেই। কও, তাও তো পারলুম না। ভাবি কী হবে ছবি হয়ে থেকে; মৃত্যুর পর শুধু গালাগালি খেতে? আরো?’

মৃত্যুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে জগৎসংসারে দুপঙ্ক্তিও রচিত হয় নি, হবেও না। এ-অভিজ্ঞতা থাকলে কী রকম হতো আমাদের কাব্যভাষা? নতুন অর্জনের জন্য মনন স্তরকে তবে কি ‘ইদমে’ নিয়ে যেতে হবে? শতবর্ষ আগে আমি এই ব্রহ্মাণ্ডে ছিলাম না, আমি কি তবে কবিতা লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম? শতবর্ষ পরেও আমি থাকবো না। এজন্যই বোধহয় আমি আমার কোনো এক রচনায় বলেছি—আমি যেনো কবিতা লিখি মৃত্যুর পরে। আজকাল অনেকেই জিজ্ঞেস করে আপনার কবিতায় টুথপেস্ট, ফুটবল, টেনিস, কম্পিউটার, মোবাইল এগুলো নেই কেনো? উত্তর আমার জানা নেই। আজকাল বোধহয় কবিতা লেখা অনেক অনেক সহজ হয়ে গেছে, মিস্ত্রিবিদ্যার বিষয় হয়ে উঠেছে। এমন ভেজালের বাজারে আমি কি তবে প্রস্রাবকেও বীর্য বলে চালিয়ে দেব?

‘খোঁজারা কি তবে ভালো কবিতা লেখে? কখনো? কবিতা লিখতে হলে বীর্যবান হতে হয় মলয়! বীর্যবান। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে হয়। তেরোবার, ঠিক তেরোবার মৃত্যু নামক মাগীটা বুকে হিস্-স্ তুলে বেরিয়ে গেছে। অভাবনীয়ভাবে বেঁচে আছি। এখনো। আমার তো মনে হয় এর পেছনে অলৌকিক কিছু আছে। ‘মনে হয়’ কেন। আমি নিশ্চিত। রবার্ট ক্লাইভ দুবার এভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। তৃতীয়বার নয়। তুমি জানো?”

কাল, মাহকাল আহার করে নদী, পশুপাখি, নারী-নাভীবতীসহ কবি কেদার ভাদুড়ীকেও। … ধহফ সরষবং ঃড় মড় নবভড়ৎব ও ংষববঢ়, রবার্ট ফ্রস্টের মতো তিনিও বহুপন্থ হেঁটেছেন। নির্মাণ করেছেন ধ্যান। এক্ষেত্রে তিনি নিরঙ্কুশ সচেতন এবং অন্যমনস্ক পাঠকের ব্যাপারেও হুশিয়ার।

‘সব মানুষ মানুষ নয়, সব কবিতা কবিতা নয়। আমার কবিতা পড়তে হলে একা একঘরে নির্জনে, ধূপের ধোঁয়ায় একটু, হ্যাঁ একটু মদ্য টেনে আঁধার আঁধারিতে পড়াই ভালো। আমার সব কবিতা ঐ রকমভাবেই জন্ম কিনা, তাই।’

‘আমি মনে করি কোনো কবিতাই শিরোনাম যথাযথ হতে পারে না। নাম্বার দেয়া উচিত। শেক্সপিয়র যেমন দিয়েছেন— ১.২.৩…। নামও দেয়া উচিত নয়। গাড়িতে যেমন নাম্বার দেয়া থাকে অনেকটা তেমনি। কে শক্তি, কে সুনীল, কে জয়, কে মলয় আর কেইবা উত্তম কেউ জানলো না। বোঝা যেতো তখন ব্যাপারটা। আর পঠন ভঙ্গির কথা? এমন সব কবিতা আছে আমার, আমি ছাড়া আর কেউ ঠিকমতো পড়তে পারবে না। পারে না। দেখেছি। একবার ঋষিণ মিত্র আমার এক কবিতায় সুরারোপ করেছিলো। তখন বুঝেছি কবিতারও মার্ডার হতে পারে। বলিনি কিছুই। কেননা এমন কোনো আদালত নেই যেখানে এই খুনের মামলার বিচার হতে পারে। একটা কবিতা যখন একবার পড়েই লোকে বুঝে যায় তখন বাঁদরামির নীল ইতিহাস আমার জানা হয়ে যায়।’

‘আমি যা করি তা হলো এই। ধ্যান। নির্জনতার ধ্যান। ধ্যান মানে খুব সহজ আবার কঠিনও। এক জায়গায় বসে মননকে মনন শূন্যতায় নিয়ে যাওয়া চাই। কিংবা কোনো একটি দৃশ্যে বা বস্তুতে অপলক অনেকক্ষণ দৃষ্টি রাখা চাই। এরকম বেশ কয়েক মাস অভ্যাস করলেই কে যে শেয়াল আর কে যে সিংহ মুখ দেখলেই চেনা যায়। অদ্ভুত এক শক্তির স্ফূরণ হয় তাতে। ফলে কবিতা বা যে কোনো শিল্পের অবস্থান সর্বকালীন এবং সর্বগ্রাসী হয়ে পড়ে। আমি যে একা থাকি বা থাকতে হয় আমার পক্ষে ও দুটোই নির্জনতা এবং ধ্যান বেশ সহজলভ্য।’

জীবন্যাস

গত দুইদিন অথবা দুইশত বছর যদিও তুমি পিরামিডের মতো স্থির থাকতে চেয়েছ, ভেতরে অনুভূত হয়েছে ফেরাউনের মমির কম্পন। মরুতাপে উচ্চকিত ধ্বনি বার বার মিশে গেছে বালির প্রপাতে—খুফু রে, রে ফেরাউন… ঈষৎ ফেটে-যাওয়া মমির ভেতর ঢুকে পড়েছে কয়েকটি উঁইপোকা; তোমার মনে পড়েছে শৈশবের ইতিহাস বইয়ের সবুজ মলাটটির কথা। গত দুইদিন তুমি স্থির থাকতে চেয়েছ অথচ দেখলে—তাড়া-খাওয়া পূর্ণিমা হঠাৎ ঢুকে পড়েছে তোমাদের কলাপসিবল গেটের ভেতর। আহারে জ্যৌৎস্নী! এমন সুন্দরী রাতে কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করে। তুমি ভাবো—সুন্দরী চৌথাই নদীটি যেভাবে মারা গেল… আর ঐ যে নারী কোনো এক ডুবন্ত বিকেলে বউ হয়ে চলে গেল দূরের গ্রামে। দূর পর্বতে দৃশ্যমান হলো ঝর্ণাগুলি—শুধু আত্মহত্যা করছে গড়িয়ে গড়িয়ে। রক্তাক্ত তুমি ছায়া সন্ধান করো। দৃশ্যমান হয়—ফাল্গুনের চাঁদের আলোয় তোমাদের গ্রামের উঠোনে আড়াআড়ি পড়ে আছে ডালিম ডালটির চিরল ছায়া। বাতাস বইছে ছেঁড়া ছেঁড়া। ছায়াগুলি ছায়ার শিরচ্ছেদ করছে ধীরে। দেখতে পাও—তোমাদের বাগিচা বাজারে লন্ঠনের নিম-আলোয় ইলিশের পেটির মতো চিকচিক করছে ঘাতকের ছোরা। এ দৃশ্যে তুমি নিদ্রা যেতে পারো না। বরং শুনতে পাও—তোমার শিথানের পাশে লাল-পাকুড়ে বৃক্ষের বয়স্ক পায়ের আওয়াজ। তারা হাঁটচলা করছে; গুড়ি-কন্দের শব্দ থেঁতলে দিচ্ছে নৈঃশব্দ্য। দৃশ্য উচিয়ে চলে যাও দৃশ্যান্তরে। লোহার গালিচায় বিষণ্ন বালিকারা বসে আছে। তাহাদের হাতে নীল নয়নের নুড়ি। বুঝে উঠতে সামান্য সময় লাগে— বালিকারা কোটর হতে চক্ষুদ্বয় খুলে ফেলেছে, বালিকাদের হাতে এখন মার্বেলের মাছি; তারা চক্ষু খেলায় মনোযোগী হয়—দপ্পা এক, দপ্পা দুই… নির্ঘুম সারারাত ভাবিত হও—ঐ বনমর্মর আর হরপ্পা নদীর নির্মাণশৈলী নিয়ে। তোমার হাতের কাছে প্যারামাকন, পাখিদের ঠোঁট; তোমার হাতের পাশে ম্রিয়মাণ খাগড়ার কলম ছিল। যুদ্ধ করেছ সারারাত অথচ কিছুই লিখতে পারো নি। তাকিয়েছ হাতের কৈশিক শিরা উপশিরা আর রক্তপ্রবাহের দিকে। হস্তদ্বয় গুটিয়ে গেছে কেঁচোর মতো। তোমার হাতে রঙিন কোনো কমলা নেই, শিশিরের স্তন নেই। আপাতত তোমার কোনো হাত নেই; পৃথিবীতে আর কোনো হাতের অস্তিত্ব নেই। তোমার চোখ নেই, কান নেই, তোমার চারপাশে মুণ্ডুহীন জোলেখা সুন্দরী কুহু কুহু রবে… তুমি তাকিয়েছ দূরতম দেশের দিকে—ঐ দেশে কিছুই নাই বন্যাকবলিত পিতার কবর ব্যতিরেকে। তোমার ঘাড়ের ডানদিকে শিলং শহর। কে যেন বলে যায়—ঐ শহরে সরকারি দিঘিতে একটা নীলপদ্ম ফুটেছে; আর যে নারী যুবতী, তার জানালায় সামান্য ঝুলে পড়েছে জুঁই আর শেফালির ঝোঁপ, বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরাতেই তুমি বিমর্ষ হও। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলা আলোর ভেতর একপাল জন্মান্ধ পতঙ্গ উড়ছে, উড়ছে… যে তোমার বন্ধু ছিল, প্রিয় কিশওয়ার এখন মৃত্যুর রাজা… সুবেহ সাদিক ভরা মাঠ। অশ্বারোহী তুমি যাচ্ছ প্রভাতের দিকে। দূর গাঁয়ে ঝুলে আছে কুয়াশার রেখা। শিশিরসিক্ত মাঠে হৃৎকম্পন থেমে থেমেই শুনতে পাচ্ছ আর দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে অচিন পশুদের মগ্নতার শীৎকার। দুরন্ত তোমার হস্তদ্বয় কে যেন ঝাপটে ধরে হঠাৎ। প্রাণপণ যুদ্ধ করো তুমি; কিছুতেই মুক্ত হতে পারো না। সে এক কালো মানুষের হাত, হাতের কব্জি… শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখো—লাল ঘোড়াটি তোমায় ফেলে রেখে কুয়াশার গ্রামে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোনো এক শাকিলা পাখির ডাকে তুমি ইচ্ছে করলেই এখন জেগে উঠতে পারো না। এখন তুমি আর কেউ না। অথচ একদিন ছায়ার ঘনত্ব খুঁজতে যেয়ে লুকিয়ে পড়েছিলে ঝুনা নারকেলের পেটের ভেতরে। নারকেলের ভেতরে জল; আসলে জল নয়, মেঘের মগজ। তুমি বসে থাকলে ফলের পূর্ণিমায়। নিজকে মনে হলো অনেক অনেক কুচবর্ণ অথচ অভিজ্ঞ, প্রাচীন শিলাখণ্ডের মতো; মনে হলো তুমি এক কুকাপণ্ডিত, বসে আছো কুকাশাস্ত্র হাতে; দুই কাঁধে দুইখণ্ড অজগর যাদের রয়েছে নয়শত মাথা…। মাঝে মাঝে উলঙ্গ দুপুরে তুমি আসন পেতেছ নীলনদের তীরে। প্রাচীন গুনিন তুমি, উড়ন্ত কবুতর দুইখণ্ড করে প্রেয়সীর পায়ের কাছে ফেলে দিয়েছিলে আর ঘর্মাক্ত তুমি শিশির খুঁজেছিলে নারী সর্বংসহার বুকের গহিনে। সময় চলে গেছে; মহাকালের হা-করা গর্তের ভেতর সময় অনেক তো চলে গেছে। বহুবর্ষ আগে ঐ সুবেহ সাদিকের মাঠে তোমায় চেপে ধরেছিল ঐ যে হস্তদ্বয়, থামিয়ে দিয়েছিল রথযাত্রা তোমার, পাঁজর ফুঁড়ে সর্বভুক যে শিকড়গুলি মুখের দিকে ধাবমান তা হলো বৃক্ষের দাঁত, জিহ্বাবলি। ঠিক দুইদিন নয়, দুইহাজার বছর ধরে তুমি মানুষ নও; তুমি মূলত বৃক্ষের আহার…

আলোচ্য পেটকাটা ঘুড়ি ও কমলা রঙের হাতি পরম্পরা

একটা পেটকাটা ঘুড়ির ভেতর বাতাসের মুখ আবিষ্কার করতে পেরে আশির দশকের শেষের দিকে চরকাসিমপুর গ্রামের একদল বালক ভাঙা দাঁত ও ছেড়া জিহ্বা বের করে যদিও হেসে উঠেছিল কিন্তু বড় হয়ে আকাশভর্তি শকুনের ঠোঁট ও মানুষের ছিন্নভিন্ন হাত-পা-পাঁজর এবং মৃত কুকুরের ছায়া প্রত্যক্ষণের পর চিরদিনের জন্য ঘুড়ি উড়ানোর কৌশল ভুলে গিয়ে দলবদ্ধ তারা যখন নগরমুখো হয় তখন কেউ কেউ সাঁকো ভেঙে জলের গর্তে অগত্যা হারিয়ে যায় এবং দুতিনজন ছাড়া সকলেই দশ-বারো বছরের ব্যবধানে ভেসে ওঠে পৃথক পৃথক জল ও স্থলখণ্ডে—লেবাননে আফগানিস্তানে জয়দেবপুরে শমসেরনগরে এবং যারা যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয় তারা হাত ধরাধরি করে সড়কের পর মহাসড়ক পেরুতে যেয়ে জ্ঞাত হয়—এ পন্থে চলাচলকারি প্রতিটি ট্রাক বাস মহিলা-বাসসহ অটোরিক্সা হামাজীব নট-নটী এবং রাষ্ট্রপতি মহা-রাষ্ট্রপতিসহ সমগ্র বাংলাদেশের ওজন পাঁচটন করে অর্থাৎ চরকাসিমপুর গ্রামের একটা তিনপায়া উনুনের ভেতর আগুনের ওজন অথবা গ্রামসুন্দরী ভাবিটির স্তনের ওজনের সঙ্গে বিস্তর ফারাক অনুভব করে ঈষৎ বিস্মিত তারা মহাসড়কের মধ্যবর্তী আয়ারল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আপাতচঞ্চল ডানদিকে তাকিয়ে বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরাতেই কমলা রঙের হাতিগুলোর কথা ভুলে গিয়ে পেটকাটা ইঁদুরের ভেতর দলবদ্ধ মানুষের লুকিয়ে-পড়ার-দৃশ্যে বেশ আশ্বস্ত যদিও তবু মনে পড়ে যায়—প্রতিমাসে আঠারোবেলা ভাত খাওয়ার জন্য কমপক্ষে বিশটি সাপ ধরে কোনো প্রযত্নে যখন জীবনধারণ অসম্ভব হতো তখন প্রতি বর্ষা-মৌসুমে কয়েক মণ ঘাড়—ব্যাঙ ধরে কয়েক মণ ভাঙাধানের বন্দোবস্ত করতে হতো… তারপরও তাদের নির্জন পল্লীতে পূর্ণিমা আসত আর ধবল উঠোনে আগুনে-পোড়া পূর্ব পুরুষের মুখ ভেসে ভেসে পুনরায় মিলিয়ে যেত… বেড়ালের হর্ষধ্বনি হতে অনেকগুলো নতুন বেড়ালের জন্ম হলেও কোনো এক প্রত্যুষে নিদ্রা ভেঙে তারা নিরাধারা কান্না করেছিল… ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হতে হতে বাকরুদ্ধ হয়েছিল… এখন যদিও তা মনে নেই তবে নিগূঢ় দৃশ্যকল্পটি কিছুতেই ভুলতে পারে না এ জন্যে যে—ঐ রাতে বেড়াল জননী তার সদ্যপ্রসূত ছানাটির মাথা ও ঘাড়সহ তলপেটের অংশবিশেষ গিলে খেয়েছিল এবং তা প্রত্যক্ষরণের পর অপ্রতিরোধ্য বিবমিষার সময় তারা বুঝতে পেরেছিলো—মানুষ তার সারাটা পাকস্থলী সরু ছিদ্র দিয়ে উগলে দিতে পারে কিন্তু পাকস্থলী হতে বেড়ালের মাথাটা উগলে দেয়া প্রায়-অসম্ভব…

নরপল্লি নারীপল্লি

তখন কালাঞ্জিবেলা; নিদ্রা ভেঙে দেখি আমাদের নরেশম-ল গ্রামে কোনো আকাশ নেই। পৃথিবীর রং পিতার কবরের মতো খয়েরি এবং কালো। জল হাতে কাতারে কাতার যে সকল মৎস্যশিকারি উঠে আসে তারা অর্ধদগ্ধ যদিও, বিধ্বস্ত কাঁধে হাওড়ের গেউর আর মৃতপ্রায় হরিণশাবক লটকে আছে। গ্রামভর্তি মানুষ নিদ্রিত ছিলো। পাখির কোলাহলে তারা দীর্ঘ ঘুমিয়ে থাকলেও সদ্যযুবকের স্বপ্নদোষে হায় হায় করে জেগে ওঠে। তখন উঘার ভরা জালাধানে গেরা আসে- চেংসাইল, টেপি আর পাইজং-এর। পৃথিবীর হঠাৎ-বাতাসে কেঁপে ওঠে নদী, ধুলাভূমে জন্ম নিয়ে গহন মরুভূমে যার শেষ এবং শুরু। গ্রামের তীরবর্তী জবাফুল হতে অজস্র রেণু ঝরে পড়ে। গ্রামের আকাশে সমস্বর শব্দ গম গম করে- হায় স্বপ্নদোষ! হায় স্বপ্নদোষ! মসজিদ ঘাটের পাকনা আতাফল হতে উগলে পড়ে নরম বিচি ও হলদে গুদা। বালক শরমিন্দা হয়; কোমল শরমে যতোবার সে পিছলে পড়ে, প্রত্যঙ্গ ভেঙে যায়, প্রত্যঙ্গ ভেঙে যায়…

দ্রাবিড় রজনীতে সে এক মানবের ছাও দীর্ঘ দাঁড়িয়ে থাকে বঙ্গোপসাগরের কাদাজলে। রংহীন জলের সমগ্রতা নিয়ে সে যখন দীর্ঘতম দাঁড়িয়ে থাকে, তার নুনু কামড়ে লটকে থাকে প্রাগ-ইতিহাসের মাগুর মৎস্য। নির্নিমেষ সে। চিনাজোঁকেরা রক্তচোষে পুনর্বার কাদায় ঝরে পড়ে। ভ্রুক্ষেপহীন যখন সে তাকিয়ে থাকে সূর্যের দিকে, ঐ পারে দেখা যায় আদি পিতা, আদি মাতার ক্রমদীর্ঘতর ছায়া। জরায়ুর জটিলে বসে নিরাধারা সে চিবোয় ইক্ষুর ডাঁটা। এতো মাটি কেন আসমানে আসমানে, ইক্ষুবনে? মানুষের গুর্দা ও ধানক্ষেতের আওয়াজ শোনার বহুবর্ষ আগেকার আধা-রাত্রি-জলে যে সব স্বপ্নদোষে উত্থিত হয়েছিলো হিমালয় পর্বত এবং বিপুলা ক্রোধে, প্রেমে, কামে জেগে উঠেছিলো ভারতমাতা, ভ্রাতা, পুত্র, প্রেমিকারা বহুবর্ষ পরে নাদান বালকের স্বপ্নভ্রমে মাঝে মাঝেই ভিজে যায় দ্রাবিড় রজনী ও ফুলবাগিচা সহচরে কাফিরিস্থান গ্রামের ইয়ারুন্নেসাসহ নরপল্লি, নারীপল্লি…

রোমথা

ভাঙা চশমার ভেতর দিয়ে সূর্য দেখে নিচ্ছে এই অন্ধ্রপ্রদেশ, এই ভূ-পৃষ্ঠকে; আলো পড়েছে দক্ষিণ-ভারতের দেবী দক্ষিণ পাহাড়ে…

হে পাহাড়, তোমার বয়স কতো! মানুষের ঘাড়ের গন্ধ শুঁকে বয়স টের পাওয়া যায়- কে জানি বলেছিল সেই কবেকার শৈশবে! পাহাড়ের বয়স কী করে জানলো বক্ষব্যাধি হাসপাতালের তরুণ বক্ষবিদ্যক! মাঝারি আকারের এই পাহাড়টি না কি হিমালয়ের চেয়ে বয়সে অনেক বড়… পৃথিবীর এই পুরনো পাহাড়ে আমি উঠবো… আমার সারা জন্মের ইচ্ছে- জীবনে অন্তত একবার আমি পাহাড়ে উঠবো… আমি ছা-পোষা মানুষ- এই জীবন, এই সংসারের পাহাড় ঠেলে ঠেলে কখনোই কোনো ভূ-পাহাড়ে আরোহণের সুযোগ হয়নি আমার… মা, আমি পাহাড়ে উঠবো… হে পুত্র-কন্যা, আমি জীবনে একবার পাহাড়ে উঠবো… হে মৌ-ভোর, মাটির মমিতে দেখি স্বজনের মরা মুখ… ঐ পাহাড়ে ঘুমিয়ে আছে আমাদের মৃত মা, মৃত ঝর্ণা, হারানো বন্ধুর রোদমাখা মুখ… ঐ পাহাড় শীর্ষে আমি একবার দাঁড়াতে চাই… আমার ডানপাশে অক্সিজেন-সিলিন্ডার, বাঁপাশে পাহাড়… মা, আমি পাহাড়ে উঠবো দ্বাদশ শতাব্দীর মৃত কবিরাজের যুবতী বউ, আমি পাহাড়ে উঠবো… হে লক্ষণ সেন, বল্লম রায়- আমি পাহাড়ে উঠবো…

হাসপাতালের জানলা দিয়ে ভাঙা ভাঙা বাতাস বইছে… এই ভাঙা সংসার ছিদ্র করে বাতাস বইছে…আমি এই ছিদ্রের ভেতর আরো কিছুকাল বেঁচে থাকতে চাই। আমার অসমাপ্ত লেখাগুলোর জন্য এই ধার করা সময়ের ভীষণ দরকার আমার। ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামী, সেই দ্বাদশ শতাব্দীর রোমথা, যাদের কপালে কাটা দাগ আছে, যারা গিনিপিগের মতো ব্যবহৃত হবে আয়ুর্বিদ্যার কাজে, ফাঁসির আগ পর্যন্ত বহুবার সঙ্গম করে যাবে মৃত্যু নামের মাগিটার সঙ্গে; তাহাদের কথা আর কবিরাজের যুবতী বউয়ের কথা… সময়কে ঘুটি করে মার্বেল খেলার জন্য হে মহাপ্রকৃতি, আরও কিছুকাল এই মরপৃথিবীতে বেঁচে থাকা জরূরী আমার…

আর পারছি না হে জননী- ঐ পাহাড়ে আমি উঠবোই… উঠছি তো উঠছি… উঠতে উঠতে উঠতে উঠতে খেয়াল করলাম- আমার নিশ্বাসের মধ্যে ছোটো ছোটো টিলাগুচ্ছ রয়েছে, ক্রমশ তা পাহাড় হয়ে যাচ্ছে! এক জীবনে সবাই কি তবে পাহাড়ে উঠতে পারে না মা! আমার বুকের চাপটা কি ঐ পাহাড়ের চাপের চেয়ে বহুগুণ বেশি! গড়িয়ে গড়িয়ে উপরের দিকে উঠছি না কি নিচের দিকে যাচ্ছি ঠিক বুঝতে পারি না! কেবল মনে হয় আমি সেই দণ্ডপ্রাপ্ত রোমথা, আয়ুর্বিদ্যার বিষাক্ত সিরাপ পান করেছি…

যাদু

হঠাৎ এক শেষ রাতে নিদ্রা ভেঙে মনে হলো– আমি তারে চাই, আমি তারে চাই। আবার মনে হলো– আমি তারে স্বীকার করি না স্বীকার করি না। মধ্যখানে অজস্র রূপকথার গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। আমার ভালো লাগে। অথচ আমার শুধু ভালো লাগার কথা নদীতীরে প্রাচীন ঐ বটবৃক্ষটি, যার তলপেটে পাঁচটি সাপ শুয়ে আছে, আঠারোটি পাখির বাসার সঙ্গে দুলে উঠছে একজোড়া পরজন্মা গাছের মাথা। আমি এতো সামান্য কেন বটবৃক্ষ থেকে?

সে হাঁটছে পৃথিবীর পুরাতন পথে মাটির রেখা ধরে। স্বর্ণলতা জন্ম নিচ্ছে তার চরণে চরণে। সে হাঁটছে, অঙ্গে জড়িয়ে থাকা চামড়ার শালের উপর থেমে থেমেই হেসে উঠছে অরণ্যের গাঢ় ছায়া ও অন্ধকার। সে যায় গোলাপ কুড়াতে। কুয়াশা ভেজা সিঁদুরপরা গোলাপ…

বহুদিন তার সঙ্গে কথা বলি। কথা বললেই মনে হয় বাড়ি পৌঁছে গেছি। বহুদিন তার সঙ্গে কথা বলি না। অথচ অনেক কথা প্রতিক্ষণে বলা হয়ে যায়, যেনো বহুকথা বলেও কিছুই বলা হয় না কোনোদিন। কথা ফুরিয়ে গেছে তার, সবকথা… সব ধানসি গীতি, ধ্রুপদ, দ্রাক্ষাবন…। মন উচাটন করে। সোলেমান নগরী ছেড়ে পক্ষী শিরোমণি ভিনগাঁয়ে উড়ে যায়। হায়! হুদ হুদ পাখি, হুদ হুদ পাখি…

আমি ঘুমের মধ্যে বসে থাকি, ঘুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকি। সে-কি কোনোদিন আমায় বলেছিলো¬- কথা হবে, কথা হবে সিনায় সিনায়। বহুবর্ষ আগে অনেক অনেক গোপন বাতুনি, অনেক অনেক পিতলের কলস মাটির পাতালে লুকিয়ে রেখেছিলোাম। আমি তালাশ করি তাদের, খনন করি আর হায় হায় করি– আমাদের পাতাল মানচিত্র অতিক্রম করে ভিনগ্রহে চলে গেছে, ভিনগ্রহে চলে গেছে। অথচ এখনও অনেক ঝড়, অনেক অনেক ভালোবাসা ইন্দ্রজাল আমার ভালো লাগে। কোথায় খুঁজি গোপন?

আল্লার আরশের তলায় লুকিয়ে থাকা হাসান বসরিকে খুঁজে বের করে রাবেয়া বসরি একবার আত্মগোপন করেছিলেন। তাকে খুঁজে বের করতে পারেন নি হাসান বসরি। ক্ষণিক পরে হাসানেরই কলবের ভেতর হতে রাবেয়া বের হয়ে এসেছিলেন। তার দুচোখের জিজ্ঞাসা ছিলো আর কি কোনো প্রয়োজন আছে মধুর মিলনের! যার মাঝে আমি তোমারে খুঁজে পাই সেইখানে মিশে যেতে চাই। কোথায় খুঁজি তারে? প্রতি-অঙ্গে শুধু ডোরাকাটা জন্তুর ছায়া ভেসে ওঠে। কিসের বনি আদম, ইহুদি যাদুকর আমি। তার তো সবকথা শেষ হয়ে গেছে। সে এখন অরণ্যচারী, সে এখন দর্শনশাস্ত্ররূপিনী। তার সঙ্গে কথা বলা শেষ হয়ে গেলে মৃত্যুও বিবিধি সত্তায় আত্মহত্যা করে। মৃত্যুও আত্মহত্যা করে…

bottom of page